সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
১৯০৬-এর ১৮ অক্টোবর থেকে ১৯০৮-এর ৩০ এপ্রিল। এই ১ বছর ৫ মাস অরবিন্দ ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকায় অবিরাম আগুন ঝরানো ভাষায় লিখে গিয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক মতবাদ। সেই ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম অগ্রনায়ক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়।
তাঁকে ‘স্বদেশির বাউল’ অভিধায় আখ্যায়িত করেন মতিলাল রায়। আন্দামানে দীপান্তরিত জীবনের দুঃসহ অধ্যায় পেরিয়ে এসে উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’ গ্রন্থখানির প্রারম্ভেই স্মরণ করেন ‘উপাধ্যায় মহাশয়কে’।
উপেন্দ্রনাথ লিখছেন ‘১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে তখন শীতকাল। আসর বেশ গরম হইয়া উঠিয়াছে। উপাধ্যায় মহাশয় সবেমাত্র সন্ধ্যায় চাটিম চাটিম বুলি ভাজিতে আরম্ভ করিয়াছেন; অরবিন্দ জাতীয় শিক্ষার জন্য বরোদার চাকরি ছাড়িয়া আসিয়াছেন; বিপিনবাবুও পুরাতন কংগ্রেসীদল হইতে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছেন; সারা দেশটা যেন নূতনের প্রতীক্ষায় বসিয়া আছে। আমি তখন সবেমাত্র সাধুগিরির খোলস ছাড়িয়া জোর করিয়া মাস্টারিতে মনটা বসাইবার চেষ্টা করিতেছি, এমন সময় এক সংখ্যা বন্দেমাতরম হঠাৎ একদিন হাতে আসিয়া পড়িল।’ তিনি দেশের রক্তে যে অগ্নিজ্বালা বইয়ে দেন সে-কারণেই হয়তো বিপিনচন্দ্র পালের সুস্পষ্ট উক্তি, ‘এক হিসেবে উপাধ্যায় ব্রহ্মবান্ধব এই আন্দোলনের স্রষ্টা।’
রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘তিনি ছিলেন রোমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসী, অপরপক্ষে বৈদান্তিক, তেজস্বী, নির্ভীক, ত্যাগী, বহুশ্রুত ও অসামান্য প্রভাবশালী। অধ্যাত্মবিদ্যায় তাঁর অসাধারণ নিষ্ঠা ও ধীশক্তি আমাকে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় আকৃষ্ট করে।’
গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী প্রশ্ন তুলেছেন ‘কিন্তু উপাধ্যায় কি অরবিন্দের মত বিপ্লববাদী এবং বিপ্লবী ছিলেন?’
এই প্রশ্নের উত্তর-সন্ধানে নিজেই বললেন, ‘এর জবাব এককথায় দেওয়া সম্ভব নয়। ছেলেবয়সে যুদ্ধবিদ্যা শিখিবার জন্য তিনি দুইবার গোয়ালিয়রে পলাইয়া গিয়াছিলেন। যুদ্ধবিদ্যা শিখিবার জন্য অরবিন্দ যতীন্দ্র ব্যানার্জ্জীকে গায়কবাড়ের সৈন্যশ্রেণীতে ভর্ত্তি করিয়া দিয়াছিলেন। প্রকাশ্য যুদ্ধ বা বিদ্রোহের জন্যই লুকাইয়া যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষার প্রয়োজন। কিন্তু যুগান্তরের আড্ডায় যে বোমা তৈরী হয়, এ কথা উপাধ্যায় শুনিতে পান এবং সেখানে গিয়া অবিনাশ ভট্টাচার্য্যকে বলেন— আমাকে একটা বোমা দাও, আমি উহা প্রথম ছুঁড়িব।’
১৯০৭ সালে অরবিন্দ অসুস্থ হয়ে কিছুদিন ছিলেন দেওঘরে মামার বাড়িতে। তখন ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের ‘যুগান্তর’ সংশ্লিষ্ট একটি কাজের ব্যাপারে অরবিন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ জরুরি হয়ে পড়ে। তিনি কেশবচন্দ্র সেনগুপ্তকে নিয়ে যান দেওঘরে। সেখানে থাকেন চারদিন। বারীন ঘোষও ছিলেন সেখানে। তখন ভূপেন্দ্রনাথকে একটি ইংরেজি বই পড়তে দেন বারীন ঘোষ। বইটির নাম Que Vadis।
ভূপেন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণায় জানা যায়— ‘পোলীয় স্বদেশ প্রেমিক সিনকিভিট্জ (Sincievity) দ্বারা রুশ-জারের অত্যাচারের কথাই রোম-সম্রাট নিরো দ্বারা খ্রীষ্টানদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচারের কাহিনীরূপে চিত্রিত হইয়াছে। পুনঃ, বারীনবাবু বলিলেন, গ্রন্থকার তাঁহার মধ্যম ভ্রাতার (Prof. M.Ghose-এর) বন্ধু। এই পুস্তকে কী প্রকারে প্রাচীন খ্রীষ্টানেরা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ (Passive Resistance) দ্বারা রোম-সম্রাটের অত্যাচার প্রতিহত করিত তাহাই বর্ণিত আছে। আসলে, এই পুস্তক রূপকভাবে পোলীয় দেশ প্রেমিকেরা রুশ-সম্রাটের অত্যাচার কীরূপে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ দ্বারা প্রতিহত করিত তাহারই বর্ণনা আছে। আমি এই পুস্তক পড়িয়া উৎসাহন্বিত হই। কলিকাতায় ফিরিয়া আমি উপাধ্যায়জীকে এই পুস্তকের প্রতিপাদ্য নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ মতবাদের কথা বলি। তিনি উত্তর দিলেন, উহাতে আমাদের হবে না। শুনিয়া মনটা দমিয়া গেল। কিন্তু তৎকালে বিপিনচন্দ্র পাল মহাশয় Passive Resistance অবলম্বন করিবার জন্য বক্তৃতা করিতেন।’
তরুণ বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ জেলে যাবার দিন সকালবেলা গিয়েছিলেন ব্রহ্মবান্ধবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সেই দেখাই ছিল শেষ দেখা। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লেখেন— ‘উপাধ্যায়জীর সহিত আমার সম্বন্ধের যবনিকা পতন হইল যখন আমি জেলে যাইবার দিন সকালে তাঁহার কাছ হইতে বিদায় নিতে যাই। তিনি তখন অসুস্থ ছিলেন। আমায় দেখে সাশ্রুনয়নে বলিলেন, তুমি জেলে যাবে, আর আমি ঘরে বসে থাকব।’
প্রকৃত নাম তাঁর ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম ১৮৬১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি— কলকাতা থেকে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ মাইল দূরে খন্যান গ্রামে (হুগলি জেলা)। প্রথমে কেশব সেনের আকর্ষণে তিনি ব্রাহ্ম, পরে কাকা কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাবে দীক্ষিত হন খ্রিস্টধর্মে। করাচি গিয়ে ‘Sophia’ পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন ১৮৯৪ সালের জানুয়ারি থেকে। গৈরিক ধারণ করে সন্ন্যাসীর জীবনযাপনের সঙ্গে নাম গ্রহণ করেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়।
১৯০০ সালে কলকাতায় ফিরে এক বন্ধুর সহায়তায় তিনি অনাথ প্রতিবন্ধীর একটি আশ্রম স্থাপন করেন। সহায় সম্বলহীন খঞ্জ, বিকলাঙ্গ, দৃষ্টিহীনদের কুড়িয়ে এনে রেখেছিলেন ছিদাম মুদি লেনে। নিজেরই যখন অন্নসংস্থান ছিল না, এমন দুঃসময়ে প্রায় ভিক্ষা করে এনে তাদের খাওয়াতেন।
কিছুকাল পরে ব্রহ্মবান্ধব ও তাঁর বন্ধু ক্ষেমচাঁদ কাগজ প্রকাশনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তখন কার্তিকচন্দ্র নানের বেথুন রো-র বাড়ি ছিল ব্রহ্মবান্ধবের অফিস ও বাড়ি। এই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ আসতেন— কখনও ঘোড়ার গাড়িতে— কখনও হেঁটে। ‘কার্তিকবাবু আছেন?’ বলে ডাক দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলার বারান্দায় এসে মেঝেতে বসা গৈরিকধারী ব্রহ্মবান্ধবের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করতেন। রবীন্দ্রনাথের বসার জন্য একটি চেয়ার আনা হতো। কবি ও বিদ্রোহী সন্ন্যাসীর মধ্যে গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠতা। সেই সময় ব্রহ্মবান্ধবকে জানলেন, শান্তিনিকেতন আশ্রমে একটি আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের অনুমতি পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘তিনি (ব্রহ্মবান্ধব) আমাকে বললেন, এই সংকল্পকে কাজে প্রতিষ্ঠিত করতে বিলম্ব করবার প্রয়োজন নেই। তিনি তাঁর কয়েকটি অনুগত শিষ্য ও ছাত্র নিয়ে আশ্রমের কাজে প্রবেশ করলেন। তখন আমার তরফে ছাত্র ছিল রথীন্দ্রনাথ ও তার কনিষ্ঠ শমীন্দ্রনাথ। আর অল্প কয়েকজনকে তিনি যোগ করে দিলেন। ... তখন যে কয়টি ছাত্র নিয়ে বিদ্যালয় আরম্ভ হল, তাদের কাছ থেকে বেতন বা আহার্য্য ব্যয় নেওয়া হতো না। তাদের জীবনযাত্রার প্রায় সমস্ত দায় নিজের স্বল্প সম্বল থেকেই স্বীকার করেছি। অধ্যাপনার অধিকাংশ ভার যদি উপাধ্যায় ও শ্রীযুক্ত রেবাচাঁদ— তাঁর এখনকার উপাধি অণিমানন্দ— বহন না করতেন তাহলে কাজ চালানো একেবারে অসাধ্য হত। তখনকার আয়োজন ছিল দরিদ্রের মতো। আহার ব্যবহার ছিল দরিদ্রের আদর্শে। তখন উপাধ্যায় আমাকে গুরুদেব উপাধি দিয়েছিলেন আজ পর্যন্ত আশ্রমবাসীদের কাছে আমাকে সেই উপাধি বহন করতে হচ্ছে...। এই সঙ্গে উপাধ্যায়ের কাছে আমার অপরিশোধনীয় কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি।’
শুধু মনীষা নয়, বিস্ময়কর ছিল ব্রহ্মবান্ধবের পাণ্ডিত্য। সংস্কৃত, লাতিন, ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি, উর্দু, মারাঠি প্রভৃতি ভাষায় ছিলেন সুদক্ষ। খ্রিস্টান থিওলজি, বেদান্ত, সাংখ্য, সুফি প্রভৃতি দর্শনশাস্ত্রে ছিল অগাধ ব্যুৎপত্তি।
ব্রাহ্মসমাজের প্রিয়নাথ মল্লিক তাঁকে ও তাঁর সুহৃদ নরেন্দ্রনাথ দত্তকে পরিচয় করিয়ে দেন কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে। কেশব সেন ও তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে, আবার কখনও কখনও একাও তরুণ ভবানীচরণ যেতেন দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে।
ব্রহ্মবান্ধবের ছিল অফুরন্ত মনের বল, উদ্যম ও দৈহিক শক্তি। শ্রীরামকৃষ্ণেরও হয়তো তাঁকে দেখে মনে এসেছিল সে-কথা।
গৌরগোবিন্দ গুপ্ত (শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের প্রারম্ভে সুধীরকুমার নানের সহপাঠী ও বন্ধু, পরে রংপুর কলেজের দর্শনের অধ্যাপক) বাল্যে ও কৈশোরে সংস্পর্শে আসেন ব্রহ্মবান্ধবের। তিনি ব্রহ্মবান্ধবের কাছে শুনেছেন— শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন ব্রহ্মবান্ধবকে (তখন তিনি নবযুবক ভবানীচরণ) বলেছিলেন, ‘তুই ঘোড়া হ, আমি তোর পিঠে চড়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলব’ এবং তাই করেছিলেন।
এ সম্বন্ধে মনোরঞ্জন গুহ লিখেছেন ‘ব্রহ্মবান্ধবের প্রথম জীবনের স্মৃতি বোধহয় শেষ জীবনে তারমধ্যে এইরকম একটা ধারণা জাগিয়েছিল যে, পরমহংসদেব তাঁকেও নিজের একজন বাহনরূপে চিহ্নিত করে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেই পরম অনুগ্রহ দ্বারা তাঁর উপর যে দায় ন্যস্ত হয়েছিল তার চেতনা বড় বিলম্বে এসেছে। হয়তো সেই জন্যই শেষ জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণের কথা যা লিখেছিলেন তাতে একটা বিষাদ ও কাতরভাব দেখা যায়— যেন যা করার ছিল করতে পারেননি বলে অনুতপ্ত।’
তবু বলা যায়— শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদধন্য এই রুদ্রপুরুষ আমৃত্যু অশ্বশক্তির বেগ, গতি ও শক্তি নিয়ে বেঁচেছিলেন, কোনও চ্যালেঞ্জের সামনে পিছপা হননি কখনও। তাঁর বীরত্ব-কথা লিখেছেন শান্তিনিকেতন আশ্রমের শিষ্য রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃস্মৃতি’ গ্রন্থে।
‘একদিন একটি পাঞ্জাবি পালোয়ান কী করে হঠাৎ শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হল। কুস্তি শেখবার জন্য আমরা একটি আখড়া তৈরি করেছিলুম। সেই দেখে পালোয়ানটির মহা উৎসাহ, পোশাক ছেড়ে সেখানে দাঁড়িয়ে তাল ঠুকতে লাগল। তার বিপুল বলিষ্ঠ দেহ দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে রইলুম, কারও সাহসে কুলোল না তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তার সঙ্গে লড়াইতে নেমে যায়। সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ দেখি উপাধ্যায় মহাশয় কৌপীন পরে সেখানে এসে উপস্থিত। তিনি তাল-ঠুকে পালোয়ানকে লড়াই করতে আহ্বান করলেন। বাঙালি সন্ন্যাসীর কাছেই শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাবি পালোয়ানকে হার মানতে হল। আমাদের তখন কী আনন্দ!’
এক সময় নর্মদা তীরে নির্জন স্থানে আশ্রম স্থাপনের অভিপ্রায়ে ব্রহ্মবান্ধব ভ্রমণ করেন নানা জায়গায়। জীবনের অন্তিম পর্বে অন্তর গভীরে শুনতে পান জাতীয় মুক্তির মন্ত্র। তাঁর মনে প্রজ্জ্বলিত অনির্বাণ দীপশিখার মতো স্বরাজলাভের স্বপ্ন।
১৩১৩ সালের ২৬ ফাল্গুন ‘স্বরাজ’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় ‘স্বরাজ-গড়’ শীর্ষক এক কালজয়ী নিবন্ধে ব্রহ্মবান্ধব লেখেন—
‘আমার ঘর নাই— পুত্র কলত্র কেহই নাই। আমি দেশে দেশে ঘুরিয়া বেড়াইতাম। শেষে শ্রান্ত ক্লান্ত হইয়া মনে করিয়াছিলাম যে, নর্মদাতীরে এক আশ্রম প্রস্তুত করিয়া সেই নিভৃত স্থানে ধ্যান-ধারণায় জীবন অতিবাহিত করিব। কিন্তু প্রাণে প্রাণে কি এক কথা শুনিলাম। ... ভারত আবার স্বাধীন হইবে— এখন নির্জনে ধ্যান-ধারণার সময় নয়— সংসারের রণরঙ্গে মাতিতে হইবে। ... আমি চন্দ্র দিবাকরকে সাক্ষী করিয়া বলিতেছি যে, আমি ঐ মুক্তির সমাচার প্রাণে প্রাণে শুনিয়াছি। ... আমি নর্মদার আশ্রম ছাড়িয়াছি বটে, কিন্তু আমার হৃদয়ে আর একটি আশ্রমের নূতন ছবি ফুটিয়াছে। আমি দেখিতেছি স্থানে স্থানে স্বরাজ-গড় নির্মিত হইয়াছে। সেখানে ফিরিঙ্গির সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক থাকিবে না। আমার জপ-তপ বাঁধন-ছাঁদন সব ঘুচিয়া গিয়াছে— আকুল পাগলপারা উধাও হইয়া বেড়াইতেছি। আর গোলাম-গড়ে থাকিতে চাই না— ঐ স্বরাজ-গড় গড়িতে স্বরাজতন্ত্রের প্রজা হইতে আমার প্রাণ সদাই আনচান।’
ব্রহ্মবান্ধব বার করলেন ‘সন্ধ্যা’ কাগজ। লেখায় জ্বলে উঠল আগুন। ‘সন্ধ্যা’ পড়বার জন্য সাধারণের মধ্যে পড়ে যায় কাড়াকাড়ি। প্রচণ্ড বিদ্রূপাত্মক সুরে উপাধ্যায় জ্বালাময়ী ভাষায় লিখে গেলেন একের পর এক বিস্ফোরক নিবন্ধ। যেমন, ‘আমাদের পোয়াবারো ফিরিঙ্গির তেরো’ (৭ আগস্ট, ১৯০৭)।
‘আজ কালীঘাটে জোড়া পাঁঠা একটি কালো একটা সাদা’ (৯ আগস্ট, ১৯০৭)।
‘ফিরিঙ্গি পরম দয়ালু, ফিরিঙ্গির কৃপায় দাড়ি গজায় শীতকালে খাই শাকালু’ (২১ আগস্ট, ১৯০৭)
‘ঢেঁকী অবতার’ (৩০ আগস্ট, ১৯০৭)।
‘গোদা পার ভোঁথা লাথি’ (৩ সেপ্টেম্বর, ১৯০৭)। ‘দুশো মজা তিলাই খাজা’ (৪ সেপ্টেম্বর, ১৯০৭) ইত্যাদি।
ভবিষ্যদ্দ্রষ্টার দৃষ্টির আলোয় উপাধ্যায় মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ফিরিঙ্গির কারাগার পারবে না তাঁকে রুদ্ধ করে রাখতে।
‘ফিরিঙ্গি’ শব্দটি শ্লেষ বা ব্যাঙ্গোক্তি হিসেবে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করতেন ব্রহ্মবান্ধব। সেকালের অনেকের মতো বিবেকানন্দও ‘ফিরিঙ্গি’ কথাটি বলতেন পরিহাসের সুরে। ভিন্নতর প্রসঙ্গের হলেও এখানে অবতারণা করা যেতে পারে স্বামীজির লন্ডনে অতিবাহিত দিনগুলির একটি ঘটনার।
১৮৯৬ সালে লন্ডনে স্বামীজির বেদান্ত-দর্শন-বিষয়ক বক্তৃতাগুলি বিধৃত করেন পঁচিশ বছর বয়সি এক সুদক্ষ স্টেনোগ্রাফার। নাম তাঁর জে জে গুডউইন। সর্বনেশে জুয়ার নেশায় ব্যর্থ হতে বসেছিল তাঁর যাবতীয় স্বপ্নসাধ। এমন সময়ে বিবেকানন্দের সংস্পর্শে এসে পাল্টে যায় তাঁর জীবন। স্বল্পায়ু গুডউইনের জীবনের এরপরের ঘটনাপ্রবাহ— ঠিক যেন এক টানটান উপন্যাসের কাহিনি।
দু’বছর পরে সাতাশ বছর বয়সে সেই গুডউইনের হঠাৎ মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে বিবেকানন্দের সজল নয়নে কী করুণ আর্তনাদ, বলে উঠেন — ‘বুঝলাম, পুত্রশোক কী ভয়ংকর।’
১৮৯৬ সালে স্বামীজির সহোদর মহেন্দ্রনাথ দত্ত আসেন লন্ডনে। তরুণ মহেন্দ্রনাথের তখন কোঁকড়ানো কোঁকড়ানো দাড়ি। লন্ডনের সম্ভ্রান্ত সমাজে অমন দাড়ি রাখা শোভন ছিল না। তাই বিবেকানন্দ একদিন গুডউইনকে বললেন— ‘একে একটা সেলুনে নিয়ে গিয়ে দাড়িটা ছাটিয়ে আনো।’
স্বামীজির কথামতো উৎসাহভরে তিনি মহেন্দ্রনাথকে নিয়ে গেলেন কাছাকাছি বঙ্গাট্জ্ (Bongartx) নামক এক জার্মান সেলুনে।
ক্ষৌরকার গুডউইনের কথামতো ছুঁচোলো করে ফ্রেঞ্চ ফ্যাশনে দাড়ি কাটতে লাগলেন। মহেন্দ্রনাথ বুঝতে পারছিলেন— ওরকম ফ্রেঞ্চকাট তাঁকে মোটেই মানাবে না। কিন্তু মৃদু আপত্তি জানাতেই গুডউইনের কড়া ধমক খেয়ে আর কিছু বলতে সাহস পেলেন না এবং কোকঁড়ানো দাড়ির বদলে ছুঁচোলো ছাগলদাড়ি নিয়ে ফিরে এলেন।
ভাইকে অমন দাড়িতে দেখে বিবেকানন্দ প্রথমে চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে রইলেন— তারপর অট্টহাসিতে বললেন— ‘আরে ছ্যাঃ, ঠিক চুনোগলির ফিরিঙ্গি হয়েছে।’
যৌবনে ক্যাথলিক সন্ন্যাসী, অন্তিম জীবনে বৈদান্তিক— তেজস্বী, ত্যাগী দেশসেবক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের যেন মানসপুত্র অরবিন্দ। মৃত্যুর বছরখানেক পূর্বে ‘সন্ধ্যা’ কাগজে অরবিন্দকে বিপ্লবের রণক্ষেত্রে আবাহন করে তিনি লেখেন, ‘মানস সরোবরে অরবিন্দ’ শীর্ষক এক অসাধারণ সন্দর্ভ। এই নিবন্ধের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে ফিরিঙ্গি-শ্লেষের বিচিত্র রঙ্গরসের জাদু। উপাধ্যায় লেখেন—
‘অমল-শুভ্র অরবিন্দ দেখিয়াছ কি? ভারত-মানস-সরোবরে প্রস্ফুটিত শতদল! এ ফিরিঙ্গীর আঁদাড়ে-পাঁদাড়ের লিলি ড্যাফোডিল নহে নির্গন্ধ! শুধু রঙের বাহার! কেবল বর্ণবিলাস!! দেবতার পূজায় লাগে না। যাগ-যজ্ঞে অনাবশ্যক। শুধু সাহেব বিবির সাহেবিয়ানার আড়ম্বর!! আমাদের এই অরবিন্দ জগৎদুর্লভ। হিমশুভ্র বর্ণে সাত্ত্বিকতার দিব্য শ্রী! বৃহৎ ও মহৎ!! হৃদয়ের প্রসারতায় বৃহৎ! হিন্দুর স্বধর্ম মহিমায় মহৎ!! এমন একটা গোটা ও খাঁটি মানুষ— এমন বজ্রের মত বহ্নিগর্ভ, আবার কমল পর্ণের ন্যায় কান্ত-পেলব, এ হেন জ্ঞানঢ্য, এমন ধ্যান-সমাহিত মানুষ তোমরা ত্রিভুবনে খুঁজিয়া পাইবে না। দেশ-মাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জন্য ইনি ফিরিঙ্গির সভ্যতার মায়া-পাশ ছিন্ন করিয়া, ইহলোকের সুখ-সাধ বিসর্জন দিয়া মায়ের-ছেলে-অরবিন্দ বন্দেমাতরমপত্রের সম্পাদনায় ব্রতী হইয়াছেন। ইনি ঋষি বঙ্কিমের ভবানন্দ, জীবানন্দ, ধীরানন্দ স্বামী।
...বিলেতে লেখাপড়া শিখিলেও বিলিতি অবিদ্যার পুতনা মায়া অরবিন্দকে মুগ্ধ করিতে পারে নাই। অরবিন্দ শরতের সদ্য প্রস্ফুটিত পদ্মের মতো আপনার স্বদেশের স্বধর্ম ও সভ্যতার মহিমায় প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিয়া জননী-জন্মভূমির শ্রীচরণপদ্মে শ্রদ্ধার্ঘ্যের মত শোভা পাইতেছেন। আহা! এমন কি আর হয়? অরবিন্দ ফিরিঙ্গীর আঁস্তাকুড়ের বাবু নহেন। তাই তিনি খাঁটি মায়ের ছেলে হইয়া ভবানীমন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। ওইখানে বন্দেমাতরম মন্ত্রে মাকে প্রণাম কর।’