সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
গোবিন্দ কড়কড়ের বাড়িতে স্নানাহার সেরে সরলা তাঁকে বললেন— ‘মারহাট্টা পত্রের সম্পাদক এন সি কেলকার আমার বন্ধু। তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে যাব।’
বিকেলবেলা গোবিন্দের ফিটন গাড়িতে গেলেন কেলকারের বাড়ি। সরলা সহজকণ্ঠে কেলকারকে বললেন, ‘তিলকের সঙ্গে আমার দেখা হওয়া একান্ত দরকার। তার বন্দোবস্ত করুন। তাঁর বাড়ি আমি যাব না, আপনার বাড়িতে তাঁকে ও আমাকে দু’জনকেই আগামী কাল খেতে নিমন্ত্রণ করুন।’
তখন তিলকের নামে ফৌজদারি মোকদ্দমা চলছে। তাঁর বাড়ির মধ্যে ও আশপাশে সারাক্ষণ পুলিস-গোয়েন্দাদের শ্যেন-দৃষ্টি। তাঁর সঙ্গে সেখানে কথাবার্তা কওয়া নিরাপদ নয় মোটেই। তিলকের সঙ্গে যে দেখা করতে আসে, তারই উপর নজর থাকে পুলিসের।
পরদিন কেলকারের বাড়ি মধ্যাহ্ন ভোজনে লোকমান্য তিলকের সঙ্গে প্রথম দেখা সরলা দেবীর। তিলকের তখন এক মুহূর্তের অবসর নেই। নিজের ডিফেন্স প্রস্তুত করছেন নিজে। কেলকারের বাড়িতেও সঙ্গে করে এনেছেন রাশীকৃত আইনের বই ও অন্যান্য কাগজপত্র। সরলার চোখে ধরা দেয়— তিলকের চেহারায় একটা বলশালিত্বের অনমনীয় দৃঢ়তার ছাপ। মারাঠা অগ্রনায়ক গোপালকৃষ্ণ গোখলের কোমলতা নেই তাঁর চেহারায়। যেন একটি সজীব দৃঢ় বলস্তম্ভ বসে আছেন আইনের বই ও নথিপত্র ঘেরাও হয়ে। কেলকারের কাছে সরলা দেবীর কথা শোনামাত্র তিনি শত কাজের মাঝেও ছুটে এসেছেন।
সরলা দেবী বাংলার গুপ্ত সমিতির কার্যকলাপের সঙ্গে তাঁর মতভেদের বিষয়টি উল্লেখ করে তিলককে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেন— ‘আপনি কি যুবকদের ডাকাতির অনুমোদন করেন?’
লোকমান্য তিলক বেশ জোরালোভাবে বললেন— ‘একেবারেই না। এ বিষয়ে ধর্মের দিক থেকে দুর্নীতি সুনীতির কথা না তুলে শুধু রাজনৈতিক দিক থেকেই বলছি, পুণা-যুবকদের ডাকাতির অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি— এ কাজ একেবারে নিরর্থক, নিষ্ফল। ধরা পড়বেই। আর দেশের লোককে খুন করে টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে দেশের লোককেই নিজেদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলবে। আমার এ বিষয়ে অনুমোদন একেবারে নেই— আপনি মুক্তস্বরে সেখানে গিয়ে একথা ঘোষণা করতে পারেন। যারা আমার নাম নিয়ে এ আদেশ প্রচার করছে তারা ঠায় মিথ্যে কথা বলছে।’
সরলা দেবী লিখেছেন— ‘সে সময় পুণায় একলা একলা গিয়ে তিলকের সম্মুখীন হওয়ার জন্যে একজন নিঃসঙ্গী বাঙালী মেয়েকে যে কতটা সাহস বুকে বাঁধতে হয়েছিল, তা কেউ অনুমান করতে পারছেন কি না জানিনে। যাহোক আমার যাত্রা সফল হল, সার্থক হল, এই আনন্দে পূর্ণ হয়ে আমি বাড়ি ফিরলুম...।’
বহুকাল পরে শ্রীঅরবিন্দ পণ্ডিচেরিতে নীরদবরণকে বলেছিলেন—
‘[বাংলায় প্রথম যে গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়] আমি সে দলের প্রতিষ্ঠাতা নই, নেতাও নই। পি মিত্র এবং মিস ঘোষাল [সরলা ঘোষাল] ব্যারণ ওকাকুরার মন্ত্রণায় ও প্রেরণায় তা আরম্ভ করে। আমি বাংলায় গিয়ে তাদের এই কাজ সম্বন্ধে জানতে পাই। তখন থেকে আমি শুধু খবর রাখতাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল, সমস্ত ভারতে বিদ্রোহ সৃষ্টি করা। আর এরা যা করত তা নিতান্ত ছেলেমানুষি, যেমন ম্যাজিস্ট্রেটকে মারধর করা। পরে ব্যাপারটা ডাকাতি, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদির দিকে মোড় নেয়। ওগুলো মোটেই আমার মতানুযায়ী নয়, উদ্দেশ্যও ছিল না।’ (শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে কথাবার্তা, নীরদবরণ)
অরবিন্দ অমন সব কাজ পছন্দ না করলেও কেন বাধা দেননি, সে প্রশ্নের উত্তরে বলেন— ‘কোনও জিনিস যখন দৃঢ় রূপ নেয়, তাকে বাধা দেওয়া সমীচীন নয়। কেন না তাতে কিছু ভালো ফল মিলতেও পারে।’
একদা স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে পরিচয় পর্বে সরলা ঘোষালকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। কিন্তু স্বামীজির দেহান্তের কয়েক মাসের মধ্যেই অগ্নিযুগের অগ্নিপথে তাঁদের মাঝে দ্রুত বাড়তে লাগল ব্যবধান। নিবেদিতার ক্রমশ মোহভঙ্গ ঘটে সরলার ব্যাপারে। একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে তিনি ১৯০২-এর ২১ ডিসেম্বর মিস ম্যাকলাউডকে এক চিঠিতে লেখেন ‘তোমাকে জানাই সত্য কথাটি তাবৎ বালিগঞ্জ-সম্পর্ক বিষয়ে আমার মোহমুক্তি ঘটেছে। সরলা এখন জগন্মাতার পার্থিব প্রতিনিধিত্বে প্রতিষ্ঠিত। সে আমাকে লিখে পাঠাচ্ছে, ডাঃ বসুকেও (জগদীশচন্দ্র) বলছে— তার বাহিনীতে ঢুকে পড়তে।’
সরলার প্রতি অপ্রসন্ন নিবেদিতা এমন কথাও লিখেছেন, ‘কি অদ্ভুত, আমি (এখন) এই গোষ্ঠীর সর্বপ্রকার সংস্পর্শ থেকে নিজের ছেলেদের সরিয়ে রাখার জন্য অতীব উৎকণ্ঠিত।’
সরলাকে বাঙালি যুবকদের শরীর-প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিতরণ করতে দেখে বঙ্গবাসী কাগজ লিখেছিল— ‘মরি! মরি! দেবী দশভুজা কি আজ সশরীরে অবতীর্ণা হইলেন!’
সরলার বাড়িতে চা-পানে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন বরোদার গায়কোয়াড়। দেওয়ালে টাঙানো জাপানি শিল্পীর আঁকা কালীর ছবি এবং সরলার এলোচুল মুখের পোর্ট্রেট দেখে গায়কোয়াড় বলেছিলেন ‘কোন কালী দেখব— এই কালী না ওই কালী?’
সরলা লিখেছেন— ‘একবার শুনলুম, রেলেতে একটা পার্শেল ধরা পড়েছে, ভিতরে বন্দুক ভরা, উপরে কারও নাম নেই। পুলিসের বিশ্বাস, আমি নাকি সেগুলি আমদানি করিয়েছি।’
তিনি আরও জানিয়েছেন, একবার চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে জানিয়ে যান— ‘আপনি সাবধানে থাকবেন। সন্ধেবেলা বালিগঞ্জে এ-বাড়ি ও-বাড়ি হেঁটে বেড়াতে বেরবেন না। পুলিস বলছে, আপনি বড্ড বাড়াবাড়ি করছেন, অথচ আপনাকে ধরবার ছোঁবার কোনও উপায় পাচ্ছে না। তাই তারা এবার পরামর্শ এঁটেছে, কোনওদিন সন্ধেবেলায় আপনি বাড়ির বাইরে বেরলে তাদের গুন্ডা দিয়ে আপনাকে আক্রমণ করিয়ে জাহির করিয়ে দেবে গুন্ডারা আপনার ক্লাবেরই ছেলে, আপনিই এইসব গুন্ডা তৈরি করেছেন।’
নিবেদিতার সঙ্গে পরিচয়ের স্বল্পকালের মধ্যেই অরবিন্দ অবগত হন সরলা-নিবেদিতার অনেক ব্যাপারে মতপার্থক্য। এখানে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, কখন কোথায় নিবেদিতার সঙ্গে প্রথম পরিচয় অরবিন্দের!
নিবেদিতা ১৯০২ সালে বক্তৃতা-সফরে বেরিয়ে অক্টোবরে গিয়েছিলেন বরোদায়। স্টেশনে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন অরবিন্দ। এর পূর্বেই তিনি বিমুগ্ধ নিবেদিতার ‘কালী দি মাদার’ পড়ে। পরে নিবেদিতা বলেন, তিনি শুনেছেন অরবিন্দ শক্তির উপাসক।
বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এ সম্বন্ধে লেখেন— ‘যখন মহারাজার অতিথি হয়ে সিস্টার নিবেদিতা বরোদায় এসেছিলেন তখন বড় বড় রাজকর্ম্মচারীর সঙ্গে শ্রীঅরবিন্দ তাঁকে সম্বর্দ্ধনা করে আনতে যান। এই খানটায় এসে কলেজের বাড়ী দেখে নিবেদিতা বলেন What an ugly pile (কি কদাকার স্তূপ), আর তারপর একটুখানি এগিয়ে পুরনো ভারতীয় স্টাইলে গড়া গৃহস্থের ছোট্ট বাড়ী দেখে বলেন, Oh, how beautiful (আহা কি সুন্দর)! কলাজ্ঞানে ক অক্ষর গোমাংস হ্যাটকোটধারী রাজ-অমাত্যরা তো অবাক! এত লক্ষ লক্ষ টাকার মিনার গুম্বুজওয়ালা বাড়ী হলো কদাকার আর একটুখানি কুঁড়ে হলো সুন্দর! একজন তো অরবিন্দের কাছে এসে কানে কানে বলেই ফেললেন, I say, she is mad (ওহে, উনি তো পাগল)!’
নিবেদিতার ফরাসি জীবনীকার লিজেল রেঁম লিখছেন— অরবিন্দের পরিকল্পনার পরিধি ছিল ব্যাপক এবং দিন দিন তা সক্রিয় হয়ে উঠছিল। বরোদা থেকে বাংলা পর্যন্ত একটা কর্মচক্র বিস্তার করবার জন্য বেছে বেছে লোক নিচ্ছিলেন তিনি বিপ্লবী দলে। উদ্দেশ্য, মাকড়শার জালের মতো এ দল শহরে শহরে, গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ুক।
কিন্তু নিবেদিতার ধৈর্য থাকে না। বলেন, ‘কলকাতায় তোমাকে দরকার। তোমার স্থান বাংলায়।’
—‘এখনও সময় হয়নি। আমি আড়াল থেকে কাজ করছি। আমার সামনে থেকে প্রকাশ্যে কাজ করবার লোক চাই।’
হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে নিবেদিতা বলেন, ‘আমায় ভার দিতে পার, আমি তোমার দলে।’
তাঁর আইরিশ-শোণিতের তেজসুদ্ধ নিবেদিতা নিজস্ব যা কিছু সব অরবিন্দের প্রস্তুত-প্রায় পরিকল্পনায় ঢেলে দিলেন।
অরবিন্দ স্বয়ং এই সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে ‘পবিত্র’-কে (রেঁম সংগৃহীত) লেখা এক পত্রে জানিয়েছেন—
‘ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় বরোদায়, যখন তিনি সেখানে কয়েকটি বক্তৃতা করতে গিয়েছিলেন। আমি তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে, ও তারপর তাঁর বাসস্থানরূপে নির্ধারিত বাড়িতে তাঁকে পৌঁছে দেবার জন্য স্টেশনে গিয়েছিলাম। বরোদার মহারাজার সঙ্গে তিনি দেখা করতে চেয়েছিলেন। ... এই কালেই আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে যায়।’
‘শ্রীঅরবিন্দ অন হিমসেলফ’ গ্রন্থে এ-সম্বন্ধে বলেন—
‘সেই সময় আমি তাঁর (নিবেদিতার) কালী দি মাদার গ্রন্থ পড়ে বিমুগ্ধ। আমার মনে হয়, বইটির বিষয়ে আমরা কথাবার্তা বলেছিলাম। তিনি বলেন, তিনি শুনেছেন যে, আমি শক্তি উপাসক। তার দ্বারা তিনি বলতে চেয়েছিলেন, আমি তাঁরই মতো গুপ্ত বিপ্লবী দলের অন্তর্ভুক্ত। বরোদার মহারাজার সঙ্গে সাক্ষাৎকারকালে তিনি তাঁকে গুপ্ত বিপ্লবে সাহায্য করবার জন্য আমন্ত্রণ করেছিলেন— সেই সময়ে আমি উপস্থিত ছিলাম। তিনি মহারাজাকে বলেন, তিনি আমার মারফত তাঁর (নিবেদিতার) সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। সয়াজীরাও যথেষ্টই চতুর ছিলেন, এইরকম মারাত্মক কাজে ঝাঁপ দেবার পাত্র ছিলেন না, তিনি এ-ব্যাপারে আমার সঙ্গে কোনো কথাই বলেননি।’
গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরীকে পরবর্তীকালে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ জানিয়েছেন— ‘নিবেদিতা তাঁর বরোদা-ভ্রমণের সময় থেকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত।’ অগ্নিযুগ, প্রথম খণ্ডে বারীন্দ্রকুমার লিখেছেন— ‘ভগিনী নিবেদিতা চরমপন্থী নেতারূপে শ্রী অরবিন্দের অগ্রগামী।’
সেই সঙ্গে পরিবেশন করেন আরও কিছু তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য।
‘সিস্টার নিবেদিতা বাংলার এই প্রথম বিপ্লব কেন্দ্রটিকে তাঁর লাইব্রেরির জাতীয়তা বিষয়ক প্রায় দেড়শ-দুইশ বই নিঃস্বত্ব হয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর পুস্তক-সংগ্রহের মধ্যে ছিল আইরিশ বিদ্রোহের ইতিহাস, ডাচ রিপাবলিক, গ্যারিবলডি ও ম্যাৎসিনির জীবনী, সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ, টডের রাজস্থান, টমকাকার কুটীর, মহাভারত, রামায়ণ, দাদাভাই নৌরজি, রমেশ দত্ত ও উইলিয়ম ডিগবি-র বৃটিশ অর্থনীতির বই (Econonic History of British India, Un-British Rule in British India) ভারতের ইতিহাস, য়ুরোপের ইতিহাস, ইংল্যান্ডের ইতিহাস, ক্রমওয়েলের জীবনী, ব্লক-এর War Made empossible, একখানি আধুনিক ব্যাপক ধ্বংসমূলক বৈজ্ঞানিক মারণাস্ত্রের বিবরণ-সংবলিত বই, ব্যারন ওকাকুরার বই— এমনই প্রায় দেড়শো উল্লেখযোগ্য সুপাঠ্য পুস্তক।’
যতীন বাঁড়ুয্যের বিপ্লববাদী গুপ্ত দলের ডাকাতি করার ব্যাপারে নিবেদিতার সমর্থনের কথা সরলা দেবী লিখেছেন, ‘জীবনের ঝরাপাতা’য়।
সরলার অভিমত তামাম নস্যাৎ করে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তুলে ধরেছেন ডাঃ যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের মতো মহাবিপ্লবী। যাদুগোপাল লিখছেন— ‘একটি ঘটনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কয়েকটি যুবক অনুমতি না নিয়ে কোথাও উধাও হল। কয়েকদিন বাদে তারা ফিরলে যতীন্দ্রনাথ কৈফিয়ৎ তলব করলেন। প্রথমটা তারা কিছু না বলে মুখ বুজে রইল। তারপর যতীন্দ্রনাথ চাবুক হাতে নিয়ে তাদের শাসন করতে গিয়ে বললেন— সব কথা পরিষ্কার স্বীকার কর, নৈলে রক্ষা রাখব না। তখন স্বীকার করল, আর একজনের প্রোৎসাহে তারা তারকেশ্বরে ডাকাতি করতে গিয়েছিল। যেখানে টাকা ছিল বলে তাদের সংবাদ সেখানে দেখল কয়লার কাঁড়ি। এই ঘটনার সম্পর্কে ভগিনী নিবেদিতা যতীন্দ্রনাথের কাছে আগেই নালিশ করেন যে কয়েকটি যুবক তাঁর রিভলভারটি ধার চাইতে গিয়াছিল। কারণ জিজ্ঞাসা করায় তাঁকে এই প্রস্তাবিত ডাকাতির কথা বলা হয়। নিবেদিতা খুব অসন্তুষ্ট হন। যন্ত্রটি দিলেন না। উপরন্তু যতীন্দ্রনাথের কাছে সব কথা ফাঁস করে দেন।’ (শ্রীমৎ নিরালম্ব স্বামী)
বিবেকানন্দ-অনুজ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন, একবার বিপ্লবী দেবব্রত বসু বাগবাজারে নিবেদিতার ১৭ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়িতে গেলে কথাপ্রসঙ্গে নিবেদিতা তাঁকে বলেন— ‘তোমাদের গুপ্ত আন্দোলন সম্বন্ধে কোন কথা আমাকে বলো না।’
এর বেশ কিছুকাল পরে একদিন কৌতূহলী হয়ে নিবেদিতা বিপ্লবী দেবব্রত বসুকে গুপ্ত আন্দোলন সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে দেবব্রত তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, পূর্বে তিনি সে-বিষয়ে কোনও কথা বলতে তাঁকে নিষেধ করেছিলেন। গভীর নৈঃশব্দ্যে তন্ময় হয়ে যান নিবেদিতা।
১৯০৮ সালে আমেরিকায় ভূপেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হলে নিবেদিতা ফের তাঁকে প্রশ্ন করেন বিপ্লব আন্দোলন সম্বন্ধে। তখন ভূপেন্দ্রনাথও দেবব্রত বসুর উত্তরের পুনরাবৃত্তি করেন শান্ত চিত্তে। এ কথা তিনি উল্লেখ করেন ‘Swami Vivekananda- Partriot Prophet’ গ্রন্থে।
তখন বিপ্লবীদের বোমা তৈরির ব্যাপারেও নিবেদিতার একটি সুনির্দিষ্ট ভূমিকা নিয়ে বেশ চর্চা হতো। শোনা যেত, নিবেদিতা স্বয়ং প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবরেটরিতে প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও জগদীশচন্দ্র বসুর ছাত্ররূপে কয়েকজন তরুণ বিপ্লবীকে বোমা তৈরির করার প্রণালী শিক্ষা দিতেন। পরবর্তীকালে বিপ্লবীরা এ ঘটনা কাল্পনিক ও অবিশ্বাস্য বলে খারিজ করে দেন।
এ সম্বন্ধে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন, নিবেদিতা যদি ল্যাবরেটরিতে বসে বোমা তৈরি করার প্রণালী শিক্ষা দিতেন, তবে ওই বিদ্যা শেখার জন্য হেমচন্দ্র দাসকে প্যারিস পাঠানোর কোনও প্রয়োজন হতো না।
অবশ্য এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে, নিবেদিতার প্রবল ব্রিটিশ বিরোধী অগ্নিপথের অভিযাত্রার কারণেই বিবেকানন্দের দেহান্তের পক্ষকালের মধ্যেই বেলুড় মঠের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা প্রকাশিত হয় সংবাদপত্রে।
স্বামীজির আর এক বিদেশিনী ভক্ত সিস্টার দেবমাতা (লরা গ্লেন) লেখেন— ‘নিবেদিতার স্বল্পালোকিত ঘরে রবিবারের একটি গোটা বিকেল আমি বসেছিলাম— নিবেদিতা মিশনের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদের কাহিনি বলে গিয়েছিলেন। ভারতবর্ষকে স্বাধীন করবার জন্য তাঁর রাজনৈতিক উৎকণ্ঠা এবং রামকৃষ্ণ মিশনকে সেবা করবার জন্য তাঁর আধ্যাত্মিক ব্যাকুলতা— এই উভয়ের মধ্যে দীর্ঘ সংগ্রামের কথা যখন তিনি আমাকে বলেছিলেন তখন তাঁর কণ্ঠে গ্রিক ট্র্যাজেডির নিয়তির সুর ঘনিয়েছিল। স্বামীজি তাঁকে সতর্ক করে বলেছিলেন— কোনও একটিকে বেছে নিতে হবে। মিশনকে রাজনৈতিক কাজে জড়ানো চলবে না। দীর্ঘ হয়েছিল নিবেদিতার অন্তঃসংঘাত। শেষে তিনি বেছে নিয়েছিলেন— ভারতকে স্বাধীন করতেই হবে।’