বিশেষ কোনও কর্মের আর্থিক সংস্থান নিয়ে মানসিক চিন্তা বৃদ্ধি পাবে। আর্থিক ঝুঁকি নেবার আগে দুবার ... বিশদ
তেষামাদিত্যবজ্জ্ঞানং প্রকাশয়তি তৎপরম্।।
—‘কিন্তু আত্মজ্ঞান দ্বারা যাঁর অজ্ঞান বা আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব বিনষ্ট হয়—সূর্যের মতো তাঁদের সেই জ্ঞান পরম ব্রহ্মকে প্রকাশিত করে।’
কী অনন্যসুন্দর ভাব, কী সুন্দর দৃষ্টান্ত এখানে পাচ্ছি! জ্ঞানেন তু তৎ অজ্ঞানং যেষাং নাশিতম্, ‘যাঁর অজ্ঞান বা আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব জ্ঞান দ্বারা বিনষ্ট হয়েছে’; আত্মনঃ, ‘আত্মার’; অর্থাৎ ‘আমি জ্ঞান দ্বারা আমার অজ্ঞানকে বিনষ্ট করেছি’; সেটি যখন হয়, তেষাম্, ‘তাঁদের’; আদিত্যবৎ তৎ জ্ঞানং পরম্ প্রকাশয়তি, ‘(তাঁদের) সেই জ্ঞান আকাশের সূর্যের মতো পরম ব্রহ্মকে প্রকাশিত করে’। যে-সূর্য আগে ঘন মেঘে ঢাকা ছিল, মেঘ সরে যেতেই তা এখন আবার দেদীপ্যমান। সূর্য সর্বদাই ছিল, কিন্তু মেঘে ঢাকা ছিল। আপনার ক্ষেত্রেও তাই। জ্ঞান আপনার কাছে আপনারই অনন্ত সত্তাকে প্রকাশ করে। যখন জ্ঞানের দ্বারা আপনার অজ্ঞানতা বিদূরিত হয়, কেবল তখনই আপনি বুঝতে পারেন যে, আপনি ওই জড় স্বভাবের একটি ক্ষুদ্র অংশ নন, আপনার মধ্যে নিহিত এক অসীম সত্তা, এক গভীরতম সত্য, যে-সত্য আগেও জাজ্বল্যমান ছিল, এখনও আছে। মেঘ সূর্যের জ্যোতি বিনষ্ট করতে পারেনি; কেবল সে সূর্যকে কিছু সময়ের জন্য আমাদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে পেরেছিল। প্রকাশ মানে দীপ্তি। বেদান্ত বলে, সব মানুষই স্বরূপত পবিত্র ও মুক্ত। আমরা চৈতন্যস্বরূপ, জ্যোতিঃস্বরূপ। চৈতন্যের জ্যোতিই আমাদের স্বরূপ। কিন্তু যখন আমরা মোহাচ্ছন্ন হই, তখন সেই আলো ম্লান হয়ে আসে এবং আমরা নানা অসৎ কর্মে লিপ্ত হই। ওই মোহ, ওই অজ্ঞান দূর করে দিন, তাহলেই দেখবেন জ্ঞান আপন জ্যোতিতে ভাস্বর হয়ে উঠবে। ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং (Robert Browning), তাঁর ‘Paracelsus’ কবিতায় একেই ‘অবরুদ্ধ জ্যোতি’ (The Imprisoned Splendour) বলেছেন। সেই অদ্ভুত আলো আপনার মধ্যে, আমার মধ্যে, সকলের মধ্যে, এমনকি পশুদের মধ্যেও রয়েছে। বেদান্ত বলে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটের মধ্যেও সেই এক আত্মা বিরাজ করছেন। কিন্তু কীট সেই সত্য উপলব্ধি করতে পারে না। একমাত্র মনুষ্যদেহেই এই সত্যের সন্ধান করা যায় এবং তা আবিষ্কার করা যায়।
এইখানেই মানুষের পরম অনন্যতা। আমরা যে স্বরূপত অনন্ত আত্মা, এই নিত্য সত্যটিকে আমরা উপলব্ধি করবার চেষ্টা করছি। কিন্তু স্বভাব বা বহিঃপ্রকৃতি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। স্বভাবের এই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাদের আরও বেশি শক্তিসঞ্চয় করতে হবে। তা যদি করতে পারি, তখনই আমরা উপলব্ধি করব যে অজ্ঞান অপসারিত হয়ে জ্ঞানের উদয় হয়েছে, যেমন মেঘের আবরণ সরে গেলে সূর্য প্রকাশিত হয়। এইটিই আমাদের সমস্ত আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নতির ক্ষেত্রে ঘটে চলেছে। তৎপরম্, ‘যখন আমরা তাঁর সঙ্গে এক সুরে ঝঙ্কৃত হই’, অর্থাৎ আমাদের মনটিকে অন্তরস্থিত আত্মার সঙ্গে একসুরে বেঁধে নিই—তখনই আমরা অজ্ঞানের নাশ করে নিজের প্রকৃত দিব্য স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি। এই ১৬তম শ্লোকটি অতি সুন্দর।
মানুষ সম্বন্ধে এইটিই মহান সত্য। যেমন ‘ভৌত প্রকৃতির সম্ভাবনা বিকাশের বিজ্ঞান’ আছে, তেমনি এই পরম আধ্যাত্মিক সত্যকে পরিস্ফুট করে তোলার প্রণালীটিও একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান। আমরা এর নাম দিতে পারি ‘মানব সম্ভাবনা বিকাশের বিজ্ঞান’ (Science of Human Possibilities)।