পারিবারিক সম্পত্তি বিভাজনে আইনি চাপ বাড়তে পারে। কাজকর্মে যোগাযোগের অভাবে বিঘ্ন। ... বিশদ
একুশের ভোটের আগে সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেছিলেন, বিজেপিই বামেদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। অধিকাংশ বামপন্থী নেতা সেটাই বিশ্বাস করেন। ব্যতিক্রম একমাত্র সিপিএম। তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূল। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যই চৌপাট হয়েছে তাদের ৩৪ বছরের সুখের রাজ্যপাট।
তাই তৃণমূলকে ‘শিক্ষা’ দিতে গত বিধানসভা নির্বাচনে আইএসএফের সঙ্গে জোট করেছিল সিপিএম। উদ্দেশ্য, সংখ্যালঘু ভোট ভাঙা। কিন্তু পারেনি। উল্টে নিজেরাই শূন্য হয়েছে। তা সত্ত্বেও মমতা বিরোধী লড়াইয়ে একটুও অরুচি জন্মায়নি। লোকসভা নির্বাচনেও আইএসএফকে সঙ্গী করতে চেয়েছিল। কিন্তু আসন নিয়ে বোঝাপড়া হয়নি। আইএসএফ জোট ছাড়ায় তৃণমূলের মুসলিম ভোটে থাবা বসাতে আরও মরিয়া হয়ে উঠেছে সিপিএম ও তার দোসর বঙ্গ কংগ্রেস।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এরাজ্যে বামেদের শুধু হাঁড়ির হাল করেননি, কংগ্রেসকেও সাইনবোর্ডে পরিণত করেছেন। তাই উভয় দলই ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ নীতি মেনে চলছে। একদা কংগ্রেস-সিপিএম সম্পর্কটা আদায় কাঁচকলায় হলেও এখন তারা ‘মিত্র’। উভয়েরই লক্ষ্য সংখ্যালঘু ভোট কেটে তৃণমূলকে দুর্বল করা।
বিধানসভা ভোটে যারা একটি আসনেও জিততে পারে না, তারা লোকসভা ভোটে দারুণ ফল করবে, এমনটা সম্ভবত বাম-কংগ্রেস জোটের অতি বড় সমর্থকও আশা করেন না। তবে জয়, পরাজয় যাই হোক, সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে লড়ে। কারণ নির্বাচনের মধ্যে দিয়েই যাচাই হয় রাজনৈতিক দলগুলির জনসমর্থন। তাই রাজ্যের সব আসনে কংগ্রেস-সিপিএম জোট প্রার্থী দেবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রহস্যটা লুকিয়ে আছে কিছু কেন্দ্রের প্রার্থী নির্বাচন ও তাঁদের কৌশলী প্রচারে।
কংগ্রেস-সিপিএম জোট বেশকিছু আসনে এমন প্রার্থী দিয়েছে যাতে বোঝা যাচ্ছে, তৃণমূলের ক্ষতি করাই তাদের উদ্দেশ্য। আর বাংলায় তৃণমূলের ক্ষতি হলে লাভ কার? বিজেপির। কারণ এরাজ্যে মূল লড়াই বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের। কংগ্রেস-সিপিএম জোট যত বেশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেছে এরাজ্যে বিজেপি ততই শক্তিশালী হয়েছে।
যে কোনও দেশে বা রাজ্যে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। বাংলায় সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই বিজেপির রোষানলে পড়েছেন মমতা। তাঁর গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘সংখ্যালঘু তোষণকারী’ তকমা। সেই কাজে বিজেপি কিছুটা সফলও হয়েছে। সিপিএম ও কংগ্রেসের সৌজন্যে বিজেপি এরাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। এবার সিপিএম ও কংগ্রেস নেতৃত্বের লক্ষ্য সংখ্যালঘু ভোট ভাঙা। সে কাজে সফল হলে বাংলায় তাদের ‘শূন্য’ করে দেওয়ার জ্বালা হয়তো কিছুটা মিটবে, কিন্তু লাভবান হবে কে? সেই বিজেপিই।
অধীর চৌধুরী বরাবর কট্টর মমতা বিরোধী। তিনি কখনওই তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে কংগ্রেস হাইকমান্ডের সখ্য পছন্দ করেন না। জাতীয়স্তরে মোদি বিরোধী জোট নিয়ে আলোচনার সময় কংগ্রেস হাইকমান্ড মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। এমনকী, বাংলায় এককভাবে লড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও হাইকমান্ড মমতার ব্যাপারে আগ্রহী। কিন্তু অধীরবাবু লাগাতার তৃণমূলকে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ তাঁর রাজনীতিতে টিকে থাকার একমাত্র শর্ত, মমতা বিরোধিতা। তাই তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেস হাত মেলাক, সেটা তিনি কখনওই চান না। তার উপর বহরমপুর কেন্দ্রে ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠানকে তৃণমূল প্রার্থী করায় অধীরবাবু তেলেবেগুনে জ্বলছেন। অধীরবাবুর সংখ্যালঘু ভোটে থাবা বসাবেন ইউসুফ। সম্ভবত সেই আশঙ্কাতেই তৃণমূলের জয়ের পথে কাঁটা ছড়াতে মরিয়া প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি।
অনেক অঙ্ক কষে মুর্শিদাবাদ আসনে প্রার্থী হয়েছেন মহম্মদ সেলিম। গতবার এখানে চতুর্থ স্থানে ছিল সিপিএম। তা সত্ত্বেও কংগ্রেস এই আসনটি সেলিম সাহেবকে ছেড়েছে। হাত শিবিরের আশা, সেলিম মুর্শিদাবাদে প্রার্থী হওয়ায় সংখ্যালঘু ভোট পেতে কংগ্রেসের সুবিধে হবে। তবে, সেই অঙ্ক মিলবে কি না, সেটা বোঝা যাবে ৪ জুন।
গতবার রায়গঞ্জে জিতেছিল বিজেপি। এবার এটা বিজেপির জন্য ‘টাফ সিট’। তাই সিটিং সাংসদ দেবশ্রী চৌধুরীকে এখানে প্রার্থী করেনি। তৃণমূল প্রার্থী করেছে বিজেপি থেকে আসা কৃষ্ণ কল্যাণীকে। কংগ্রেস প্রার্থী করেছে ২০২১ সালে ফরওয়ার্ড ব্লকের টিকিটে পরাজিত আলি ইমরান রমজকে(ভিক্টর)। তিনি বামফ্রন্টের প্রাক্তন মন্ত্রী হাফিজ আলি সাইরানির ভাইপো। অনেকেই বলছেন, তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোট কাটতেই কংগ্রেসের পোড়খাওয়া নেতার বদলে ভিক্টরকে প্রার্থী করা হয়েছে।
রায়গঞ্জ লোকসভার অন্তর্গত চাকুলিয়া, গোয়ালপোখর সংখ্যালঘু প্রভাবিত। এছাড়াও করণদিঘি ও ইসলামপুরে প্রচুর মুসলিম রয়েছেন। রায়গঞ্জ কেন্দ্রের তৃণমূল এবং বিজেপি দলের প্রার্থীরা হিন্দু। তাই কংগ্রেস বেশি প্রচার চালিয়েছে সংখ্যালঘু প্রভাবিত এলাকায়। উদ্দেশ্য, মুসলিম ভোট টানা। আর সেটা করতে পারলেই তৃণমূলের ক্ষতি। কিন্তু বেনিফিট? বিজেপির।
মালদহ উত্তর কেন্দ্রে জিতেছিলেন বিজেপির খগেন মুর্মু। এবারও খগেনবাবুই বিজেপির প্রার্থী। এই কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী পুলিসের আইজির চাকরি ছেড়ে আসা প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। কংগ্রেসের প্রার্থী মোস্তাক আহমেদ। এখানেও সেই একই অঙ্ক। সংখ্যালঘু ভোট ভাগ করা। কংগ্রেস সংখ্যালঘু ভোটে থাবা বসালে লাভ হবে কার? বিজেপির। দিল্লির ক্ষমতা দখলের দৌড়ে পিছিয়ে পড়বে কে? কংগ্রেস। তা সত্ত্বেও তৃণমূলকে আটকাতে মরিয়া বঙ্গ কংগ্রেস। কারণ এখানে বিজেপি নয়, কংগ্রেসের টার্গেট মমতা।
গতবার বোলপুরের চেয়ে বীরভূম কেন্দ্রে তৃণমূলের জয়ের মার্জিন কম ছিল। অনুব্রত মণ্ডল জেলবন্দি। তাই বীরভূমের দু’টি আসনের দিকে নজর ছিল বিজেপির। তারমধ্যে এক নম্বরে বীরভূম কেন্দ্র। গতবার এই কেন্দ্রের দুবরাজপুর, সাঁইথিয়া, সিউড়ি ও রামপুরহাট এলাকায় এগিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু সংখ্যালঘু প্রভাবিত হাসন, নলহাটি এবং মুরারইয়ে তৃণমূলের ভালো লিডের জোরে জিতে যান শতাব্দী রায়। এখানেও সংখ্যালঘু ভোট জোট কিছুটা কব্জা করতে পারলেই তৃণমূল চাপে পড়বে। আর তাতে সুবিধা সেই বিজেপিরই। তাতে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ক্ষতি হবে জোট ‘ইন্ডিয়া’র। সেই জোটের নেতা কে? কংগ্রেস।
বেশ কিছুদিন ধরেই বঙ্গ বিজেপি আওয়াজ তুলছে, ‘নো ভোট টু মমতা’। কংগ্রেস ও সিপিএম নেতৃত্ব প্রকাশ্যে সেই সুরে সুর মেলায়নি, কিন্তু তলে তলে সেই কাজই করে যাচ্ছে। উনিশ থেকে শুরু হয়েছে বামের ভোট রামে পাঠানো। ভোট শিফ্টিং করিয়েও মমতাকে টলানো যায়নি। তাই এখন যে কোনওমূল্যে তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক ভাঙতে চাইছে। এই কাজে তাদের উৎসাহ জুগিয়েছে পঞ্চায়েত ভোটের ফল। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে কংগ্রেস-সিপিএম জোট কিছু এলাকায় সাফল্য পেয়েছে। কিছু পঞ্চায়েত দখলও করেছে। তারমধ্যে কয়েকটি সংখ্যালঘু এলাকায়। সেই অঙ্কেই লোকসভা ভোটে বুক বাঁধছে জোট নেতৃত্ব।
লোকসভা নির্বাচন শুরু হতেই প্রধানমন্ত্রীর খোলস ছেড়ে মোদি হয়ে উঠেছেন বিজেপি নেতা। বিভাজনের ভিত মজবুত করতে তিনি সরাসরি মুসলিম সম্প্রদায়কে আক্রমণ করছেন। আর তাতেই সংখ্যালঘুদের কাছে এটা হয়ে গিয়েছে ‘মোদি, অর নো ভোট টু মোদি’র নির্বাচন। এটা ব্যক্তিগত ঝাল মেটানোর কোনও নির্বাচন নয়। তাই পঞ্চায়েতের জের টেনে লোকসভা ভোটের অঙ্ক কষলে, তা মিলবে না কিছুতেই।
সিপিএম এবং কংগ্রেস জোট যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দুর্বল করতে মরিয়া তখন হাত গুটিয়ে বসে নেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘও। তারা রীতিমতো লিফলেট ছড়িয়ে প্রচার করছে, ‘আঞ্চলিক দলকে সমর্থনের অর্থ, ভোট নষ্ট করা।’ উদ্দেশ্য স্পষ্ট, তৃণমূলকে বাদ দিয়ে ভোট দাও অন্যদের। এর অর্থ, ‘নো ভোট টু মমতা’ ইস্যুতে বাংলায় আরএসএস, সিপিএম-কংগ্রেস মিলেমিশে একাকার। এই জন্যই বলে, সব শেয়ালের এক রা।