সমৃদ্ধ দত্ত, নয়াদিল্লি, ২২ ফেব্রুয়ারি: রাষ্ট্রসঙ্ঘ থেকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস প্রতিরোধী সংস্থা। পাকিস্তান তো বটেই, তার থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ হল পাকিস্তানের সমর্থক রাষ্ট্র হিসাবে চীনও কোণঠাসা হয়ে পড়ছে বিশ্বমঞ্চগুলিতে। গতকাল রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার নিন্দা করেছে। এবং চীনের প্রবল আপত্তি অগ্রাহ্য করেই ওই নিন্দাপ্রস্তাব তথা বিবৃতিতে জয়েশ-ই-মহম্মদের নাম করে তাদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আখ্যা দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের ‘পি ফাইভ’ দেশগুলির মধ্যে চীন ছাড়া বাকি চার সদস্যই এই বিষয়ে একমত দেখে, বাধ্য হয়ে একঘরে বেজিং জয়েশের নিন্দাপ্রস্তাব সম্বলিত কঠোর বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। আবার অন্যদিকে বিশ্বের সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির আর্থিক জোগান কোথা থেকে আসছে সেটা নজরদারির জন্য আন্তর্জাতিক যেসব গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী সংস্থা রয়েছে, সেই ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফ এ টি এফ) পাকিস্তানকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে। প্যারিসে আয়োজিত ওই সংস্থার প্লেনারি মিটিং-এ প্রস্তাব গ্রহণ করে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, পাকিস্তান এখনও জয়েশ-ই-মহম্মদ, জামাত উদ দাওয়া, ও লস্কর ই তইবার মতো জঙ্গি সংগঠনগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ। এমনকী ওই বিবৃতিতে এইসব সংগঠনের সঙ্গে তালিবানের যোগসূত্রের কথাও উল্লিখিত হয়েছে। বলা হয়েছে, এখনও পাকিস্তান সন্ত্রাসের বিপদ উপলব্ধি করতে পারছে না। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় যে মারাত্মক হামলা হয়েছে সেরকম জঙ্গি আক্রমণ অগাধ টাকার যোগান ছাড়া সংঘটিত করা সম্ভব নয়। এই সংস্থা আগেই পাকিস্তানকে গ্রে লিস্টে তালিকাভুক্ত করেছে। এবার আরও এক ধাপ এগিয়ে ‘ব্ল্যাক লিস্টে’ পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, আগামী তিন মাসের মধ্যে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেখাতে হবে। যদি পাকিস্তান ব্যর্থ হয়, তাহলে অক্টোবর মাসে রিভিউ মিটিং-এ পাকিস্তানকে ‘ব্ল্যাক লিস্ট’ করা হবে। উল্লেখ্য, গত বছর মে মাসে পাকিস্তান ‘গ্রে লিস্টে’ অন্তর্ভুক্ত হয়। গ্রে লিস্টে থাকার কারণে পাকিস্তান বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে অনেক আর্থিক সহায়তা ও ঋণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর একবার ‘ব্ল্যাক লিস্টেড’ হয়ে যাওয়ার অর্থ হল পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক লড়াইয়ে ‘অসহযোগী রাষ্ট্র’ হিসাবে তকমা দেওয়া হবে। আর সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) বিশ্বব্যাঙ্ক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (এডিবি) ইত্যাদি অর্থঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলির কাছে পাকিস্তান হয়ে যেতে পারে ‘ডাউনগ্রেডেড’। আর তখন কোনও আন্তর্জাতিক সংগঠনই কিংবা আর্থিক সংস্থাই পাকিস্তানকে ঋণ দেবে না। বিপুল অর্থনৈতিক অবরোধের সম্মুখীন হতে হবে পাকিস্তানকে।
এদিকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় জয়েশ-ই-মহম্মদের ওই ভয়ঙ্করতম হামলা হলেও কেন রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ওই ঘটনার নিন্দা করে কড়া বিবৃতি জারি করতে এতটা দেরি হল, এই প্রশ্ন উঠেছে। আজ জানা যাচ্ছে দেরির কারণ। আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন, রাশিয়া এই চার স্থায়ী সদস্য রাজি হলেও চীন কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না জয়েশ-ই-মহম্মদের নাম করে নিন্দা বিবৃতি জারি করতে। প্রাণপণে চীন চেষ্টা করে যাচ্ছিল যেভাবেই হোক বিবৃতিতে সন্ত্রাসবাদ কথাটি থাকলেও জয়েশকে যেন সরাসরি চিহ্নিত করা না হয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য এবং ১০ অস্থায়ী সদস্যের মধ্যে সিংহভাগই জয়েশকে দায়ী করার পক্ষে দাঁড়ায়। ফলে বছরের পর বছর ধরে লাগাতার জয়েশকে নিরাপত্তা পরিষদের কালো তালিকাভুক্ত হতে না দেওয়া চীন সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে যায়। শেষ মরিয়া প্রয়াস হিসাবে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি স্বয়ং রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করেন। চীনের চাপ এবং ওই ব্যক্তিগত বৈঠকেও কোনও লাভ হয়নি। নরম হয়নি রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ। গতকাল তারা ঘোষণা করেছে এই আক্রমণের জন্য জয়েশ দায়ী। এভাবে সরাসরি জয়েশের নাম নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিতে স্থান করে নেওয়ায় চীন যথেষ্ট বিব্রত হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। আর তাই আজ বেজিং ওই বিবৃতিকে হালকা প্রতিপন্ন করতে বলেছে যেভাবে দেখানো হচ্ছে বিষয়টি এতটা তাৎপর্যপূর্ণ নয়। জয়েশ-ই-মহম্মদের নাম সাধারণ রেফারেন্স হিসাবেই ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিতে শুধু নিন্দাই স্থান পায়নি। সেখানে গোটা বিশ্বকে আহ্বান করা হয়েছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে ভারতের পাশে দাঁড়াতে।