শেয়ার ও বিমা সূত্রে অর্থাগম হতে পারে। কাজের প্রসার ও নতুন কর্মলাভের সম্ভাবনা। বিদ্যা হবে। ... বিশদ
মহামান্য হাইকোর্ট কি জানেন স্মার্তি রায়ের কথা? এসএসসি পরীক্ষায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে গোটা রাজ্যে প্রথম হয়েছিলেন। নম্বর ছিল ৯৪। নৈহাটি নরেন্দ্র বিদ্যা নিকেতনে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াচ্ছিলেন। সোমবারের পর তিনি স্রেফ ‘অযোগ্য’। চাকরিটা আর নেই। বলছিলেন, ‘সংসারটা কীভাবে চলবে জানি না। কাজের জায়গায়, পরিবারের মধ্যে, সমাজে... বারবার অপমানিত হতে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে মাটিতে মিশে যেতে। কতজনকে বোঝাব যে, আমি টাকা দিয়ে চাকরি পাইনি? তাদেরই বা বোঝার দায় আছে নাকি?’ চাকরি পাওয়ার পর অনেক কষ্টে একটা বাড়ি করেছিলেন সৌরভ দাস। খেজুরি মানসিংহবেড় বাণীশ্রী বিদ্যানিকেতনে জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক। হোম লোনের জন্য মাসে ইএমআই গুনতে হয় ১৩ হাজার টাকা। এছাড়া হাজার চারেক টাকার এলআইসি প্রিমিয়াম আছে। বাড়িতে স্ত্রী, বাবা-মা, দুই ছেলে। আতঙ্কে আছেন সৌরভ। চাকরি গিয়েছে। এবার বাড়িটাও ব্যাঙ্ক কেড়ে নেবে। পথে বসতে হবে এতগুলো অসহায় মানুষকে নিয়ে। আর পেট চলবে কীভাবে? জানেন না আচমকা ‘অযোগ্য’ হয়ে যাওয়া এই শিক্ষক।
একটা সরকারি চাকরি। এ জন্য বছরের পর বছর পরিশ্রম করেছেন তাঁরা। রাত জেগেছেন। নিজেদের প্রস্তুত করেছেন। আজ সেই ‘অযোগ্য’রা প্রশ্ন তুলছেন, সত্যিকারের বেআইনি নিয়োগ খুঁজে বের করাটা কি আইন বা বিচার ব্যবস্থার কর্তব্য ছিল না? কয়েক হাজারের দুর্নীতির জন্য আমরা কেন পথে বসব? খুব ভুল কিন্তু তাঁরা বলছেন না। কয়েকগাছা দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রের সরকার যখন কোটি কোটি মানুষকে প্রাপ্য টাকা থেকে বঞ্চিত করে, তার নেপথ্য নগ্ন রাজনীতিটা বোঝা যায়। কিন্তু বিচার ব্যবস্থা! রায়দানের দু’দিন আগে বঙ্গ বিজেপির কিছু তল্পিবাহক হুমকি দিলেন, সোমবার বোমা ফাটবে। এর আড়ালে থাকা যুক্তিটা কী? এতদিন তাঁরা বলতেন, ইডি পাঠিয়ে দেবেন, সিবিআই লেলিয়ে দেবেন। আর এখন আদালত! একবার কি ভাবার ফুরসত হয় না যে, বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থাকে কোন তলানিতে নিয়ে ফেলছেন তাঁরা? কেন? শুধুই এ রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের কোমর ভাঙতে? যে বাংলার মাটিতে তাঁরা খাচ্ছেন, বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছেন, তাকে বিশ্ব দরবারে হেনস্তা করার কী অধিকার আছে তাঁদের? যে থালায় খাওয়া, সেখানেই ছিদ্র? ওই নেতারা অবশ্য সেসব শুনবেন না। তাহলে তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ হবে না।
ছাত্র অনুপাতে শিক্ষক এমনিতেই রাজ্যের সব স্কুলে পর্যাপ্ত নয়। এই রায়ের পরও ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে যাবে, কিন্তু বোর্ডের সামনে দাঁড়ানোর মতো কেউ থাকবেন না। আগামী প্রজন্মকে আর কত পিছনে এভাবে ঠেলে দেওয়া হবে? একজন বিচারপতি এজলাসে বসে মন্তব্য করেন, ‘ঢাকি সমেত বিসর্জন দিয়ে দেব’। তিনিই আবার পরে বিজেপির প্রার্থী হয়ে মানুষের কাছে ভোট চান। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, ‘ঢাকি সমেত’ বলতে তিনি কি প্যানেল বাতিলের কথা বলেননি? হাজার হাজার যোগ্য প্রার্থীদের সাজা দেওয়ার অধিকার কি আইনও তাঁকে দিয়েছে? কাউকে দিয়েছে? হতে পারে তাঁর পর্যবেক্ষণ প্রাথমিকের মামলার ক্ষেত্রে ছিল। কিন্তু খাঁড়া যার উপরই পড়ুক না কেন, যন্ত্রণা তো ভোগ করতে হচ্ছে এই ২৫ হাজার ৭৫৩ জনকেই। যোগ্যদের, আন্দোলনকারীদেরও। প্রায় প্রতিটা রাজ্য থেকে নিয়োগ দুর্নীতির নালিশ শোনা যায়। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বা উত্তরাখণ্ডে কি এভাবে যোগ্যদেরও চাকরি হারাতে হয়? না হয় না। এই নিয়তি শুধু বাংলার। কারণ, ওই সব রাজ্যে মার্কামারা ধান্দাবাজ, স্বার্থান্বেষী রাজনীতিক নেই, যারা আখের গোছানোকে ধ্যানজ্ঞান করে নিজের রাজ্যকেই হাঁড়িকাঠে তুলে দিতে পারেন।
কী ভরসায় আগামী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা উদয়াস্ত খাটবে? কীসের ভরসায় তারা সরকারি চাকরির জন্য আশায় বুক বাঁধবে? চাকরি পাওয়ার পরও কি এতটুকু নিশ্চিন্ত হতে পারবে তারা? আতঙ্ক তাড়া করবে তাদের... আবার কারও অভিযোগে হয়তো একদিন তারা শুনবে—চাকরিটা আর নেই। সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে দায়িত্ব দেওয়া সত্ত্বেও তারা দুর্নীতির ভূত ধরতে পারবে না। আর আদালত বাতিল করবে গোটা প্যানেলকেই! এভাবেই অপমৃত্যু হয় যোগ্যতার। মানবিকতার। হচ্ছেও।
দাঁতে দাঁত চেপে রয়েছেন এই চাকরিহারা যুবক-যুবতীরা। কেউ কেউ এর শেষ দেখবেন, কেউ হারিয়ে যাবেন হতাশার অন্ধকারে। স্মার্তি রায়ের মতো কেউ কেউ তখনও বলবেন, ‘আমাদের হয় চাকরি ফেরানো হোক, না হলে অযোগ্য বলে প্রমাণ করুক।’