উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
—ছিল না। তবে এখন আছে। গত কয়েক মাসে প্রচুর লুডো বিক্রি হয়েছে। এতদিনের দোকান। এত লুডো কোনও দিন বিক্রি করিনি দাদা।
ছোট্ট একটা মনোহারি দোকান। জিনিসপত্রের ডাঁই। নুন-তেল-আটার বস্তা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে। তার মধ্যে থেকে একটা লুডো বের করলেন বাবু পোদ্দার। যেন লুডো নয়। হিঁচড়ে বের করলেন একটা ধুলিমলিন সময়। যে সময় বাঙালি ফেলে এসেছে চল্লিশ বছর আগে।
চকচকে লুডো। ধুলো নেই। প্লাস্টিকে মোড়া। প্লাস্টিক ছিঁড়ে লুডোর পাতা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে নেমে এল ছেলেবেলা। পাতা জুড়ে কিলবিল করছে সাপ আর অসংখ্য মই। মইয়ের গোড়া দশে, তো মাথা আশির ঘরে। আটানব্বইয়ের ঘরে সাপের মুখ। সেখানে ঘুঁটি পড়তেই সময় নামতে নামতে চলে এসেছে পাঁচে। যেন লুডোর ঘুঁটি নয়। ফেলে আসা সময়ই হামাগুড়ি দিয়ে নামছে, আবার উঠছে মই বেয়ে। বাঙালির বিছানায় ফের সেই ঠকঠক আওয়াজ। ছক্কা না পুট? এ মা, এ তো তিন ছক্কা। তুমি পচা।
পচা কথাটাও ইদানীং কেউ বলে না। কত নতুন কথা উড়ে বেড়াচ্ছে। পচা তো কোন ছাড়! তবে পচার গায়ে অতীতের ভুষোকালি লেগে আছে। করোনা যেমন অনেক কিছু কেড়েছে তেমন অনেক কিছু ফিরিয়েও দিয়েছে। মেয়েলি কাজ বা মেয়েলি খেলা বলে যে আদতে কিছু হয় না, ঘাড় ধরে তার সহজপাঠ শিখিয়েছে করোনা। ঘরে বসে বসে ক্লান্ত বাঙালি কুড়িয়ে-বাড়িয়ে জড়ো করেছে লুডো, দাবা, ব্যবসা। অন্তত দোকানের বিক্রির হিসেব তেমনই বলছে।
লুডো ছিল বঙ্গজীবনের অঙ্গ। প্ৰখর রোদ কিংবা তুমুল বর্ষা—চারজন গোল হয়ে বসে লুডো খেলছে। কিংবা দু’জন মুখোমুখি বসে সাপ-লুডো। কতদিন কেউ বলেনি, পাকা ঘুঁটি, কাঁচা ঘুঁটি। খেলতে খেলতে ঝগড়া, তারপর হাসি-রাগ অভিমান। বিয়ের রাতে নায়ক ফিসফিসিয়ে নায়িকাকে বলছে, ‘আজ রাতে খুব জমবে সাপ-লুডো খেলা।’
বাঙালি একসময় দূরপাল্লার ট্রেনে উঠলেও লুডো নিয়ে উঠত। ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে মন্দার বোস ও ডক্টর হাজরার লুডো খেলার দৃশ্য মনে আছে? হাজরা বলছেন, ‘কী হল? পাঁচ পড়ল আর তুমি মইয়ে উঠলে কী করে?’ মন্দার বোস বললেন, ‘লে হালুয়া। আমি তো ভাবলাম চার পড়েছে। চোখে ছানি-টানি পড়ল নাকি?’ মদের গেলাসের দিকে আঙুল দেখিয়ে ডক্টর হাজরার উত্তর, ‘ছানি পড়েনি। পেটে পানিটা একটু বেশি পড়েছে।’
লুডোর বিক্রি যে বেড়েছে, তা মালুম হল প্রবীণ লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথাতেও। তিনি বললেন, ‘দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর এখন রোজ নাতনির সঙ্গে লুডো খেলছি। আমিই নাতনিকে লুডোটা উপহার দিয়েছি। দাদু-নাতনিতে সময়টা কেটে যায় ভালো।’ লুডো কি বাড়িতে ছিল? নাকি লকডাউনে কিনেছেন? শীর্ষেন্দুর উত্তর, ‘দুটোই। আগেও ছিল। এখন আর একটা কিনেছি। আমার স্ত্রী বরাবর লুডো খেলেন। তবে একাই খেলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী নেই তো।’ হেসে ফেলেন শীর্ষেন্দু।
অবশ্য ঘরে বসে লুডো খেলাটা যে নিরাপদ সেটাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। হায়দরাবাদের এক যুবক নাকি রোজ দুপুরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে লুডো খেলতেন। ছক্কা না পুট, কার ছোঁয়ায় কে জানে, তিনি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এবং আরও জনা তিরিশেক লোকের মধ্যে করোনা-বৃষ্টি করেছেন।
দাবা যদি অভিজাতের খেলা হয়, তো লুডো হল নেহাতই নিরীহ মগজের। দাবার মতোই একটা খেলা ছিল ষোলো ঘুঁটি। খড়িমাটি দিয়ে ঘর কেটে শুরু হতো খেলা। অনেক পুরোনো বারান্দায় বাড়ি তৈরির সময়েই সিমেন্টে দাগ কেটে কোর্ট তৈরি করে রাখা হতো। মুখোমুখি বসে বগা ও ভগা। ঘুঁটি বলতে ইটের টুকরো অথবা লাল ডাঁটা ও সবুজ ডাঁটার টুকরো। মোবাইল নেই, কম্পিউটার নেই, জীবন বয়ে যেত মন্দাক্রান্তা তালে।
আর ছিল ব্যবসা খেলা। রাশি রাশি কাগজের নোট। যেন বড়বাজারের গদি। খেলুড়েরা একে একে কিনে নিচ্ছে বড় বড় শহর কিংবা বিমানবন্দর অথবা ডাকঘর। দোকানে ঢুঁ মেরে জানা গেল, ‘ব্যবসা’র বিক্রিও নাকি বেড়েছে অনেক।
তাহলে বাঙালির হাতে রইল কী? ঠক ঠক আওয়াজের পর লুডোর ঘরে গড়িয়ে যাচ্ছে হাসি-কান্নার সাদা ঘনক। কীসে গিয়ে সেটা থিতু হবে কে জানে! ছক্কা না পুটে?
সে যাই হোক, করোনাকালে মানুষ সাপ-লুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গেই! তা সে নিঝুম দুপুর হোক, কিংবা হ্যারিকেন-জ্বলা সন্ধে।