বিদ্যায় সাফল্য ও হতাশা দুই-ই বর্তমান। নতুন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠবে। মামলা-মোকদ্দমার কোনও পরিবেশ তৈরি ... বিশদ
মথুরাপুর স্টেশন থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার ভিতরে অবস্থিত এই আটেশ্বরতলা। বলতে গেলে একেবারে সুন্দরবনের গহীন অরণ্যের ধারে। এখন স্টেশন থেকে যাওয়ার জন্য অটো পাওয়া যায়। কিন্তু বছর সাতেক আগেও যথেষ্ট দুর্গম ছিল এইসব অঞ্চল। এলাকার লোকজনদের মুখে শুনলাম ডাকাতের উপদ্রবও ছিল এই রাস্তার নির্দিষ্ট একটা অংশে। আর এখানেই প্রতিবছর রমরম করে অনুষ্ঠিত হয় আটেশ্বরতলা নাট্যোৎসব। আয়োজন করে আটেশ্বরতলা সাংস্কৃতিক মঞ্চ।
শুরুটা হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। তখন দেশে জরুরি অবস্থা চলছে। আটেশ্বরতলা তখন সব অর্থেই পিছিয়ে পড়া, দারিদ্রে ভরা একটা প্রত্যন্ত গ্রাম। এলাকার মাস্টারমশাই সহদেব নস্করের উদ্যোগে কিছু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ একত্রিত হয়েছিলেন মরমী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম শতবর্ষ পালন করতে। মঞ্চস্থ হয়েছিল নাটক রামের সুমতি। বাজেট ছিল মোটে ৩০০ টাকা। বাড়ির তক্তোপোষ, মা-কাকিমাদের শাড়ি, বিছানার চাদর, পাটের দড়ি ইত্যাদি তৈরি হয়েছিল মঞ্চ। আলোর জন্য ছিল হ্যারিকেন। সেই থেকে আজও চলছে। যথারীতি কলেবর বেড়েছে। এখন বাংলার বিভিন্ন জেলার নাট্যদলগুলি মুখিয়ে থাকে এই নাট্যোৎসবে আমন্ত্রণ পাওয়ার জন্য। যদিও আটেশ্বরতলা সাংস্কৃতিক মঞ্চের সেই সামর্থ এখনও হয়নি যে তাঁরা অংশগ্রহণকারী দলগুলিকে মোটা দক্ষিণা দেবেন। এমনকী চা-বিস্কুট আর ভাত-ডাল ছাড়া তাঁরা থিয়েটার দলগুলিকে বিশেষ কিছু দিয়ে আপ্যায়নও করতে পারেন না। কষ্ট করে যাওয়া-আসা বাবদ সামান্য কিছু অর্থ দিতে পারেন যা কোনওভাবেই আজকের দিনে যথেষ্ট নয়। তবুও কিন্তু নাটকের দলগুলি মুখিয়ে থাকে এখানে আসার জন্য। কেন? তার কারণ এখানকার দর্শক। আর সংগঠকদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর নাটকের প্রতি তাঁদের আগ্রহ।
প্রতিবছর নাট্যোৎসবে এখানে কমপক্ষে ৫-৬ হাজার দর্শক হয়। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন সংখ্যাটা। উন্মুক্ত প্রান্তরে প্রায় ছুঁচ পড়লে শোনা যাবে এমন নিস্তব্ধ হয়ে প্রতিটি নাটক উপভোগ করেন দর্শক। আটেশ্বরতলার এ এক ঐতিহ্য। এই উৎসবের এমনই টান যে বিয়ে হয়ে অন্য গ্রামে বা জেলায় চলে যাওয়া মেয়েরাও স্বামী-সন্তানসহ এই ক’টা দিনের জন্য চলে আসেন বাপেরবাড়ি। চতুর্দিকে একটা মেলার আবহ। খাবার-দাবারের স্টল, আলোকিত মঞ্চ, দর্শকের ভিড়, হইহই—ঠিক যেন দুর্গাপুজো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় নাটক শুরু হলেই পিন পতনের নিস্তব্ধতা তৈরি হয়। না, এর জন্য কোনও স্বেচ্ছ্বাসেবকের প্রয়োজন হয় না। দর্শক নিজেরাই নিজেদের শাসন করেন। উৎসবের বাজেট বাড়তে বাড়তে এখন দেড় লক্ষ টাকায় দাঁড়িয়েছে। পুরো অর্থটাই আসে মানুষের দান থেকে। টিকিটের কোনও ব্যবস্থা নেই এই উৎসবে। তক্তপোষের মঞ্চ এখন পাকা স্টেজ। চেয়ে চিন্তে মঞ্চটাকে পাকা করার ব্যবস্থা করেছেন উদ্যোক্তরা। স্থানীয় কৃষক সব্যসাচী বৈদ্য ও দীননাথ বৈদ্য তাঁদের জমির থেকে তিন শতক দান করেছেন স্থায়ী মঞ্চ তৈরির জন্য। মথুরাপুর ব্লক থেকে সরকারি সাহায্য পেয়েছে ৪ লক্ষ টাকা এবং রাধাকান্তপুর পঞ্চায়েত থেকে দেওয়া হয়েছে ২ লক্ষ টাকা। কিন্তু মঞ্চ নির্মাণে এখনও পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২৫ লক্ষ টাকা যার মধ্যে আড়াই লক্ষ টাকা এখনও ঋণ হিসেবে রয়ে গিয়েছে। বাকি টাকা এসেছে মানুষের চাঁদা থেকে বলে জানালেন গুণসিন্ধু হালদার, রাধারমণ হালদার গঙ্গাগোবিন্দ গায়েন ও কমলকুমার রায়। এঁরাই এখন সাংস্কৃতিক মঞ্চের কর্তাব্যক্তি। তবে তা সত্ত্বেও মঞ্চটি এখনও পর্যন্ত পুরোপুরি শেষ করে ওঠা যায়নি। প্রয়োজন আরও অর্থের। সে অর্থও আসবে মানুষের ভালোবাসার দানে বলে জানালেন সংগঠকরা।
কতগুলি দল অভিনয় করে এখানে প্রতিবছর? উত্তরে যা জানলাম তা অবাক করে দেওয়ার মতো। গত বছর ২৭টি দল নাটক করে গিয়েছে। ২০১৬ সালে সর্বাধিক ৩৯টি দল অংশ নিয়েছিল এই উৎসবে। যদিও সব নাটকই একাঙ্ক। তা হলেও এমন একটি নাট্যোৎসব বাংলাব বুকে অভিনব তো বটেই।
স্বস্তিনাথ শাস্ত্রী