অনুপ চট্টোপাধ্যায়, শিলিগুড়ি: শহরের অবাঙালিদের ভোট কি এবার শিলিগুড়ি বিধানসভার ভাগ্য নির্ণয় করবে? তাতে কে লাভবান হবে, বিজেপি না সিপিএম। নাকি রাজ্যের শাসক দল? ভোটের মুখে এই চর্চাই চলছে শিলিগুড়ি শহর জুড়ে। আর সেই হিসেব কষতেই ব্যস্ত বিজেপি, সিপিএম। তবে তৃণমূল নেতৃত্বও বসে নেই। তাদের বক্তব্য, রাজ্য জুড়ে শান্তিতে বসবাস, সুষ্ঠ ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। বাম আমলে কথায় কথায় বন্ধ-হরতালের রাজনীতিতে বিরক্ত ছিল রাজ্যের ব্যবসায়ী, শিল্পমহল। যাঁদের অধিকাংশই অবাঙালি। এখন তাঁরা নিশ্চিন্তে ব্যবসা করছেন। তাই শাসক দলের বিশ্বাস, অবাঙালি শিল্পমহলের পাশাপাশি এখানে বসবাসকারী ভিন রাজ্যের বাসিন্দাদের সমর্থন তারাই পাবে। শিলিগুড়ি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটারের সংখ্যা প্রায় সোয়া দু’লক্ষ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে অবাঙালি ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৪২ হাজার। অর্থাৎ মোট ভোটারের ২০-২২ শতাংশ। ওই সংখ্যাটা একটা বিধানসভার ফলাফল ওলটপালট করার পক্ষে যথেষ্ট। গত লোকসভা নির্বাচনে শিলিগুড়ি তো বটেই, পুরো উত্তরবঙ্গ জুড়ে গেরুয়া শিবির আধিপত্য বিস্তার করেছিল। সেবার অবাঙালি ভোট তাদের ঝুলিতেই পড়েছিল। বলছেন, বিজেপির শিলিগুড়ি সাংগঠনিক জেলার মুখপাত্র কমল ঘোষ। তাঁর বক্তব্য, মাড়োয়ারিদের কথা বলতে পারব না। তবে গুজরাটি, বিহারীদের ভোটও পেয়েছি। বামজোটে আসা আব্বাস সিদ্দিকীদের কেউ পছন্দ করছে না। তাই বিধানসভা নির্বাচনে তারই প্রতিফলন হবে বলে বিশ্বাস ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানধারীদের। অন্যদিকে, শিলিগুড়ির বিধায়ক তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অশোক ভট্টাচার্য বামফ্রন্টের মন্ত্রী থাকাকালীন অবাঙালিদের কাছের মানুষ ছিলেন। শিলিগুড়ি শহর সহ বাংলা জুড়েই বহু অবাঙালি ব্যবসায়ী তৎকালীন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী অশোকবাবুর কাছে কমবেশি উপকৃত হয়েছেন। সে কারণে একসময় তাঁকে অশোক ‘আগরওয়াল’ বলেও বিরোধীরা কটাক্ষ করত। তাঁর মন্ত্র্বিত্ব কালে শিলিগুড়ি শহরে অবাঙালি মালিকানায় একাধিক বড় প্রকল্প গড়ে উঠেছে। তাই এই শহরের অবাঙালিদের অনেকেই এখনও অশোকবাবুকে ‘কাছের লোক’ বলে মনে করে,দাবি বামেদের। তাছাড়া অশোকবাবু এখন শিলিগুড়ি কর্পোরেশনে প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যানও। অর্থাৎ শহর উন্নয়নে, কর্পোরেশনে ক্ষমতার মাথায় তিনিই। তৃণমূল সরকারের আমলেও যা তাঁকে ভোট টানার বাড়তি শক্তি দিচ্ছে। উত্তরবঙ্গের বাণিজ্যনগরী শিলিগুড়িতে তাই অবাঙালি ভোট নিয়ে অনেকটাই নিশ্চিন্ত তিনি। তাঁর কথায়, শিলিগুড়ি ব্যবসার কেন্দ্র। মন্ত্রী থাকাকালীন বহু অবাঙালি ব্যবসায়ী পিপিপি মডেলে অর্থলগ্নী করে সুফল পেয়েছেন। তাঁরা এখনও বামেদের পক্ষেই রয়েছেন বলেই অশোকবাবুর বিশ্বাস। ২০১৬তে তাঁর জেতার পেছনে ওই ভোটও ছিল।
তবে অবাঙালিদের ভোটের ভাগীদার বিজেপি এই তত্ত্ব মানতে নারাজ তৃণমূলের দার্জিলিং সমতলের সভাপতি রঞ্জন সরকার। তাঁর বক্তব্য, ২০০৯ সালের পর থেকে রাজ্যে বেশ কয়েকটি নির্বাচন হয়েছে। সে সবের ফল দেখলেই বোঝা যাবে রাজ্য সরকার নির্বাচনে অবাঙালি ভোট তৃণমূলের পাশেই ছিল, রয়েছে। এবার বিজেপির লম্ফঝম্ফ দেখে কেউ কেউ ভাবতেই পারেন গেরুয়া শিবিরের দিকে অবাঙালিদের টান বেশি। বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আসলে সেটা যে ভুল ধারণা, তা ইতিমধ্যেই পরীক্ষিত। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে অবাঙালিদের এলাকা বলে পরিচিত রাজ্যের বহু আসনে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। শিলিগুড়ির সিআইআই-য়ের এক সদস্যের কথায়, লোকসভা ভোটের সঙ্গে রাজ্যের সরকার গঠনের ভোটকে এক করে দেখি না। তাই লোকসভার ভোটের প্রতিফলন বিধানসভাতেও হবে এমনটা মনে করি না। শিলিগুড়ির জৈন মহিলা সমিতির এক সদস্যার কথায়, জানি না এবার কারা প্রার্থী হবেন।
তবে বর্তমান বিধায়ক অশোকবাবু শিলিগুড়িতে অবাঙালিদের একটা নিরাপত্তা দিয়েছেন। সেটা আমাদের মাথায় আছে। অন্যদিকে, লোকসভা ভোটে বিজেপি জিতলেও রাজ্যে এখনও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনও কাজ তারা দেখাতে পারেনি। উল্টে রান্নার গ্যাস, ডিজেল, পেট্রলের দাম হু হু করে বাড়ছে। ভোটের আগে স্বস্তিতে নেই অনেকেই। তার প্রভাব তো পড়বেই।