পড়ে গিয়ে বা পথ দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্তির যোগ থাকায় সতর্ক হন। কর্মে উন্নতি ও সাফল্যের যোগ। ... বিশদ
৬ ডিসেম্বর ১৯৯৩! আমার প্রিয় বান্ধবী দলজিত্ আমায় ছুটি নিতে বাধ্য করেছে। ওর দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম। অগত্যা সকাল থেকেই হাসপাতালে আমি। বান্ধবীর স্বামী কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়েছেন। এমন সময় নার্স এসে একটি লিকলিকে রোগা সদ্যোজাতকে আমার কোলে ধরিয়ে দিয়ে গেলেন। বাচ্চাটা যেন হাসতে চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। ডাক্তার দ্রুত তার চিকিত্সা শুরু করলেন। কয়েক বছর পর দলজিতের স্বামী যশবীর মারা গেলেন। তাঁদের পরিবারে যেন কালবৈশাখী ঝড়। খুব অসহায় পরিস্থিতি। সংসার চালাতে দিনে ১৬-১৮ ঘণ্টা কাজ করত দলজিত্। ওই সময় বাচ্চা দুটোকে আমিই সামলেছি। ওদের পড়াতাম। কিন্তু ছোট ছেলেটার পড়াশোনায় তেমন মন ছিল না। সস্তা প্লাস্টিকের বল নিয়ে শুধু খেলে বেড়াত। আমি তখন জুনিয়র সাংবাদিক। বেতনও বেশি ছিল না যে, ওদের সাহায্য করব। ছোট ছেলেটার জন্য এক প্যাকেট দুধ কিনতে গিয়েও হিমশিম খেতে হতো দলজিৎকে। তবে, ছেলেটা মুখে কিছু বলত না। খুব শান্ত-নম্র। আমার বেতন বৃদ্ধির পর ওকে একটা উইন্ডচিটার কিনে দিয়েছিলাম। তাতে যে কী খুশি! বলে বোঝাতে পারব না।’
— সেই লিকলিকে, দুর্বল ছেলেটি আর কেউ নন, যশপ্রীত বুমরাহ! এই মুহূর্তে তিনটি ফরম্যাটে বিশ্বের সেরা ক্রিকেটার। এই ক্রিকেট তারকার ছোটবেলার জীবন সংগ্রামের গল্প প্রকাশ্যে এনেছেন তাঁর মায়ের বান্ধবী দীপাল ত্রিবেদী। চলতি বছরে ভারতকে টি-২০ বিশ্বকাপ জেতানোয় বড় ভূমিকা রেখেছিলেন ‘বুমবুম বুমরাহ’। টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন। সেই রাতেই যশপ্রীতের জীবনের গল্প সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন দীপাল ত্রিবেদী। ক্রিকেট খুব একটা বোঝেন না তিনি। বিরাট কোহলিকেও চেনেন বলিউড অভিনেত্রী অনুষ্কা শর্মার স্বামী হিসেবে। তবুও সেই ছোট্ট ছেলেটার সাফল্যের দিনে আবেগ চেপে রাখতে পারেননি। তিনি যে চোখের সামনে লিকলিকে অসুস্থ ছেলেটাকে কিংবদন্তি হতে দেখেছেন। তাই পোস্টের শেষে তিনি লিখেছিলেন, ‘এই পোস্টটা আমার জীবনের নায়ককে ঘিরে।’ না বুমরাহ এখন শুধু দীপালের নয় আগামী প্রজন্মেরও নায়ক।
গুজরাতের আমেদাবাদে জন্ম বুমরাহর। তাঁর বাবা যশবীর সিং কেমিক্যালের ব্যবসা করতেন। আর মা দলজিত্ ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। ছোটবেলায় বুমরাহ খুব একটা কথা বলতেন না। চেহারার জন্য তাঁকে নিয়ে পরিবারের চিন্তার শেষ ছিল না। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই বাবাকে হারান ভারতীয় দলের এই পেসার। মা দলজিতের ওপর সংসারের সমস্ত ভার এসে পড়ে। বলাই বাহুল্য, বুমরাহের ছোটবেলাটা খুবই কষ্টে কেটেছে। নির্মাণ হাইস্কুলে দলজিত্ পড়াতেন, সেখানেই ছেলেকে ভর্তি করেন তিনি। আর এই স্কুলেই ক্রিকেটে পথচলা শুরু হয় বুমরাহের। প্রতিদিন স্কুল শেষে বল নিয়ে মাঠে নেমে পড়তেন তিনি। তাঁর ইউনিক বোলিং অ্যাকশন নজরে আসে কোচ কিশোর ত্রিবেদী ও কেতুল পুরোহিতের। নেটে যশপ্রীতের বোলিং দেখে হীরে চিনে নিতে ভুল হয়নি তাঁদের। এক সাক্ষাত্কারে কিশোর বলেছেন, ‘শর্ট রানআপেও বুমরাহের বলের গতি বিপক্ষ ব্যাটারদের সমস্যায় ফেলত। ওর কুইক আর্ম অ্যাকশন সবার থেকে আলাদা। আমাদের মনে হয়েছিল, ঠিকমতো গাইড পেলে ওর ভবিষ্যত্ উজ্জ্বল। লাইন-লেংথে সামান্য কাজ করতে হবে।’
কয়েক বছর যেতে না যেতেই লোকাল ক্রিকেটের সেনসেশন বনে যান বুমরাহ। ধারাবাহিকভাবে তাঁর ১৪০ কিমি প্রতি ঘণ্টার ডেলিভারিতে সর্ষে ফুল দেখতেন ব্যাটাররা। বুমরাহর সৌজন্যে ওই সময় নির্মাণ স্কুলও হারতে ভুলে গিয়েছিল। তবে তাঁর ক্রিকেট খেলায় মায়ের আপত্তি ছিল। কারণ, তিনি মনে করতেন, তাঁর ছোট ছেলে ততটাও শৃঙ্খলাপরায়ণ নয়। আর খেলোয়াড় হতে হলে শৃঙ্খলার একান্ত প্রয়োজন। একদিন স্কুলের কোচ কিশোর ত্রিবেদীকে ফোন করেন বুমরাহের মা। এই প্রসঙ্গে কোচের স্মৃতিচারণা, ‘ওর মা ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন, ক্রিকেটে ছেলের আদৌ কোনও ভবিষ্যৎ আছে কি না? আমি তাঁকে আশ্বস্ত করি। বলি, ছেলেকে দুটো বছর সময় দিন।’ এই পর্বে ক্রিকেটে অভূতপূর্ণ উন্নতি করেন বুমরাহ। সুইং, ইয়র্কারে শান দিয়ে আরও পরিণত হন। আর ১৯ বছর বয়সে আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স টিমে ডাক পাওয়াটা তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। সেই সময় ফ্র্যাঞ্চাইজিটির স্কাউটিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন জন রাইট। ভারতের প্রাক্তন কোচ ভবিষ্যতের রত্নকে ঠিক চিনে নিয়েছিলেন। তবে তারপরও তাঁর সফর অত সহজ ছিল না। ভিন্ন বোলিং অ্যাকশনের জন্য জেলার অনূর্ধ্ব-১৯ টিমে পর্যন্ত রিজার্ভ হিসেবে থাকতে হয়েছিল বুমরাহকে। তবে সুযোগ পেয়ে জাত চেনাতেও ভুল হয়নি স্পিডস্টারের। এক ম্যাচেই সাত উইকেট নিয়ে চমক দিয়েছিলেন। আইপিএলেও সেবছর তিনটির বেশি ম্যাচ পাননি তিনি। তারমধ্যেই বিরাট কোহলিকে আউট করে শিরোনামে আসেন বুমবুম। ক্রোড়পতি লিগে নজর কেড়ে গুজরাতের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে সুযোগ পান এই ডানহাতি পেসার। কিন্তু ২০১৫-’১৬ মরশুমে বিজয় হাজারে ট্রফিতে বুমরাহের বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আম্পায়াররা। যদিও গুজরাত টিম ম্যানেজমেন্টের হস্তক্ষেপে সমস্যাটি মিটে যায়। সেই ঘটনার একমাস পর ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারতের জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় যশপ্রীত বুমরাহের। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। লিকপিকে সেই দুর্বল ছেলেটি এখন ভারতের বোলিংয়ের স্তম্ভ, লিডার। শুধু ভারতের কেন বিশ্বের সেরা পেসার। তাঁর দু’দিকে সুইং, বিষাক্ত ইয়র্কার, ভয় ধরানো বাউন্সার বা বুদ্ধিদীপ্ত স্লোয়ারে খাবি খান প্রতিপক্ষ ব্যাটাররা। সম্প্রতি আইপিএলে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার চালু হওয়ায় ব্যাটারদেরই দাপট থাকে। তবে বুমরাহ উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি বল হাতে তুললেই যেন ম্যাচের রং বদলে যায়। তাঁর চার ওভার কোনওক্রমে পার করতে পারলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন ব্যাটাররা। চলতি বছর টি-২০ বিশ্বকাপের ফাইনালেও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হারতে বসেছিল ভারত। কিন্তু শেষদিকে বুমরাহের বোলিংয়েই ম্যাচে ফেরে ভারত। সম্প্রতি বর্ডার-গাভাসকর ট্রফিতেও বল হাতে আগুন ঝরিয়েছেন। তাঁর দাপটেই পারথ টেস্টে ভারতের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে অস্ট্রেলিয়া। শচীন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, এম এস ধোনি কিংবা বিরাট কোহলিরা ব্যাট হাতে প্যাভিলিয়ন থেকে বেরতেই গলা ফাটাচ্ছেন সমর্থকরা— এটা ক্রিকেট মাঠের চেনা ছবি। আর এখন বুমরাহ বল হাতে তুললেও ‘বুমবুম’ স্লোগানে উত্তাল হয় গ্যালারি।