পিশাচ সাধু
জয়ন্ত দে : শিবশম্ভু দারোগার ছোটবউ সনকার কাছ থেকে তার জীবনের গল্প শুনল সহজ। পরিচয় হল নন্দিনীর সঙ্গে। সনকার কাছ থেকে জানতে পারল তিন নারীর লড়াইয়ের কাহিনি। তারপর...
বর্ণিনী বলল, ‘তুই তো কত লেখাই দিস। আমি বিচিত্রদাকে দুটো লেখা পড়তে দিয়েছিলাম। দাঁড়া খবর নিতে হবে—।’
দিন কয়েক হল হাসপাতালে থেকে ফিরে এসেছেন বিচিত্র ঘোষাল। সহজ বলল, ‘আমার বাইকে বোস। বিচিত্রদার বাড়ি যাব। ওঁকে জিজ্ঞেস করতে হবে।’
বিচিত্র ঘোষাল ঘরেই ছিলেন। এ ঘরের দরজা খুলতে হয় না। ভেজানো থাকে। ঠেলতেই খুলে গেল। এখন ভালোই আছেন। তবে রাস্তায় বেরচ্ছেন না।
বর্ণিনী বলল, ‘তোমাকে সহজ মিত্রের দুটো গল্প দিয়েছিলাম, সে দুটো কোথায় আছে, আমাকে দেবে?’
বিচিত্র ঘোষাল চোখ বুজিয়ে একটু চিন্তা করলেন, বললেন, ‘আছে।’
‘আমাকে দাও।’
বিচিত্র ঘোষাল একটা ব্যাগ বের করলেন। কিছুক্ষণ হ্যাচরপ্যাচর করে খুঁজলেন, একটা গল্প বের করে বললেন, ‘এই নাও।’
‘দুটো লেখা ছিল—।’ বর্ণিনী বলল।
‘আর একটা নেই। খুঁজতে হবে।’
‘আর একটা নেই মানে? তুমি হারিয়ে ফেলেছ নাকি?’
বিচিত্র ঘোষাল কেমন অপরাধীর মতো মুখ করলেন। সহজ এবার সামনে এগিয়ে এসে স্বদেশ পত্রিকাটি এগিয়ে দিল। বলল, ‘এই পত্রিকায় আমার একটা গল্প ছাপা হয়েছে। এই যে—’ সহজ গল্পটি খুলে দিল। বিচিত্র ঘোষাল গল্পটি এক ঝলক পড়েই সহজের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। সারা মুখে চাপা অপরাধবোধ। সহজ বলল, ‘গল্পটি আপনি পাঠিয়েছিলেন পত্রিকা অফিসে?’
বিচিত্র ঘোষাল মাথা নিচু করে নিল। ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, ‘গল্পটি ভালো, ছাপার উপযুক্ত, তাই পাঠিয়ে দেখলাম। এই তো ছেপেছে। বাহ্!’
বর্ণিনী বলল, ‘সহজ তোমাকে ধন্যবাদ দিতে এসেছে।’
বিচিত্র ঘোষাল লজ্জা পেলেন। বললেন, ‘বোসো ভাই চা আনি।’
সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। খুব রোগা মানুষ এখনও একটু ঝুঁকে আছেন। সারা শরীরে ক্লান্তি মাখামাখি। বর্ণিনী ধমক দিল, ‘তুমি চুপ করে বোসো, আমি চা আনছি।’ কথাটা বলেই বর্ণিনী ধাঁ করে বেরিয়ে গেল। ওর চলে যাওয়ার দিকে বোকা বোকা তাকিয়ে থাকলেন বিচিত্র ঘোষাল। বসে পড়লেন টুপ করে। বললেন, ‘ভালো করে লেখো। তোমার এই লেখাটি কোনও ব্যক্তিগত লেখা নয়, এর মধ্যে চাপা একটা ক্লাস স্ট্রাগল আছে। ছোটবউকে তুমি খুনি বানাওনি, আবার কাজের মেয়েটি মেনকার মৃত্যু একটা কোনও মেয়ের মৃত্যু নয়। তুমি শুধু একটা প্রশ্নচিহ্নের মতো রেখেছ—’
বর্ণিনী ঢুকল সঙ্গে একটা লোক। চা এল, সঙ্গে তিন প্লেট ঘুগনি। বর্ণিনী বলল, ‘বউদি দুরন্ত ঘুগনি বানায়, আমি এলেই খাই।’ বনি ঘুগনি নিয়ে বসে গেল। বিচিত্র আর সহজ চা টেনে নিল। বিচিত্র ঘোষাল চা খাচ্ছেন দু’চোখ বন্ধ করে। বনির খাওয়া দেখে সহজ মিটিমিটি হাসছে। হঠাৎ বণির্নী বলল, ‘তুই এবার বল—’
‘কী?’
‘ওই যে পিশাচ সাধু তোকে কী বলেছে, তেত্রিশ দিনের মধ্যে তোর ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে।’
‘কী সব বলছিস—!’ সহজ কথাটা ঘোরানোর চেষ্টা করল।
বর্ণিনী থামার পাত্রী নয়, ‘আহা, তোকে তো ভবিষ্যদ্বাণী করেছে ক্যাপ্টেন না পিশাচ সাধু। তাতেই তোর লেখা ছেপে বের হয়েছে। আমাকে তো গৌর বলল। তোর সামনেই বলল। পিশাচ সাধুর পাওয়ার—।’
বর্ণিনী কথাটা শেষ করতে পারল না, চিৎকার করে উঠলেন বিচিত্র ঘোষাল। ‘ও তুমি ওর খপ্পরে পড়েছ? তোমার সর্বনাশ হবে! আর কোনওদিন তুমি আমাকে তোমার লেখা পড়তে দেবে না। যাও, যাও, আমার বাড়ি থেকে যাও। পিশাচটা অনেককে শেষ করেছে, এবার তোমাকেও করবে। ও ভবিষ্যদ্বাণী করে? ছাই করে। ওর সব চর আছে। তারা ইনফরমেশন দেয়। ও একটা পাক্কা ঘুঘু। মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝে।’
বর্ণিনী বলল, ‘বাপ রে! মনস্তত্ত্ব বোঝে, তাহলে আমাকে একবার নিয়ে চ। আমাকে দেখে কী বোঝে একবার শুনে আসব।’
‘না, না, তুমি যাবে না বনি। ওই সাধু একটা ভণ্ড। ও ভালো কথা বলে না। খারাপ কথাই বলে। ও একটা নেগেটিভ ফোর্স নিয়ে খেলে। ওর কাছে কোনও পজেটিভ ফোর্স থাকে না। ও পার্টির খুব ক্ষতি করেছে। ওকে আমদানি করেছিল কমরেড রঞ্জন মুখার্জি। আমি ওর নাড়িনক্ষত্র জানি। সেই তখন থেকে আমি ওর বিরুদ্ধে কথা বলে আসছি। কিন্তু ওর চমৎকারী কথাবার্তায় সবাই ফেঁসে যায়। এই ছেলেও ফেঁসে গিয়েছে। তুমি ভাই এসো না আর। তোমার লেখা পড়ার মতো সময় আমার নেই। তার থেকে বস্তির ঘরে ঘরে গিয়ে দুটো বাচ্চা পড়ালে দেশের কাজ হবে। লিখেছ তো রাবিশ! রাবিশ লেখা। এরপর তুমি খুনের গপ্প লিখবে, ভূতের গপ্প লিখবে, সেক্স লিখবে! তুমি শেষ। এবার আমি তোমাকে তোমার ফিউচার বলে দিচ্ছি।’
চা শেষ করে, সহজ খুব তারিয়ে তারিয়ে ঘুগনি খেল। বাইরে বেরিয়ে বলল, ‘বিচিত্র ঘোষাল মারাত্মক রেগে গেল রে।’
বর্ণিনী বাইকে বসতে বসতে বলল, ‘ওদের পার্টির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মনে হচ্ছে। নইলে ইগো ক্ল্যাস। আমাকে নিয়ে যাবি কবে?’
‘কোথায়?’
‘ওই পিশাচ সাধুর কাছে?’
‘তুই যাবি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কাল চ। আচ্ছা কাল নয়। আমি একবার গিয়েছি, পরশু। গিয়েই ঝামেলায় পড়েছি। আমি জানি না এবার আমাকে দেখলে কেমন রিঅ্যাক্ট করে। আমি বরং কাল একবার একা যাই। তারপর তোকে নিয়ে যাব।’
‘ওক্কে।’
বর্ণিনী যাবে বলতেই সহজের মাথার ভেতর একটা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখতে হবে? কী দেখবে সে? বনি সম্পর্কে কিছুই জানে না লোকটা। মানে কোনও ইনফরমেশন। তাহলে ওর সম্পর্কে কী বলে শুনতে হবে? চমকপ্রদ কোনও কথা? দেখাই যাক না। তার আগে তাকে যেতে হবে। একা। সকালে যাবে? না সন্ধেবেলা? আপতত সকালেই যাওয়া যাক। তারপর নয় সন্ধেবেলা হানা দেওয়া যাবে।
পরের দিন সকালে হাজির হল সহজ। লোকটা ঠিক সেদিনের জায়গায় বসে। তাকে দেখে অদ্ভুত হাসলেন। বললেন, ‘আয়। ভেবেছিলাম, কালই আসবি। একদিন দেরি হল তোর।’
পাশে বসতে বসতে সহজ বলল, ‘কাল কেন?’
‘বা রে আমার কথা মিলে গেল। তারপর তুই এলি। কিন্তু ওই আহাম্মকটার জন্য ব্যাপারটা সেলিব্রেটই করা হল না। এসে থেকে এমন ঝাঁ ঝাঁ করে পড়ল হারামজাদা, দিলাম ওর বারোটা বাজিয়ে।’
‘আপনি খুব খারাপ কথা বলেছেন।’
‘আমি ঠিক বলেছি। ও খুব পরশ্রীকাতর।’
‘কিন্তু আপনার বলা কথায় শুধু ও একা নয়, ওর স্ত্রী, বাচ্চাটাও না সমস্যায় পড়ে?’
‘দুর দুর দুর কোনও সমস্যায় পড়বে না। তুই জানিস, সুজি বিয়ে আগে আমার কাছে ওই মেয়েটা মানে যে ওর বউ, তাকে নিয়ে এসেছিল। বলেছিল, ক্যাপ্টেন ওর একটা স্কুলে চাকরির কথা হচ্ছে, তুমি বলো তো চাকরিটা হবে কি না? চাকরি হলে আমি ওকে বিয়ে করব। আমি বললাম, না-হলে? সুজি বলল, করব না। বর্ধমানের একটা মেয়ে দেখেছি, বাপের প্রচুর টাকা। তাকেই করব। আমার টাকা চাই। আমি ওকে বললাম, এই মেয়ে চাকরি পেলে তোকে বিয়ে করবে না। একজন স্কুল মাস্টার, লেখাপড়া করা মেয়ে, তুই এইট পাস, কেন তোকে বিয়ে করবে? সুজি হাসল, ও করবে না, ওর বাপ করবে।’
একনাগাড়ে কথা বলে ক্যাপ্টেন থামল।
বলল, ‘সেদিন আমি ওকে বলেছিলাম, তাহলে তুই ওর চাকরিটাকে বিয়ে করছিস? ও বলল, আলবাত। চাকরি না-পেলে আমি বর্ধমানে বিয়ে করব, তবে ওকে ছাড়ব না। সাইডে রেখে দেব। আমি বললাম, সেকী! ও হাসল, বলল, শঙ্করই শুধু একা পারে, আমি পারি না? সেদিন আমিই ওকে বলেছিলাম, বিয়েটা আগে কর, এ মেয়ে চাকরি পেল বলে। সুজি শুনে খুব হুটপাট করে বিয়ে করল। কিছুদিন পরে আমি পরিকে ধরে, পরির ওপরের লোকদের ধরে চাকরিটা করিয়ে দিই। এটা সুজি জানে। জানে বলেই সবসময় আমাকে ছোট করতে চায়। গালাগালি দেয়। আমি সহ্য করতে পারি না সুজিকে। সেদিন আমাকে খবর দিয়েছিল ওর বউ মৈত্রেয়ী। ওর বউ মাঝেমাঝে আমাকে ফোন করে। ও জানে ওদের সব অনুষ্ঠানেই ওরা আমাকে ডাকে। সেদিনও ডাকবে ভেবে ফোন করেছিল। আশীর্বাদ চাইল। কিন্তু আমি ওকে লজ্জায় বলতে পারলাম না সুজি আমাকে ডাকেনি। বললাম, ডেকেছে, দুপুরে যাব। তাই গিয়েছিলাম।’
সহজ চুপ করে থাকে। ‘কিন্তু আপনি সেদিন বড্ড খারাপ কথা বলেছেন।’
‘আমি কিছু বলিনি।’
‘আপনি বলেননি মানে? আপনি আমার সামনে বলেছেন—সুজি তুই কাক। তুই কোকিলের ছানা মানুষ করবি। কিছু বলতে বাকি রেখেছেন?’
‘যত রাগই থাক, আমি ইচ্ছে করে বলিনি। আমি পরে বুঝেছি, আমার কথায় ওই মেয়েটা কষ্ট পাবে।’
‘তবে?’
‘আমি বলতে চাইনি। কিন্তু কী করে যেন ওইসব কথাগুলো আমার মুখের ভেতর গজগজ করছিল। না উগরাতে পারলে কথাগুলো পাথরের মতো আমার পেটে ভেতর ঢুকে পড়ত। তারপর পাথর হয়ে নাচানাচি করত।’
‘আপনি ফালতু যুক্তি দিচ্ছেন।’
লোকটা দু’হাতে মুখ মোছে।
‘তারপর আপনি সে সব কথা শঙ্করদাকে বলেছেন। শঙ্কর ওকে নিয়ে মজা করছে।’
‘শঙ্করকে আমি সুজির ব্যাপারে বলিনি। তবে জেনে রাখ, আমার রাগ জল্লাদ। শঙ্করকে আমি শাস্ত্রে বিয়ে আর সন্তান উৎপাদনের রকমফের শুনিয়েছি। ক্ষেত্রজ সন্তানের কথা বলেছি। কারও নাম করিনি। বলেছি, তোর কাছ থেকে জেনে নিতে। হ্যাঁ, আমার লক্ষ্য ছিল সুজি—।’
‘এটা ঠিক করেননি। ও খুব কষ্ট পাচ্ছে। আপনি সুজিদাকে ডাকুন। ডেকে বলুন আপনি মজা করেছেন। আপনি কোনও ভবিষ্যতের কথা বলেননি।’
‘তুই আমার হয়ে এই কথাগুলো বলে দে।’
‘আমি বলতেই পারি, কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করবে না।’
‘ও আর আসবে না। ও এলে আমি ক্ষমা চেয়ে নেব। বলে দেব কথাগুলো সব মিথ্যে। কথাগুলো সব বানানো। আর যা বলতে বলবি বলে দেব। আমার কোনও অসুবিধে নেই।’
সহজ হাসল। ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
আপনি নচেকেও বলে দেবেন, ‘তোর গণনাটিও ভুল হয়েছে। তুই সজ্ঞানে নব্বই বছর বয়সে নাতির জল মুখে নিয়ে বুকের ধুকপুক থামাবি।’
ক্যাপ্টেন বলল, ‘নচে অপঘাতে মরবে।’
সহজ বলল, ‘নচে অপঘাতে মরবে, সুজি কোকিল ছানা মানুষ করবে—এসব বলে কী লাভ পান?’
‘আমি কি বলতে চাই! যাকে বলি, সে-ই আমাকে দিয়ে বলায়।’
‘আমি তো আপনাকে দিয়ে কিছু বলাইনি। তবে?’
‘তোকে দেখে ভালো কথা বলতে ইচ্ছে করছিল....।’ ক্যাপ্টেন আকাশের দিকে দু’হাত তুলে হাসেন।
‘এবার ওদের ভালো কথা বলুন।’
কখন ওদের পিছনের দরজা খুলে গিয়েছিল। এসে দাঁড়িয়েছিল বঁড়শি। বলল, ‘এই মানুষটা কখনও ভালো কথা বলে? আমি তো এতদিন ওঁর সঙ্গে আছি। আমাকে একটাও ভালো কথা বলেনি। সব সময় খারাপ কথা বলেছে। আর আমি খারাপ কথা শুনেছি।’
ক্যাপ্টেন হাসল, ‘ভালো কথা শুনবি?’
‘হ্যাঁ শুনব। আপনার ভালো কথা বলার ক্ষমতা আছে?’
‘আছে।’
‘তবে বলুন। দেখুন, একটা তো ফলেছে। আর একটা ফলবে।’
‘এই ছেলেটার সঙ্গে তোর প্রেম হবে। প্রেম পিরিত!’
‘এই আপনার ভালো কথা!’
‘প্রেম পিরিত কি খারাপ কথা রে?’
‘এটা মোটেই ভালো কথা না।’ সহজ বলল। ‘আপনি আবারও একটা খারাপ কথা বললেন।’
বঁড়শি বলল, ‘আপনার এই কথাটা মিলবে?’
‘আলবাত মিলবে!’
‘এই দুধের শিশুটার সঙ্গে আমার প্রেম হবে?’
‘হবে, জমজমাট প্রেম।’
‘সেটি হলে আপনি কী করবেন?’
‘দু’বাহু তুলে নাচব।’
সহজ উঠে পড়ে, ‘না, আপনি খুব খারাপ কথাই বলেন।’
ক্যাপ্টেন হাসেন, ‘খারাপ কথা ভালো কথা নয়, আমি সত্যি কথা বলি। এই মেয়েটার জন্য তুই এখানে ঘুরে ঘুরে এসেছিস।’
ক্যাপ্টেনের কথায় বঁড়শি অদ্ভুতভাবে সহজের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখে ঝিলিক, ঠোঁটের কোণে হাসি।
(চলবে)
অঙ্কন: সুব্রত মাজী