আজ ব্যবসাদিক্ষেত্রে শুভ অগ্রগতি হতে পারে। কর্মস্থলে জটিলতা কমবে। অর্থাগম যোগ আছে। ... বিশদ
হঠাৎ এমন উদারতা প্রদর্শনের নেপথ্যে রয়েছে একটি চমকপ্রদ কাহিনি। ১৪ এপ্রিল, বিজেপির ইস্তাহার প্রকাশের দিন থেকে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সাদাসিধে রাজনাথ সিংয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত কমিটির তৈরি করা এই নথি পেয়ে মোদিজি মোটেই খুশি হননি। কমিটি নীরবে মেনে নিয়েছে যে, এটা কোনও রাজনৈতিক দলের ইস্তাহার নয়, বরং একজন প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিজ্ঞাপন, যিনি দলের ভিতরটাকে মজবুত করে গড়ে দিয়েছেন। নথিটাকে ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ নাম দিয়ে কমিটি বস্তুত প্রধানমন্ত্রীর বন্দনা করেছে এবং সেটা তাঁর প্রাপ্যও বটে। যাই হোক, মোদিজি যেমন সঠিকভাবেই অনুমান করেছিলেন, ঠিক তেমনই ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ শীর্ষক এই নথি বাজারে ছাড়ার ঘণ্টাকয়েকের মধ্যেই হাওয়া হয়ে গিয়েছে, কোথাও তার চিহ্নমাত্র নেই! আজকে আর কেউই বিজেপির ইস্তাহার নিয়ে কথা বলছেন না, দুর্ভাগ্য এমনই যে, এমনকী মোদিজিও নন। ‘মোদি কি গ্যারান্টি’র গতি হয়েছে শান্তিপূর্ণ বিশ্রাম।
মূল মন্তব্য
‘মোদি কি গ্যারান্টি’কে নরেন্দ্র মোদি একদিকে আবর্জনার ঝুড়িতে নিক্ষেপ করতে পারেননি, অন্যদিকে দায়ীও করতে পারেননি এই নথির খসড়া কমিটির অযোগ্যতা কিংবা তাদের গোপন উদ্দেশ্যকে। কংগ্রেসের বাক্সবন্দি ইস্তাহারের গ্রহণযোগ্যতা মোদিজি একাই বাড়িয়ে দিয়েছেন, নথিটার উপর তাঁর ভাষ্য যোগ করে। তাঁর এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার ফলে বহু মানুষ কংগ্রেসের ইস্তাহারটা দেখেছেন এবং পড়ে ফেলেছেন। এটাই ভারতীয় সাহিত্যের মহান ঐতিহ্যের সঙ্গে একটা মানানসই ব্যাপার, যেখানে তার ব্যাখ্যা বা ভাষ্যগুলি মূল রচনাকে ছাপিয়ে গিয়েছে বা হয়ে উঠেছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।
কংগ্রেসের ইস্তাহারে মোদিজির মুখে যোগ হয়েছে নীচে বর্ণিত ‘রত্নগুলি’:
• জনগণের জমি, সোনাদানা এবং অন্যান্য দামী জিনিসপত্র মুসলমানদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করে দেবে।
• ব্যক্তি নাগিকদের সম্পত্তি, মহিলাদের হেফাজতের সোনাদানা এবং জনজাতির পরিবারের মালিকানায় যেসব রুপো সঞ্চিত রয়েছে, তার মূল্য নির্ধারণের জন্য কংগ্রেস একটা সমীক্ষা করাবে। অতঃপর তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেবে সেগুলো।
• সরকারি কর্মীদের জমি এবং নগদ অর্থ বাজেয়াপ্ত করার পর কংগ্রেস সেগুলোও বিলি বণ্টন করে দেবে।
• ডঃ মনমোহন সিং বলেছিলেন যে, দেশের সম্পদের উপর মুসলমানদের দাবি সবার আগে। ডঃ সিং যখন এই কথা বলেন, তখন সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম (গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে)।
• কংগ্রেস আপনার ‘মঙ্গলসূত্র’ এবং ‘স্ত্রীধন’ পর্যন্ত নিয়ে নেবে এবং যাদের বেশি সংখ্যক ছেলেপুলে আছে সেগুলো বিলিয়ে দেবে তাদের মধ্যে।
• আপনার যদি গ্রামে একটা বাড়ি থাকে এবং আপনি যদি শহরে একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে থাকেন, তবে কংগ্রেস এই দুটোর একটা বাড়ি কেড়ে নিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে দেবে।
মন্ত্রীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা
মোদিজির বিশ্বস্ত সেনাপতি এবং উপদেষ্টা অমিত শাহ যোগ করেছেন, মন্দিরের সম্পত্তি কংগ্রেস বাজেয়াপ্ত করবে এবং সেগুলো তাদের মধ্যে বিতরণও করে দেবে। এই প্রসঙ্গে রাজনাথ সিংয়ের সংযোজন এইরকম, কংগ্রেস জনগণের সম্পদ বেদখল করবে এবং সেসব ফের বিলিয়ে দেবে অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে। পরের দিন, রাজনাথ সিং এই আলোচনায় আরও একটি অমূল্য কথা যোগ করেছেন যে, দেশের সশস্ত্র বাহিনীতে ধর্ম-ভিত্তিক কোটা চালু করার প্ল্যান করেছে কংগ্রেস।
যখন ভাষ্যকাররা একে অপরকে বহুগুণে ছাপিয়ে গিয়েছেন, তখন মোদিজি আবিষ্কার করলেন যে, কর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ‘উত্তরাধিকার কর’ (ইনহেরিটেন্স ট্যাক্স) চালু করার পরিকল্পনা করছে কংগ্রেস। এই ইস্যুতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মলা সীতারামন উজাড় করেছেন উত্তরাধিকার কর বিষয়ে তাঁর প্রজ্ঞা যতখানি। অথচ, ১৯৮৫ সালে কংগ্রেস সরকারই এস্টেট ডিউটি (এক ধরনের উত্তরাধিকার কর) বাতিল করেছিল। অন্যদিকে, ২০১৫ সালে বিজেপি সরকারের হাতে বাতিল হয়েছে বিত্ত কর (ওয়েলথ ট্যাক্স)। বিষয়টি না জানার জন্য নির্মলা সীতারামনকে অবশ্য ক্ষমাঘেন্না করাই যায়।
কংগ্রেসের ইস্তাহারের উপর এই পরিকল্পিত আক্রমণের শুরুটা কেন এবং কখন হল, তা বোঝা কঠিন নয়। ১৯ এপ্রিল, প্রথম দফার ভোটগ্রহণের পরই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর (পিএমও) এবং বিজেপিকে আতঙ্ক গ্রাস করেছে বলেই মনে হচ্ছে। ২১ এপ্রিল রাজস্থানের জালোর এবং বানসওয়াড়া থেকে মোদিজি আক্রমণটা শুরু করেছেন এবং এখনও থামার নাম নেই। তাঁর কাল্পনিক লক্ষ্যের তালিকাটি নিঃসন্দেহে উদ্ভট। মন্ত্রিসভায় তাঁর সহকর্মীরাও এলোপাথাড়ি ‘ফায়ার’ করে চলেছেন। এই পাগলামি থামাতে সংবাদমাধ্যমের বিশেষ দায়িত্ব গ্রহণ দরকার ছিল। তার পরিবর্তে, সংবাদপত্রগুলো বিতর্কিত বিষয়গুলোর ‘ব্যাখ্যা’ দিয়েছে এবং লিখেছে জ্ঞানগর্ভ সম্পাদকীয়। টিভি চ্যানেলগুলো পণ্ডিতদের সাক্ষাৎকার সম্প্রচারের পাশাপাশি ‘প্যানেল ডিসকাশন’ চালিয়ে গিয়েছে। মোদিজি যে নকল যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, সেটাই ব্যাপকভাবে এবং বহুবার সংঘটিত হয়েছে।
কী আশা করা যায়
কংগ্রেসের ইস্তাহারটি ৫ থেকে ১৯ এপ্রিলের মধ্যে সারা ভারতে সর্বাধিক আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠে। প্রতিশ্রুতিগুলি জনগণের মনে গভীর রেখাপাত করেছে। সেগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল:
• আর্থ-সামাজিক এবং জাতিগত সমীক্ষা (সোশিও-ইকনমিক অ্যান্ড কাস্ট সার্ভে);
• সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের ঊর্ধসীমা প্রত্যাহার;
• মনরেগার শ্রমিকদের জন্য ৪০০ টাকার দৈনিক মজুরি;
• সবচেয়ে গরিব পরিবারগুলির জন্য মহালক্ষ্মী প্রকল্প;
• কৃষিপণ্যের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) আইনি নিশ্চয়তা;
• কৃষিঋণ মকুবের পরামর্শ গ্রহণে একটি কমিশন গঠন;
• যুবদের জন্য শিক্ষানবিশির অধিকার (রাইট টু অ্যাপ্রেনটিসশিপ ফর ইয়ুথ);
• ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্পের বিলুপ্তি;
• খেলাপি শিক্ষাঋণ মকুব; এবং
• একবছরে কেন্দ্রীয় সরকারের ৩০ লক্ষ শূন্যপদ পূরণের প্রতিশ্রুতি।
যখন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের মুখে কংগ্রেসের ইস্তাহার সম্পর্কে ‘লোকসভা নির্বাচনের নায়ক’ কথাটি শোনা গেল, বস্তুত তখনই মোক্ষম আঘাত ঘটে গেল ক্ষমতার কেন্দ্রে। এতে অবশ্যই চটেছেন নরেন্দ্র মোদি এবং তিনি এই নথিটাকে জনগণের সামনে ‘খলনায়ক’ হিসেবে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে তাঁর দুর্ভাগ্য এটাই যে, কংগ্রেসের ইস্তাহারের কোনও অংশই ত্রুটিপূর্ণ নয়। তাই, প্রেতাত্মারচিত একটা কাল্পনিক ইস্তাহার সামনে এনে সেটাকেই আবর্জনার স্তূপে নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিলেন মোদিজি। আমার মতে, একজন বিজেপির প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে কংগ্রেসের প্রকৃত ইস্তাহারের প্রতি এটাই হল সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন!
মোদিজির নেতৃত্বে বিজেপি তৃতীয় দফায় জয়ী হলে কী ধরনের বিকৃতি, মিথ্যাচার এবং অপব্যবহার অপেক্ষা করে থাকবে, দেশবাসীকে আগাম জানিয়ে দিলেন তাঁরা সেটাই। শুধু এই জন্যই কংগ্রেসের উচিত, ‘ধন্যবাদ, প্রধানমন্ত্রী’ বলা। ইস্তাহার পুনর্লিখনে ইতিমধ্যেই বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। এবার ওই দক্ষতার জোরেই ভারতের সংবিধানটাও নতুন করে লিখে ফেলতে পারেন তিনি।