শারীরিক দিক থেকে খুব ভালো যাবে না। মনে একটা অজানা আশঙ্কার ভাব থাকবে। আর্থিক দিকটি ... বিশদ
দীপঙ্করবাবু জীবনে কোনও চাকরিই করেননি। আজীবন পেশা বলতে নাটক আর আবৃত্তি। নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করেই কেটেছে যৌবন। আর ছিল গণনাট্য। বরাবর বামপন্থী মানসিকতার দীপঙ্করবাবুকে নজরুল জন্মশতবর্ষ কমিটির সম্পাদক করেছিল পশ্চিমবঙ্গে সরকার। তখন বামফ্রন্টের আমল। পদাধিকার বলে সভাপতি ছিলেন তৎকালীন তথ্য-সংস্কৃতি দপ্তরের মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রাজভবনের মিনিস্ট্রি হাউসে কাজ হতো সেই কমিটির। সেদিনের রাজভবন থেকে আজ রাজপথে নেমে এসেছেন দীপঙ্করবাবু। অবশ্য এ নিয়ে তাঁর কোনও অভিযোগ নেই। বরং যে সংস্থার হয়ে হ্যান্ডবিল বিলি করছেন, তাদের কাজের ব্যাপারে তিনি বেশ উৎসাহী। মনে মনে খুশিও। এটা যে তাঁর পছন্দের কাজ নয়, সেটা অবশ্য ঠিক। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মেশার অভ্যাস থাকায়, চালিয়ে যেতে অসুবিধা হচ্ছে না।
কীভাবে তাঁর জীবনে নেমে এল এই আমূল পরিবর্তন? দুখু মিঞাঁর ভাবশিষ্য দীপঙ্করবাবু। জীবনটাও খানিক তাঁর গুরুর প্রথম ও শেষ জীবনের সঙ্গে মেলে। পেট চালাতে প্রথম জীবনে কাজী নজরুল ইসলামকে কী না করতে হয়েছে! আর শেষ জীবনে প্রচুর সম্মান, পুরস্কার ঝুলিতে থাকলেও বিদ্রোহী কবি ছিলেন কার্যত রণক্লান্ত এবং অনেকটাই অবহেলিত। দীপঙ্করবাবুর অবস্থাও এখন তাই। বাঘাযতীনের পৈতৃক বাড়ি হাতছাড়া হয়েছে। তাতে প্ররোচনা ছিল এক ডাকসাইটে সিপিএম নেতার। এই আক্ষেপ তাঁর এখনও যায়নি। এখন ভাড়াবাড়িতে স্ত্রী এবং দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন। বড় ছেলে স্নাতকস্তরের পড়ুয়া, ছোটটি একাদশ শ্রেণীর। দু’জনের পড়াশোনার খরচ সামলাতে সামলাতে পেট চালানো দায় হয়ে উঠেছে। সে কারণে মতাদর্শ ‘সরিয়ে রেখে’ পথে নেমেছিলেন জীবিকার তাড়নায়। তাও পুঁজি ছিল সেই কবিতা। নন্দীগ্রামে কৃষকদের উপর গুলি চালানোর ঘটনায় তৃণমূলের প্রতিবাদ মঞ্চে গিয়ে প্রতিবাদী কবিতা পাঠ করেছেন। জনৈক বিজেপি প্রার্থীর হয়েও প্রচার করেছেন এই বাচিক শিল্পী। একবার তো একজনের সূত্রে আরএসএসের ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (এবিভিপি) প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানেও নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করে বসেছিলেন। রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায় মঞ্চে। ‘বিধর্মী’ কবির কবিতা আবৃত্তি নিয়ে অনেকেই প্রকাশ্যে উষ্মাপ্রকাশ করেন। তিনি তখন তাঁদের মনে করিয়ে দেন, অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগেই নজরুলের ২০০ টাকা ভাতা চালু হয়েছিল। কারণ, তাঁর কবিতা ছিল ঐক্যের, ভাঙনের নয়। এতে অনেকেই শান্ত হয়েছিলেন।
গণনাট্যে কখনও গ্ল্যামার সেভাবে ছিল না। অর্থের সংস্থান আরও কম। তবু বাচিক শিল্পীর কাজ করে কষ্টেসৃষ্টে চলে যাচ্ছিল। তাতে বাধ সেধেছে করোনা। যে উদাত্ত কণ্ঠে ‘আমার কৈফিয়ৎ’, ‘বিদ্রোহী’, ‘মানুষ’, ‘সাম্যবাদী’ আবৃত্তি করতেন, সেই আবেগ মাখানো স্বরেই বাসে চড়ার আহ্বান জানান ‘পথহারা’ দীপঙ্কর। ‘এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’, নজরুল ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় যে প্রশ্ন তুলেছিলেন, নিজের জীবন দিয়ে যেন তাঁরই উত্তর দিচ্ছেন দীপঙ্কর।