সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা, আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
তিনি লালকৃষ্ণ আদবানি। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ‘পোস্টার বয়’। সমস্তিপুরের ওই ঘটনার মাত্র ছ’বছর আগের কথা। ১৯৮৪ সালের লোকসভা আসনে মাত্র দু’টি আসন পেয়েছে বিজেপি। ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির দাপাদাপি দেশের রাজনীতিতে। বিজেপি সেখানে নিতান্তই শিশু। কিন্তু এর পর দ্রুত বদলালো রাজনৈতির হালচাল। আদবানির নেতৃত্বেই ‘মন্দির রাজনীতি’কে ভবিষ্যতের পথ নির্ধারিত করল বিজেপি। পালামপুর প্রস্তাবের মাধ্যমে। কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ফল মিলতে বেশি দেরি হল না। ১৯৮৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির সাংসদ সংখ্যা দুই থেকে বেড়ে দাঁড়াল ৮৫।
ফেরা যাক ১৯৯০ সালের ঘটনাবলিতে। সেপ্টেম্বরে গুজরাতের সোমনাথ মন্দির থেকে শুরু হল আদবানির ‘রাম রথযাত্রা’। মন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করে মেরুকরণের রাজনীতি তোলপাড় ফেলে দিল গোটা দেশে। আদবানির রথ যত এগিয়েছে, পিঠনে পিছনে ভিড় তত বেড়েছে। সঙ্গে সাম্প্রদায়িক হিংসা, রক্তপাত। সমস্তিপুরে এসে সেই সেই রথ থামল বটে, থামল না বিজেপির উত্থান। বরং এগিয়ে চলল চরম গতিতে। সমস্তিপুরের ঘটনার পর দেশজুড়ে তখন দু’টি নাম মুখেমুখে। আদবানি ও লালু। প্রথমজন রথযাত্রার মাধ্যমে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে একত্রিত করে বিজেপির পালে হাওয়া টানান কারিগর। দ্বিতীয়জন গ্রেপ্তারির নির্দেশ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদীদের কাছে ‘হিরো’ হয়ে উঠেছেন। দু’জনের এই দুই ভিন্নমুখী অবস্থান দেশে জন্ম দিল ‘মণ্ডল-মন্দির’ রাজনীতির। যার প্রভাব হল সুদূরপ্রসারি।
সমস্তিপুরের ঘটনার কথা আজও স্মৃতিতে টাটকা প্রবীণ সাংবাদিক এস ডি নারায়ণের। তাঁর কথায়, খুব ভোরে আমার টেলিফোনটা বেজে উঠল। অবাক হয়ে গেল। ওপ্রান্তে মুখ্যমন্ত্রী নিজে। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে লালুর কথা, কত ঘুমোতে হয়! জানতাম মুখ্যমন্ত্রী নিজেও দেরিতে ওঠেন। জানতে চাইলাম, আপনি এত সকাল সকাল, ব্যাপার কী? বাবা কো পাকাড় লিয়া (আদবানির গ্রেপ্তারি প্রসঙ্গে)। উত্তজিতভাবে জবাব দিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
এস ডি নারায়ণ হাজিপুর থেকে সমস্তিপুর এসেছিলেন আদবানির রথ অনুসরণ করে। তাঁর কথায়, হাজিপুরে আদবানির অভ্যর্থনা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু মাথায় হেলিকপ্টার চক্কর কাটতে দেখে মনে হয়েছিল, বড় কিছু একটা ঘটতে পারে। সব ফোনলাইন বন্ধ। সরকারিভাবে সাংবাদিক মহলে আদবানির গ্রেপ্তার হওয়ার খবর জানিয়েছিলেন সমস্তিপুরের জেলাশাসক আর কে সিং (পরে যিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব ও এখন বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী)।
সমস্তিপুর থেকে আদবানিকে উড়িয়ে আনা হয়েছিল দুমকায়। তোলা হয়েছিল একটি সরকারি গেস্ট হাউসে। কয়েকদিন পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। এই গ্রেপ্তারির ঘটনা নিশ্চিতভাবেই আদবানির রথযাত্রার আকস্মিক অবসান ঘটিয়েছিল। যদিও তার প্রভাবে ব্যাপক বিক্ষোভ ও সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে উত্তর ভারতের ছোটবড় বহু শহরে। সেই সঙ্গেই এই ঘটনা অসংখ্য করসেবককে অযোধ্যামুখী করে তুলল। আদবানির রথযাত্রা ও গ্রেপ্তারির রেশ টের পাওয়া গেল কিছুদিনের মধ্যেই। ৩০ অক্টোবর বাবরি মসজিদে অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিসি পদক্ষেপে প্রাণ গেল ২৮ করসেবকের। তখন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব। পরে এবিষয়ে মুলায়মের প্রতিক্রিয়া ছিল, দেশের ঐক্যের স্বার্থে যদি আরও বেশি মানুষকে মারতে হতো, তাহলে নিরাপত্তা বাহিনী সেটাই করত।
কেন্দ্রে তখন ভি পি সরকার। একদিকে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ মেনে সরকারি চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে আদবানির গ্রেপ্তারি। ভি পি সিং সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিল বিজেপি। আর আদবানির গ্রেপ্তারি একদিকে বিজেপিকে আরও রাজনৈতির মাইলেজ দিল। অন্যদিকে গেরুয়া বিরোধী শিবিরের মুখ হিসেবে লালুকে একেবারে সামনের সারিতে নিয়ে চলে এল। পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মসিহা ও সংখ্যালঘু মানুষের অধিকার রক্ষার যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি দিল তাঁকে।
ভারতীয় রাজনীতির দুই ভিন্নমুখী চরিত্র আদবানি ও লালুর জীবনের মধ্যগগনে ঘটেছিল সমস্তিপুর কাণ্ড। যদিও বর্তমান রাজনীতিতে তাঁরা দু’জনের এখন শিরোনামের বাইরে। বিজেপি রাজনৈতিক উত্থানের কারিগর আদবানি এখন কার্যত রাজনৈতিক সন্ন্যাসে। দলের প্রায় অস্তিত্বহীন ‘মার্গদর্শক মণ্ডলে’র সদস্য হিসেবে। আর লোকচক্ষুর অন্তরালে লালুর দিন কাটছে ঝাড়খণ্ডের জেলে।