পারিপার্শ্বিক কোনও ঘটনা চিন্তা বাড়াতে পারে। সাংস্কৃতিক কর্মে যোগদান ও মানসিক তৃপ্তিলাভ। শরীরের খেয়াল রাখুন। ... বিশদ
একমাস আগেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন চিকুর বাবা প্রেম কোহলি। ভোররাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে কাছাকাছি কোনও ডাক্তার পাওয়া যায়নি। অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়েছিল। তবে তা আসার আগেই সব শেষ! না ফেরার দেশে পাড়ি দেন প্রেম কোহলি। পিতৃশোকে চিকু তখন বিহ্বল। তাঁর মাথা থেকে হাত সরে গিয়েছে। সকালে কীভাবে রনজির ম্যাচে খেলতে যাবেন? কিন্তু তাঁকে ক্রিকেটার বানানো তো বাবারই স্বপ্ন! মাত্র তিন বছর বয়সে ব্যাট হাতে তুলে নেওয়া চিকুকে প্রথম ডেলিভারিও ছিল বাবার। বাবার হাত ধরেই আট বছর বয়সে প্রথমবার ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে যাওয়া! কী করবেন বুঝে উঠতে না পেরে কাঁদো কাঁদো গলায় চিকু ফোন করলেন কোচ রাজকুমার শর্মাকে। তিনি তখন অস্ট্রেলিয়ায়। গুরুর পরামর্শেই সেদিন বুকে পাথর চেপে মাঠে গেলেন তরুণ তুর্কি। ব্যাট হাতে আরও ৫০ রান যোগ করে দিল্লিকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুললেন। সেঞ্চুরিও আসতে পারত। তবে আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে ৯০ রানে আউট হন। তারপর বাড়ি ফিরে বাবার শেষকৃত্য করেন। সেই চিকু আর কেউ নন... ক্রিকেট তারকা বিরাট কোহলি। বর্তমানে বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা ব্যাটসম্যান।
দিল্লির সেই রনজি ম্যাচে খেলেছিলেন ইশান্ত শর্মাও। সম্প্রতি এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলছিলেন, ‘বিরাট বরাবরই হাসিখুশি থাকার ছেলে। ওকে কখনও আমি কাঁদতে দেখিনি। তবে সেদিন ওর অন্য রূপ দেখেছিলাম। ও ম্যাচের আগে আমায় পিক করতে আসত। তারপর আমরা প্যাটেলনগর থেকে ফিরোজ শাহ কোটলায় যেতাম। সেদিন আসেনি। মাঠে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা হলেও কোনও কথা বলেনি। আমিই গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, কী হয়েছে তোর? এত সিরিয়াস কেন? কোনও উত্তর দেয়নি। তারপর আমি ওর মাথায় হালকা চাপড় মারি। তখনও কোনও উত্তর নেই। সঙ্গে সঙ্গে পাশের একজন এসে আমায় জানায় ওর বাবার মৃত্যুর খবর। আমি রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে পড়ি। সেদিন ওর চোখে আগুন দেখেছিলাম। আর আজকের বিরাটকে দেখুন।’ সত্যিই, সেদিনের ঘটনা বিরাট কোহলিকে হঠাত্ বড় করে তুলেছিল। মানসিকভাবে তাঁকে ইস্পাত কঠিন বানিয়েছিল। তারপর থেকে বিরাটের একটাই স্বপ্ন, সফল ক্রিকেটার হয়ে বাবার স্বপ্নপূরণ করতে হবে। মা সরোজ দেবীর কথায়, ‘বিরাট সেদিনই কেমন বদলে গেল। একদিনেই যেন পরিণত হয়ে গিয়েছে। তারপর থেকে বাবার স্বপ্নটাকেই নিজের স্বপ্ন বানিয়ে ফেলল বিরাট। ক্রিকেট ছাড়া কিছু ভাবতেই পারত না। সব ম্যাচ গুরুত্ব সহকারে দেখত। বেশিরভাগ সময় প্র্যাকটিসেই পড়ে থাকত। মাঠে নামতে না দিলে বিরক্ত হতো।’
আর পিছনে তাকাননি কোহলি। ২০০৮ সালে মালয়েশিয়াতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন করা হয় বিরাটকে। দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে খেতাবও জেতান তিনি। টুর্নামেন্টে তৃতীয় সর্বাধিক রান সংগ্রাহক ছিলেন চিকু। প্রচারের আলো কেড়ে সেবছরই আইপিএলে নাম লেখান। তাঁকে ১২ লক্ষ টাকায় দলে নেয় রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। আর শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালে ১৮ ডিসেম্বর বাবা প্রেম কোহলির স্বপ্ন সার্থক করেন চিকু। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে বিরাটের। কাকতালীয়ভাবে তাঁর বাবার মৃত্যুর তারিখও ছিল ১৮। তাই বিরাট বেছে নেন ১৮ নম্বর জার্সি। কিন্তু আফশোস একটাই, এই দিনটা তাঁর বাবা দেখে যেতে পারলেন না। মাত্র তিন বছর বয়সে তাঁর ক্রিকেটীয় প্রতিভা তো প্রথম বাবার চোখেই পড়েছিল। পাড়ার ক্রিকেটে যেদিন আট বছরের চিকু দুরন্ত পারফরম্যান্স মেলে ধরেছিল, সেদিন বাবাই তো তাঁকে রাজকুমার শর্মার অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করেছিলেন। তাঁর বাবাই শিখিয়েছিলেন, অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করতে। অনূর্ধ্ব-১৪ দিল্লি টিম থেকে বিরাটকে রাতারাতি বাদ দেওয়া হয়। কারণ, প্রেম কোহলি ঘুষ দিতে অস্বীকার করেছিলেন। সেদিন বাবা সদর্পে বলেছিলেন, ‘ছেলেকে খেলানোর জন্য আমি এক টাকাও ঘুষ দেব না। ও নিজের প্রতিভায় মাথা তুলে দাঁড়াবে।’ বিরাট সেটা পেরেছেন। তিনি শুধু ভারতের জার্সিই গায়ে চাপাননি, জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ওডিআই এবং টি-২০ বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতাতে বড় অবদান রেখেছেন। একের পর এক মাইলস্টোনের সিংহাসন চড়ে ‘কিং কোহলি’ বনেছেন। বিরাট শুধু তাঁর বাবাকে নন, গোটা দেশকে গর্বিত করেছেন।
শচীন তেন্ডুলকরের যোগ্য উত্তরসূরি বিরাট। মাস্টার ব্লাস্টার্সের একের পর এক রেকর্ড ভেঙে ভারতীয় ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তিনি। একদিনের ক্রিকেটে সর্বাধিক ৫১ সহ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মোট ৮২টি সেঞ্চুরির মালিক ভিকে। তাঁর সামনে কেবল শচীনের ১০০ সেঞ্চুরি। অথচ কোহলি কোনওদিন ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভার অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু নিজেকে ঘষে মেজে তিনি সেরার সেরা বানিয়েছেন। অনেকটা ক্রিশ্চিয়োনা রোনাল্ডোর মতো। তাই এই পর্তুগিজ ফুটবল মহাতারকাকে আইডলও মানেন তিনি। ক্রিকেটে ফিটনেসের শৃঙ্খলা বিরাটই এনেছেন। ২০১২ সালে ভারতের কোচ ডানকান ফ্লেচার একবার বলেছিলেন, ‘পেশাদার খেলার মধ্যে ক্রিকেট সবচেয়ে অপেশাদার। কারণ, এতে টেনিস বা ফুটবলের মতো ফিটনেস লাগে না। তবে সেরা ফর্মে থাকতে হলে তোমাকে ফিটনেস বজায় রাখতে হবে।’ ডানকানের কথা সেদিন বিরাটকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তারপর থেকে ফিটনেসের সঙ্গে কোনও সমঝোতা করেননি তিনি। যে ছেলের ছোলা বাটোরা, বাটার চিকেন ছাড়া চলত না, তিনি এখন ভাত, রুটি পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখেন না। সেদ্ধ সব্জি, চিকেন এসবই তাঁর ডায়েটে থাকে। আর তার ফলও মিলছে হাতেনাতে। জাতীয় দলে ১৭ বছর প্রতিনিধিত্বের পরও বিরাটের ফিটনেস তরুণদের লজ্জায় ফেলবে। তাঁর আগ্রাসনকে অস্ট্রেলিয়াও ভয় পায়। কিন্তু মাঠের বাইরে বিরাট যেন সৌহার্দ্যের দূত। তাঁর ব্র্যান্ডভ্যালুর জন্যই ওলিম্পিকসে ক্রিকেটের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। সবমিলিয়ে দিল্লির সেই ছোট্ট চিকু এখন বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আইকন।