শারীরিক কারণে কর্মে বাধা দেখা দেবে। সন্তানরা আপনার কথা মেনে না চলায় মন ভারাক্রান্ত হবে। ... বিশদ
পারিবারিক শ্রম ভাগ করে নেওয়া যে নারীর শ্রমের মর্যাদা ও মূল্যায়নের মধ্যে পড়ে, সে তত্ত্ব তখনও বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে আসেনি। এখনও পুরুষের গৃহকর্মে সঙ্গী হওয়া অতি বিরল ঘটনা। বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম এ বিষয়ে কিছুটা পথ দেখিয়েছে। গত এক শতাব্দীতে পড়াশোনা শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ানো, অফিসে নিজের জায়গার জন্য লড়াই করা মেয়েদের জন্য ঘরের জমি এখনও সমান হয়নি। বাড়ির কাজের মূল্যায়ন হয় না, টাকাতেও না, কথাতেও না। বাড়ির কাজের ভাগও হয় না। এক বছর টানা লকডাউনের পর এবার নারীদিবসের দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়েদের মুখগুলি ভালো করে দেখি। গত বছর গৃহ শ্রমিক মহিলাদের আসা বন্ধ হয়েছিল লকডাউনের কারণে, তাই পুরুষরা অনেকেই ঘরের কাজে হাত বাড়িয়েছিলেন। তাই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসি মস্করার তুফান উঠেছিল। পুরুষের সব্জি কাটা, বাসন ধোওয়া নিয়ে কত রঙ্গ তামাশা। যেন সত্যিই দাসত্বের দরজায় দাঁড়িয়ে পুরুষতন্ত্র। এমনই এক মস্করার দৃষ্টান্ত— ‘বউ আমাকে বাসন মাজতে বলেছে, বকেছে, মেরেছে। আমি মার খেয়েছি কিন্তু বাসন মাজিনি।’ ‘কেন রে?’ বন্ধু জানতে চায়। ‘কারণ,লকডাউন শেষ হবে, কিন্তু আমার ঘাড়ে ঘরের কাজ চাপলে আর নামবে না।’ শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত পুরুষ গ্রুপের হোয়াটসঅ্যাপে হো হো হা হা হাসির ইমোজি। যা আমাদের হাসির উদ্রেক করে না, তা হল, বিশ্বজোড়া মহামারী আসার আগেও এবং পরেও, ঘরের কাজ মেয়েদেরই ছিল। এবং তা ভাগ হয় কেবল আরও দুর্বল, কম মজুরি পাওয়া প্রান্তিক মেয়েদের সঙ্গেই। এই সব মেয়েরা অধিকাংশই কাজ হারিয়েছেন লকডাউনে। আমাদের মধ্য ও উচ্চবিত্ত সমাজের একটা বড় অংশ যাঁরা স্মার্ট আইফোনের মডেল বদলান চক্ষের পলকে, আর রেস্তরাঁয় খেয়ে এক সন্ধেয় উড়িয়ে দেন এদের এক মাসের মাইনে, তারা মার্চ মাসের পর একটি পয়সাও ঠেকাননি। কাজে ফিরে আসার পর স্যানিটাইজার ব্যবহার থেকে লিফ্টের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার পর্যন্ত নানা বাধা নিষেধ আরোপিত হয়েছে এদের উপর। হাউজিং সোসাইটির কর্তা ব্যক্তিরা অনেকেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পল্লীসমাজ’-এর চেয়েও অকরুণ। এই সব মেয়েদের স্বামী-সন্তান-ভাইয়েরা অনেকেই কাজ হারিয়েছে। সংসারের জোয়াল টানতে টানতে এদের কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গিয়েছে, পাঁজর দেখা যাচ্ছে। রেশনের চাল আর আলু, সপ্তাহে একদিন ডাল, এই দিয়ে টেনেছে একটা বছর। কর্মহীন এদের পুরুষরা তাই বলে ঘরের কাজ ভাগ করে নেয়নি। দোকান বাজার করে দিলেও তাদের সময় গিয়েছে দিশি মদ, তাস অথবা পড়ে পড়ে ঘুমনোর মতো উপাদেয় কাজে।
গার্হস্থ্য হিংসা বেড়েছে। এক কামরার ঘরে সারা দিন পুরুষ মানুষটি অধিষ্ঠান করলে যা হয়। পুলিশের ১০০ নম্বরে ফোন কিন্তু মধ্য ও উচ্চবিত্তর ফ্ল্যাটবাড়ি থেকেও গিয়েছে। বেড়েছে কর্মহীনদের আত্মহত্যার প্রবণতা, রোগীর অযত্ন, মানসিক ও শারীরিক নিগ্রহ। মেয়েদের উপর চাপ সৃষ্টি করে এই সমস্ত গার্হস্থ্য পরিস্থিতি এবং তার উপর ঘরের কাজ, সন্তানের যত্ন পড়াশোনা। ঘরে থেকে স্কুলে যেতে না পারা সন্তানের সমস্যার গতি প্রকৃতিও আলাদা। এবছর নারীদিবসে তাই ঘরের কাজের ভাগ, মেয়েদের কাজের মর্যাদা দেওয়া এবং পুরুষের গৃহকর্ম নিপুণতা নিয়ে গর্ব করার প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হোক। এখন যে সব মা বাবা অভিভাবকরা শিশু সন্তানের লালন পালনে ব্যস্ত তাঁরা কন্যা সন্তানের সমানাধিকারের কথা এখন থেকে ভাবুন। নারীর রক্ষক না হয়ে পুত্র সন্তানটি যেন হয় সচেতনভাবে দায়িত্বশীল, মাংসপেশীর চেয়ে চিত্তবৃত্তি ও বুদ্ধির চর্চা যে বেশি জরুরি, বাবা মায়ের সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষিকারাও বলুন। গোয়েবলসীয় তত্ত্ব অনুযায়ী একই সত্য সকলে মিলে বার বার বললে তা অন্তরে প্রবেশ করবেই।
এবারের নারী দিবসে অবশ্য রাষ্ট্রসংঘের তরফে বিষয় রাখা হয়েছে— ক্ষমতার নেতৃত্বে যে মেয়েরা আছেন, তাঁদের জন্য সমানাধিকার। এখানেও পরিস্থিতি ভালো নয়। ২২ শতাংশ মহিলা রাজ্য বা রাষ্ট্রপ্রধান। আর এ দেশের সাংসদদের মাত্র ২৫ শতাংশ মহিলা। এভাবে এগলে ক্ষমতার সাম্য আসতে আরও ১৩০ বছর। সারা পৃথিবী জুড়ে কোভিডের সংক্রমণ রুখতে লড়াই করেছে মেয়েরা, আক্রান্ত হয়েছে অথচ তাদের বেতন গড়ে এগারো শতাংশ কম পুরুষদের তুলনায়। কোভিডের পর সমানাধিকার পৃথিবী গড়ে তুলতে এই কর্মী ও নেত্রী মেয়েদের উপর জোর এবার। আমি একটু পিছিয়ে গিয়ে এদের ঘরের পরিসরের কথা ভাবছি। নারী-পুরুষ দু’জনের চেষ্টা না মিললে ঘর বদলাবে না। এখানে বদল আনতে গেলে পুরুষের আচরণ, মনোভাব ও অভ্যাসের বদল জরুরি। মনে পড়ে, কয়েক বছর আগে কলকাতায় একটি সেমিনার হচ্ছিল, হিংসার বিরুদ্ধে মেয়েদের লেখালিখি নিয়ে। শেষে একজন পুরুষ শ্রোতা সমাজকর্মী নারীবাদী কমলা ভাসিনকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমার মতো পুরুষদের আপনি কি উপদেশ দেবেন?’ কমলা ভাসিন বলেছিলেন, ‘আপনারা একটু কোমল হোন, নরম হোন, শিশুদের যত্ন নিতে শিখুন, বয়স্ক ও রোগীদের সেবা করুন, পশুপাখির যত্ন করুন।’ ‘মাচো পুরুষ’ ঢের হয়েছে। অন্যের শরীরে দখলদারি করে না, হিংস্রতার বলে আঘাত করে না, আমাদের তেমন পুরুষ চাই। এর সঙ্গে আমি জুড়ব, ঘরের কাজ করুন, রান্নাবান্না, বাসন মাজা শিশুপালন— তবে আপনারা নারীর সমান হবেন। নারীর কাজকে মূল্য দিন, তবেই সাম্য আসবে, যা নারীদিবসের কাঙ্খিত, কিন্তু যার প্রস্তুতি চলবে সারা বছর এবং সারা জীবন ধরে।
ছবি: আবির ঘোষ ও সিদ্ধার্থ কর