বরানগর মঠের ত্যাগব্রতীরা প্রথম থেকে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মদিন উপলক্ষ্যে উৎসব পালন করতেন। সে উৎসবে ত্যাগী ও গৃহী ভক্তেরা সমানভাবে অংশ নিতেন। শশী মহারাজ দীর্ঘসময় ধরে পূজার্চনায় মগ্ন হতেন। ভক্তেরা প্রসাদের আয়োজন করতেন, ভজন-কীর্তনে উৎসব-প্রাঙ্গণ মুখরিত হত। উৎসবপ্রিয় সাধারণ মানুষের কথা ভেবে নরেন্দ্রনাথ উৎসব-আয়োজন কীভাবে করতে হবে সে সম্পর্কে চিঠিপত্রে অনুপুঙ্খ নির্দেশ দিতেন। ভজন ও আহারাদি কিছু কমতি করে মনের খোরাক বিতরণ করতে বলতেন: “এবারকার মহোৎসব এমনি করবে যে, আর কখনও তেমন হয় নাই। আমি একটা পরমহংস মহাশয়ের জীবনচরিত লিখে পাঠাব। সেটা ছাপিয়ে ও তর্জমা করে বিক্রী করবে।”... “মহোৎসবাদিতে পেটের খাবার কম করিয়া মস্তিষ্কের খাবার কিছু দিতে চেষ্টা করিবে... পরমহংসদেবের জীবন এবং তাঁহার শিক্ষা এবং অন্যান্য শাস্ত্র হইতে উপদেশ করিবে। (১৮৯৪ অক্টোবর)” “বেদবেদান্ত পুঁথি একত্র করে আরতি করবে। (১৮৯৬)” এই উৎসব সম্বন্ধে তাঁর অনুপম চিন্তা বহু মানুষের সংশয় দূর করে—“আমাদের মহা জগন্নাথপুরী—যথায় পাপী-অপাপী, সাধু-অসাধু, আবালবৃদ্ধবনিতা নরনারী সকলের সমান অধিকার। বৎসরের মধ্যে একদিন অন্তত সহস্র নরনারী পাপবুদ্ধি ও ভেদবুদ্ধির হস্ত হইতে নিস্তার পাইয়া হরিনাম করে ও শোনে, ইহাই পরম মঙ্গল। (১৮৯৬, ২৩ আগস্ট)”—এসবের অন্তরালে লক্ষ্য ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের অনন্ত বিস্তার—‘তাঁর মহান্‌ চরিত্রের, মহান জীবনের, তাঁর অনন্ত আত্মার।’ সংগঠন বিষয়ে দুটি জিনিস পাশ্চাত্যে তাঁকে আকর্ষণ করেছিল। একটি হল আজ্ঞাবহতা, অপরটি ঈর্ষার অভাব। একটি প্রতিষ্ঠানকে ক্রিয়াশীল করতে হলে চাই সদস্যদের পূর্ণ আনুগত্য ও আজ্ঞাবহতা। আনুগত্য অর্থে আত্মস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হওয়া বা পরাধীনতা নয়। স্বামীজী তাই জনৈক ভক্তকে ২মে ১৮৯৫ লিখছেন: “সকল বিষয়ে আজ্ঞাবহতা শিক্ষা কর;... গুরুজনদের অধীন হইয়া চলা ব্যতীত কখনই শক্তির কেন্দ্রীকরণ হইতে পারে না, আর এইরূপ বিচ্ছিন্ন শক্তিগুলিকে কেন্দ্রীভূত না করিলে কোন বড় কাজ হইতে পারে না।... ঈর্ষা ও অহংভাব তাড়াইয়া দাও—সংঘবদ্ধভাবে অপরের জন্য কাজ করিতে শিখ।” স্বামীজী কত গর্ব করে লিখছেন: “যে রামকৃষ্ণের ছেলে, সে আপনার ভাল চায় না।” সে প্রাণ দিয়েও পরের কল্যাণ আকাঙ্ক্ষা করে। চিঠির মধ্যেই তিনি অপূর্ব ভাবে যুগাবতারের আবাহন করছেন—“সব ভেসে যাবে—হুঁশিয়ার—তিনি আসছেন।” আজও অন্তরাত্মায় শিহরণ জাগিয়ে তোলে এই পত্র। সুতরাং সেদিনের ঘরছাড়া রামকৃষ্ণৈকশরণ বৈরাগীদের প্রাণে এই পত্র যে কোন প্রেরণার অগ্নি সংযোগ করেছিল তা আজ ভাবনার অতীত। এইসব ভাবপ্রবাহের সঙ্গে স্বামীজীর বাস্তব প্রজ্ঞা এবং ভাবী সঙ্ঘের নিরাপত্তার চিন্তা আমাদের বিস্মিত করে। কালের নিরিখে তাঁর প্রতিটি ভাবনা কত বাস্তবানুগ ছিল তা আজ একুশ শতকের আবর্তে পরীক্ষিত সত্য।