বর, অভয়, অসি ও মুণ্ড মায়ের চারিহাতে। উহাদের রহস্য আর কিছুই নহে—ইহারা উপায় চতুষ্টয়-সাম, দান, ভেদ ও দণ্ডের প্রতীক। বর শোভিত একটি বাহু সামের, অভয় শোভিত অপরটি দানের, অসি শোভিত বাহুটি ভেদনীতির ও মুণ্ডধৃত অন্য বাহুটি দণ্ডদানেরই চিহ্ন স্বরূপ। উক্ত উপায় চতুষ্টয় জননী তাঁহার বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিপালন করেন ও শাসন করেন প্রিয় বচনে। ইহাই সামনীতি। দিব্যবাক্ বেদবাণী মায়ের প্রিয়বাণী—যাহা অপৌরুষেয়, অভ্রান্ত সত্য, প্রিয় ও হিত স্বরূপ, যাহা ধর্ম্মাধর্ম্ম কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য নির্ণয়ের একক প্রমাণ ও সর্ব্বকালে একরূপ। সেই অমিয় মধুর মাতৃবাণীর যাঁহারা অনুরাগী তাঁহারা মায়ের আজ্ঞাবহ প্রিয় পুত্র। তাঁহারাই মাতৃকরুণার চির অধিকারী। স্নেহময়ীর বেদমহত্ত্বে ভরপুর হইয়া উঠে ইঁহাদের হৃদয়। বেদময়ীর বেদধ্যানে নিত্য-নিরত-জনগণ পায় নিত্যনূতন প্রেরণা, সুতরাং নিত্যনূতন দিব্যভাবের উদ্দীপন হয় ইঁহাদের। বেদ শাসনে শাসিত বেদের সুউচ্চ ধারণায় ভাবিত পুত্র ক্রমে বেদময়, জ্ঞানময়, যজ্ঞময় ও দানময় হইয়া যায়। স্নেহময়ীর স্নেহ-ভাণ্ডার অনন্ত। নিত্যদানে নিত্য যজ্ঞবিতানেও তাই অফুরন্ত। কি জ্ঞান ভাণ্ডার কি ধন ভাণ্ডার এক কথায় সর্ব্বভাণ্ডার মায়ের আজ্ঞাবাহী প্রিয় পুত্রের নিমিত্ত চির উন্মুক্ত। নিত্য বরদানে মুক্তহস্তা মা কেবল তাঁহারই প্রতি। মা বলেন—“বৎস যত চাও তত নাও বাধা নাই, তোমারই নিমিত্ত সযত্নে রক্ষিত হইয়াই রহিয়াছে সব কিছু”। ঐ যে বর দানে মুক্তহস্ত ইহাতে ঐ ভাবেরই ব্যঞ্জনা।
যাঁহারা মাতৃমহত্ত্বে বিশ্বাসী তাঁহারা ভক্ত, জগতে তাঁহারা মায়ের একান্ত অনুরক্ত। তাঁহারা মাকে জানেন সারাৎসারা। মা ধ্যান, মা জ্ঞান; মা ভিন্ন আর কিছুই জানেন না। ভক্তবৎসলা বা বৎসলা গাভীর মত তাঁহাদেরই পশ্চাদ হন ধাবমানা। ধাবিতা জননী প্রতি পাদ বিক্ষেপে হন রক্ষিণী; রক্ষা করেন পুত্রে সর্ব্বক্ষেত্রে ক্ষেত্রপালিকা কালিকারূপে। কর্ম্ম-অকর্ম্ম-বিকর্ম্ম-গহন বিচিত্র বন্ধুর দূর হইতেও দূর ঐ অজানার পথে ভীত সন্ত্রস্ত পুত্র পায় গভীর সান্ত্বনা মায়ের ভৈরব রবে। ভৈরবীর মাভৈঃ রবে অজানার পথে ব্যতিব্যস্ত পুত্র পায় শান্তির নিশ্বাস, শান্তমনা হয় আশ্বস্ত, ক্রমে সুস্থ ও প্রকৃতিস্থ। অভয়ার অভয় হস্ত অভয় দানে ঐ যে নিত্য উদ্যত। অভয় দানে অভয়া চির নির্ভয়া। ভয় করিবার মত মায়ের নিকট এমন কি আছে! কর্ম্মগহন ভবিষ্যতের অচিন পথে মা যে চিরজাগ্রতা, পুত্র রক্ষণে চির দণদায়মানা। অতএব অভয়বরপ্রাপ্ত স্নেহময়ীর বরপুত্র আজ সর্ব্বত্র অকুতোভয়। অভয় করের মুক্ত আশীষ তাঁহারই শিরে অজস্র বর্ষিত। বারিতভয়া মা তাই অভয়া।
মাতৃদ্বেষী বিষয় বিলাসী উদ্দাম ভোগলালসায় থাকে নিরন্তর আসক্ত। মাতৃবিমুখ মায়ের এতটুকুও অপেক্ষা রাখেনা। কাজেই এমতাবস্থায় ভোগমদিরামত্ত জীব সর্ব্ববিষয়ে উন্মত্তের ন্যায় স্বেচ্ছাচারে হয় প্রবৃত্ত।
শ্রীমৎ অদ্বৈতানন্দ পুরীর ‘শ্রীশ্রী দশমহাবিদ্যা’ থেকে