হঠাৎ জেদ বা রাগের বশে কোনও সিদ্ধান্ত না নেওয়া শ্রেয়। প্রেম-প্রীতির যোগ বর্তমান। প্রীতির বন্ধন ... বিশদ
১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭ পাশ হয়। এই আইনে ভারত ও পাকিস্তান দুটি পৃথক দেশ গঠনের জন্য ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দিনটিকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। স্যার সিরিল র্যাডক্লিফকে চেয়ারম্যান করে পাঁচজনের বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশন গঠন করা হয়। র্যাডক্লিফ ছাড়া কমিশনের বাকি চারজন বিচারপতি ছিলেন জাস্টিস বিজনকুমার মুখোপাধ্যায়, সিসি বিশ্বাস, আবু সালেহ মহম্মদ আক্রম এবং এস এ রহমান। ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই থেকে ১২ আগস্ট মাত্র ২৫ দিন কার্যকরী সময়ের মধ্যে অতি দ্রুততার সঙ্গে তাঁদের কাজ করতে হয়। র্যাডক্লিফ তাঁর রোয়েদাদে যে সিদ্ধান্ত জানিয়ে মানচিত্র উপস্থাপন করেছিলেন, তা নিয়ে অনেকে ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে বর্তমানকালের মতো শক্তিশালী গণমাধ্যমের অস্তিত্ব ছিল না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম লিগ ১৫ আগস্ট সকাল থেকে বনগাঁ সহ চার জেলায় পাকিস্তানের পতাকা তুলে সভা-সমাবেশ করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে স্বাধীনতার আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠেন। মুসলিম লিগের পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন ও সভা-সমাবেশে সাধারণ মানুষ সহ বহু কংগ্রেস নেতানেত্রীও বিভ্রান্তির শিকার হন। ওই সময় নদীয়া জেলার সক্রিয় কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে ছিলেন তারকদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, স্মরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, জগন্নাথ মজুমদার, শঙ্করদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র সহ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে অবিভক্ত নদীয়ার মহকুমা ছিল পাঁচটি। কৃষ্ণনগর সদর মহকুমা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙা ও রানাঘাট। ১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট রাতে রেডিওতে ঘোষণা হয় ভারতবর্ষকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হবে। নদীয়া জেলা পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে পড়েছে বলে বলা হয়। ভারতপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি নদীয়ার মহারানি জ্যোতির্ময়ীদেবী, মুর্শিদাবাদের রানি স্বর্ণময়ীদেবী সহ নানা স্তরের সামাজিক ব্যক্তিত্ব মাউন্ট ব্যাটন সহ ব্রিটিশ প্রশাসকদের কাছে বনগাঁ সহ নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দিনাজপুর জেলার ভারতভুক্তির জোরালো দাবি তুলে ধরেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট চক্রবর্তী রাজা গোপালচারী গভর্নর অব বেঙ্গল পদে আসীন হন। তাঁর কাছে দরবার, কলকাতা থেকে দিল্লি প্রশাসনিক চিঠি আদান প্রদানের পর ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট নোটিফিকেশন জারি করে বনগাঁ সহ চারটি জেলার অবস্থান পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। ওইদিন নোটিফিকেশন নম্বর ৫৮ জিএ বলে ১৮৯৮ সালের আগের সমস্ত নোটিফিকেশন বাতিল করে র্যাডক্লিফের রোয়েদাদ অনুকরণে নবদ্বীপ জেলা গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। নবদ্বীপ জেলার অধীনে কৃষ্ণনগর সদর মহকুমা ও রানাঘাট মহকুমা অন্তর্ভুক্ত হয়। ওই দুটি মহকুমার অধীনে কৃষ্ণনগর, কোতোয়ালি, চাপড়া, কালীগঞ্জ, নদীয়া, নাকাশিপাড়া, কৃষ্ণগঞ্জ, করিমপুর, তেহট্ট, রানাঘাট, শান্তিপুর, চাকদহ, হরিণঘাটা, হাঁসখালি থানা এলাকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সরকারি নোটিফিকেশনের সংবাদ রেডিওতে ঘোষণা করা হয়। ১৮ আগস্ট সংবাদপত্রের শিরোনাম হয় নদীয়ার রানাঘাট ও কৃষ্ণনগর ভারতের অন্তর্গত। কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙা পাকিস্তানের অংশ। ওইদিন জেলার সর্বত্র বিজয় মিছিল হয়। চাকদহে নেতৃত্ব দেন নাদু মিঞা।
প্রবীণ সাহিত্যিক সুধীর চক্রবর্তী বলেন, ওই সময় আমি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। ১৭ আগস্ট খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ মাঝরাতে চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায়। জানালা দিয়ে দেখি লরি ভর্তি করে, হেঁটে লোকজন আনন্দে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। তিনদিন পাকিস্তানে থাকার পর পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে ওঠে চরকা চিহ্ন যুক্ত তেরঙা ভারতের পতাকা। মুসলিম লিগ কর্তৃক র্যানডক্লিফের রোয়েদাদের সীমানা নির্দেশক মানচিত্রের অপব্যাখ্যার ফলে নদীয়ার ভারতভুক্তি হয় ১৯৪৭ সালের ১৮ আগস্ট নবদ্বীপ জেলা হিসেবে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির নোটিফিকেশন নম্বর ৫৪৫ জিএ অনুযায়ী নবদ্বীপ জেলার নাম পরিবর্তন করে নদীয়া জেলা রাখা হয়। ওইদিনই নোটিফিকেশন নম্বর ৫৪৬ জিএ অনুযায়ী নদীয়া থানার নাম পরিবর্তন করে নবদ্বীপ হয়।