শারীরিক কারণে কর্মে বাধা দেখা দেবে। সন্তানরা আপনার কথা মেনে না চলায় মন ভারাক্রান্ত হবে। ... বিশদ
গণতন্ত্রে নির্বাচন আসবে যাবে। জয় পরাজয়ও যথারীতি থাকবে। কিন্তু সেই শক্তিকেই জয়ী করতে হবে যারা বাংলাকে চেনে, বাংলার মাটির ঘ্রাণ যাদের শিরায় উপশিরায় রক্তে। অচেনা বহিরাগতদের মিথ্যে ঢং আর ভড়ং-এ ভুললে সর্বনাশ। এই ক্ষমতা দখলের খেলা যেন জাতির বুকে চিরস্থায়ী অভিশাপ হয়ে না দাঁড়ায়। গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেই কায়েমি নীচ স্বার্থ হাসিল করতে হয়। আর তা ত্বরান্বিত করতে ইতিহাসের সেই অভিশপ্ত সন্ধিক্ষণেই মাতৃজঠর থেকে জন্ম হয় মীরজাফরদের। দমবন্ধ ত্রিবেদী, সেচ হারানো বন্দ্যোপাধ্যায়, কিছুই না পাওয়া বঞ্চিত অধিকারীদের! মুখোমুখি যুদ্ধ নয়, শুধু একটা ভোট জিততে বেছে বেছে মীরজাফর কিনে বাজিমাতের চেষ্টা চলছে পুরোদমে। বঙ্গভঙ্গের ১১৬ বছর পর যা বাংলা ও বাঙালির সামনে নিঃসন্দেহে বিরাট চ্যালেঞ্জ। এবারের ভোটরঙ্গ সেই চ্যালেঞ্জেরই উত্তরের অপেক্ষায়।
ইতিহাসের ঘাত-প্রতিঘাতে বাঙালি অনেক কিছু হারিয়েছে। স্বাধীনতার ৬ বছর আগেই চলে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। বীর সুভাষ কোথায় তা জানা নেই ১৯৪৫ থেকে। এখনও দেশমাতার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছে বাংলা। এভাবেই হারাতে হারাতে পিছিয়ে পড়েছে গোটা জাতি। অভিশপ্ত দেশভাগ বাঙালির বুকে এক ছিন্নমূল অস্তিত্বের কালো দাগ লেপে দিয়েছে। এখন শেষ সম্বল তার আদ্যন্ত বেঁচে থাকার রসদ, উজ্জ্বল প্রাণবন্ত সংস্কৃতিটুকু। সবুজ গ্রাম। অনাবিল বয়ে যাওয়া প্রাণসুধা। আর বিশ্ব বিস্তৃত বাঙালিয়ানা। ডিজিটাল দৌড়ে যা আজ ছড়িয়ে পড়েছে অনন্ত চরাচরে। এই গ্রহের প্রায় প্রতিটি অণু-পরমাণুতে। ফের শক-হূন-পাঠান-মোগল আর বহিরাগত বর্গীর হানাদারিতে তাকে কিছুতেই নষ্ট হতে দেওয়া চলবে না। বাংলা থেকে ১৬০০ কিলোমিটার দূরে দিল্লিতে বসে কেউ রিমোটে আমাদের পরিচালনা করবে, এই ব্যবস্থা বাঙালির বুকে কুঠারাঘাতের চেয়েও বিষময় হবে। কোনওভাবেই পশ্চিমবঙ্গকে অবাঙালি প্রধান রাজ্য করা চলবে না। পানের পিকের দুঃসহ ঘিনঘিনে সংস্কৃতি আমদানি করা রুখতে হবে। এই বঙ্গের জীবনবোধকে সম্মান দিয়ে এবং অন্তরাত্মাকে অক্ষত রেখেই নির্বাচনের মাঠে খেলতে হবে। তাই দলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে বাংলার জননেত্রী ঠিকই
বলেছেন, যতই বাধা আসুক, খেলা হবে, দেখা হবে, জেতা হবে। চাপ তাঁকে কোনওদিন কোণঠাসা করতে পারেনি। তাই মুখে হাসি নিয়েই প্রত্যয়ী নেত্রীর শপথ, ২২১ আসনে জিতে তিনিই ফিরছেন ক্ষমতায়।
বাকিটা সময় বলবে, আগামী ২ মে।
খেলায় অংশ নিয়ে অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে
ধোপদুরস্ত বাম বুদ্ধিজীবীরাও যদি সাম্প্রদায়িক আলখাল্লায় শরীর ঢাকে, খাল কেটে রাজ্যে কুমির ঢোকায়, তাহলে তো ঘোর বিপদ। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে তাই হচ্ছে। পাশেই মধু আহরণের লোভে বহিরাগত চিড়েতন, হরতন, ইস্কাবনদের সনাতন ছন্দে নর্তন! সেই সঙ্গে বিকৃত গলায় সোনার বাংলা গড়ার ডাক দিয়েও প্রতিদিন বাংলার স্বর্ণালি ইতিহাসের ভুল তথ্য পেশ। মায় রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান পর্যন্ত ভুল বলছেন সর্বভারতীয় সভাপতি! এই ভুল শুধু লজ্জার নয়, তীব্র হতাশারও। এদের হাতে বাংলার ভবিষ্যৎ তুলে দেবেন?
জীবনানন্দের বাংলায় এই ফাল্গুনে বসন্তের গন্ধ মেখে পলাশ শিমুল পারিজাত কৃষ্ণচূড়ায় সেজে খেলার ময়দান পুরোদমে প্রস্তুত। কিন্তু যত গোল বাধছে রেফারি আর আম্পায়ারকে নিয়ে। ভোট পরিচালনায় কঠোর হোন, আপত্তি নেই। মমতা তো বলেই দিয়েছেন, দরকারে ২৯৪ দফায় ভোট হোক। দেশের সব কেন্দ্রীয় বাহিনীর গন্তব্য হোক বাংলা। কুচ পরোয়া নেই। কারণ ইতিহাসে শেষ কথা বলে মানুষই, বাহিনী নয়। বিশ্ব কাপ ফুটবলে ‘ভগবান’ মারাদোনার হাতে লেগে বল নেট ছুঁয়েছিল। তা নিয়ে শোরগোল বড় কম হয়নি। আর বাংলার এবারের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে রেফারি যদি অদৃশ্য চাপে আঙুলটা একটু বাঁকানোর খেলায় নামেন তাহলে? সবাই প্রতিবাদে সরব হবেন, না তখনও চুপ করে থাকবেন। এমনিতেই ভোটযন্ত্র নিয়ে সন্দেহ আর সংশয়ের শেষ নেই। তার উপর দাবি উঠেছে সব কেন্দ্রেই বাধ্যতামূলকভাবে ভিভিপ্যাট পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যাতে করে বৈজ্ঞানিক রিগিংয়ের ছায়া থেকে আসন্ন নির্বাচনকে অন্তত কিছুটা মুক্ত করা যায়। সেই সঙ্গে প্রত্যেককে নিজের ভোট নিজে দেওয়ার শপথ নিতে হবে। বাংলার স্বার্থেই এবার একটা ভোটও নষ্ট করা চলবে না।
পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪ আসনে এবার ভোট হচ্ছে আট দফায়। আর ২৩৪ আসনের তামিলনাড়ুতে মাত্র একদফায়। নিশ্চয়ই ওখানে খুন জখম রাহাজানি রাজনৈতিক আকচাআকচির রেকর্ড একেবারে শূন্য। কোথাও কোনও গণ্ডগোল, হাঙ্গামা নেই। নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্য এবং অতীত পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখেই পশ্চিমবঙ্গে আট দফায় ভোট করতে হচ্ছে। ভোটের একমাস আগে থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে মুড়ে দেওয়া হচ্ছে রাজ্যের এক একটি জেলা। সবই বিরোধীদের অভিযোগের ভিত্তিতে।
ভারতের নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থা। কোনও রাজনৈতিক দল ও ক্ষমতাসীন সরকারের প্রভাব সেখানে পড়ে না। পড়ার কথাও নয়। সংবিধানের মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখেই বছরের পর বছর কাজ করে আসছে এই সংস্থাটি। এই সংস্থার শীর্ষে যে তিনজন কমিশনার কাজ করেন তাঁদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। এঁদের মধ্যেই একজনকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। উত্তর প্রদেশ ও কাশ্মীরের তুলনায় বেশি দফায় ভোটের সিদ্ধান্তটি নিশ্চয়ই সুচিন্তিতভাবেই তাঁরা নিয়েছেন।
কিন্তু কমিশনের উপর পূর্ণ আস্থা রেখেই বলি, অপরাধের পরিসংখ্যান কি সেই কথা বলে? যোগীর রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটেই বাংলার চেয়ে ভালো নয়। মোটেই সুরক্ষিত নয় নারীদের সম্মান। হাতরাস, বুলন্দশহর, কানপুর, মিরাট অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য। সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্যও কয়েকগুণ বেশি। খুন, জখম, গুলি সব জলভাত। অথচ
সেখানে বিগত বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচন হয়েছে মাত্র সাত দফায়। ভোট ঘোষণার পর পরই কেন্দ্রীয় বাহিনী পর্যবেক্ষক এবং পুলিস কর্তাদের
দিয়ে রাজ্যটাকে এভাবে ঘিরে ফেলতে হয়নি। উত্তরপ্রদেশে বিধানসভার আসন সংখ্যা ৪০৩। আর পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪। অর্থাৎ বাংলায় আসন সংখ্যা ১০৯টি কম। তথাপি বাংলায় এবার কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে চার দিক দিয়ে মুড়ে আট দফায় ভোট হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কত বাহিনী আসবে তার হিসেব এখনও নেই। যদি সাধারণ পাটিগণিতের হিসেব মানতে হয় তাহলে বাংলায় আট দফায় ভোট হলে উত্তরপ্রদেশে নিশ্চিতভাবে ন্যূনতম পনেরো থেকে কুড়ি, কিংবা তারও বেশি দফায় ভোট হওয়া উচিত। মমতা ২৯৪ দফায় ভোটে রাজি, যোগী আদিত্যনাথ এবার কী বলবেন? বলা বাহুল্য, বাংলায় যেখানে ৭ কোটি ৩২ লক্ষ ভোটার, উত্তরপ্রদেশে সেখানে ভোটার সংখ্যা ১৪ কোটিরও বেশি। তাহলে কমিশনই বলুক যোগীর রাজ্যে ঠিক ক’দফায় ভোট হওয়া উচিত!
পরিসংখ্যান যাই বলুক, ডবল ইঞ্জিন যোগীর রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে বিশেষ প্রশ্ন তুলতে দেখা যায় না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককেও। খুন-খারাপি, ধর্ষণ, রাজনৈতিক অপরাধ পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলেও মোদি-অমিত শাহরা তা বড় একটা চোখে দেখতে পান না। যেমন কর্ণাটকের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর বেনজির অপরাধও শাসকের নজরে আসে না। কী করেছেন কর্ণাটকের ওই মন্ত্রী? নাম রমেশ জারকিহোলি। তিনি কর্ণাটক সরকারের জলসম্পদ মন্ত্রী। এক মহিলাকে নিজের দপ্তরে কাজ দেওয়ার নাম করে দিনের পর দিন সহবাস ও অত্যাচার করেছেন। অথচ ইয়েদুরাপ্পার ডবল ইঞ্জিন কর্ণাটক সরকার তা দেখতেই পায়নি। নিজের দলের লোক বলেই সাতখুন মাফ। আবার যাবতীয় প্রোটোকল ভেঙে কর্তব্যরত এক নার্সকে বাড়িতে ডেকে করোনার টিকা নিয়েছেন কর্ণাটকেরই আর এক মন্ত্রী। ডবল ইঞ্জিন বলে সাতখুন মাফ! এই একচোখা এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব কতদিন চলবে? পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এই বৈষম্য কতদিন নীরবে সহ্য করবেন?
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর হিসেবই বলছে মোদি জমানায় গোটা দেশে মহিলাদের উপর অপরাধ বেড়ে চলেছে। ২০১৯ সালে মহিলাদের উপর সংগঠিত অপরাধের সংখ্যা ছিল ৪ লক্ষ ৫ হাজার ৮৬১। ২০১৮ সালের সঙ্গে তুলনা করলে বৃদ্ধির হার ৭.৩ শতাংশ। তাহলে? যাঁরা সোনার বাংলা গড়ার আওয়াজ তুলছেন, আর ক্ষমতা দখল করতে বিভাজন আর সাম্প্রদায়িক জিগির তুলছেন, তাঁদের বলি বাঙালিকে এ যাত্রায় ছেড়ে দিন। বাঙালি নিজের সোনার ভবিষ্যৎ নিজেই তৈরি করে নিতে পারবে। তার জন্য কোনও গুজরাতির আশ্বাস আর হাওয়াই জাহাজ চেপে এসে মিথ্যে আস্ফালনের দরকার নেই। প্রয়োজন নেই কোনও যোগী মার্কা ভণ্ডের দৌরাত্ম্যের। বাংলাকে অপমান ও দুয়ো দেওয়ার আপনি কে? কী করেছেন বাংলার জন্য? বাংলা ও বাঙালি তার ভবিষ্যৎ নিজেই গড়ে নিতে জানে। মওত কা সওদাগরের আশীর্বাণীর পরোয়া সে করে না। এই নির্বাচন তাই বাঙালি সংস্কৃতির উপর বাইরের আঘাত চিরতরে শেষ করারও অগ্নিপরীক্ষা।