পারিপার্শ্বিক কোনও ঘটনা চিন্তা বাড়াতে পারে। সাংস্কৃতিক কর্মে যোগদান ও মানসিক তৃপ্তিলাভ। শরীরের খেয়াল রাখুন। ... বিশদ
কয়েক বছর পর পুরনো সঙ্গীদের নিয়ে ভ্রমণে বেরনো। ওল্ড দীঘার হোটেল থেকে বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গায়িত রূপ দেখা যায়। সামনেই দৃষ্টিনন্দন বিশ্ববাংলা পার্ক। ঢোকার মুখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ বড় প্রতিমূর্তি। তাঁকে প্রণাম জানিয়ে পার্কে ঘোরা। পরে সাগরের ঢেউ গোনা।
পরের দিন সকালে চন্দনেশ্বরে পুজো দিতে গেলাম। কিছুক্ষণ মন্দির চত্বরে ঘুরলাম। ওখান থেকে বেরিয়ে হোটেলে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। আমাদের গাড়িচালকের কথায় তখন এক অজানা জায়গায় যাওয়া স্থির হল। চন্দনেশ্বর থেকে ১৮ কিমি দূরে ওড়িশার বালেশ্বর জেলার ভোগরাই অঞ্চলের কুম্ভীরগড়ি গ্রামের দিকে রওনা দিলাম।
চারদিকে সবুজের সমারোহ। পাশে সুবর্ণরেখা নদী এঁকে বেঁকে চলেছে। পৌঁছলাম কুম্ভীরগড়ি। একটি প্রত্যন্ত গ্রাম, প্রকৃতির নিটোল সৌন্দর্যের ক্যানভাস সেখানে। পুজোর সামগ্রী নিয়ে কাঙ্ক্ষিত মন্দিরের দিকে এগলাম। কয়েকটি সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করে একই সঙ্গে বিস্মিত ও চমৎকৃত হলাম। স্পর্শ করলাম এশিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ ও উচ্চ শিবলিঙ্গ ভূষণ্ডেশ্বর বাবাকে। স্পর্শ ও দর্শন করে ভক্তিমিশ্রিত গর্ববোধও হল একটু। মন্দিরে পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। পূজকরা পুজো দেওয়ায় সাহায্য করেন। ভূষণ্ডেশ্বর শিব উচ্চতায় ১২ ফুট ও চওড়ায় ১৪ ফুট। কালো গ্রানাইট পাথরের তৈরি। তবে এই উচ্চতা তাঁর উপরিভাগের মাত্র। শিবলিঙ্গের নিম্নভাগ মাটিতে প্রোথিত। মাটির তলায় বহুযুগ থাকায় তার উচ্চতা বারো ফুট বলেই ধরা হয়। উপরস্থ শিবলিঙ্গ তিনভাগে বিভক্ত। মাঝের অংশের উচ্চতা চার ফুট। এটি অষ্টকোণ বিশিষ্ট। এর পরিধি বারো ফুট।
ভূষণ্ডেশ্বর মহাদেব পৃথিবীর বৃহত্তর লিঙ্গের মধ্যে অন্যতম। আর এশিয়ায় তা সর্বোচ্চ ও সর্ব বৃহৎ শিবলিঙ্গ। এই প্রকাণ্ড আকৃতির জন্য মহাদেবের নাম ভূষণ্ডা ঈশ্বর বা ভূষণ্ডেশ্বর। মন্দিরের উচ্চতা ৪৬ ফুট। গোলাকার মন্দিরের পরিধি তেষট্টি ফুট। মন্দিরের ছাদ নীল টিন দিয়ে ঢাকা। মন্দিরে দু’টি প্রবেশদ্বার। একটি দক্ষিণে, অন্যটি পূর্বদিকে। পূর্বদিকে কয়েকটি ধাপ সিঁড়ি আছে। তবে তার কোনও রেলিং বা পাঁচিল নেই।
ভোগরাই অঞ্চলের পশ্চিমদিকে সুবর্ণরেখা নদী প্রবাহিত। নদী এগিয়ে চলেছে সাগরে মিলনের আশায়। পিপ্পলী নামে একটি শাখা নদী আছে। দৃশ্যত তাও বেশ সুন্দর। মন্দির দর্শনের পর সেখান থেকেও ঘুরে আসা যায়।
ভূষণ্ডেশ্বর মহাদেবের এই স্থানে অবস্থিত হওয়ার পিছনে এক পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে। ত্রেতাযুগে শিবভক্ত রাবণ তপস্যায় মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে এই শিবলিঙ্গটি প্রার্থনা করেন। ভক্তপ্রাণ শিব গোপনে তা রাবণকে দেন। কিন্তু একইসঙ্গে সতর্কও করেন পথের মধ্যে লিঙ্গটি কোথাও রাখা যাবে না।
এদিকে দেবতারা তাতে বিচলিত হয়ে পড়লেন। এই শিবলিঙ্গের সাহায্যে রাক্ষসরাজ রাবণ যে অসীম শক্তিধর হয়ে পড়বেন তাতে কোনও সন্দেহই আর দেবতাদের মনে রইল না। রাবণ শক্তিধর হলে স্বর্গে দেবতাদের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে তা তো অনুমেয়!
তাহলে উপায়! বলে ভাবতে বসলেন তাঁরা। এই দুঃসময়ে নারায়ণ স্বয়ং সহায় হলেন। লিঙ্গটি উদ্ধারকার্যে নামলেন। তিনি বালকের বেশে রাবণের কাছে উপস্থিত হলেন। ওই বিশাল শিব দেখে মুগ্ধ হয়ে তা ধরার অনুরোধ জানালেন। রাবণও বালকটিকে দেখে নিজের ক্লান্তি দূর করার জন্য তাকে লিঙ্গটি কিছুক্ষণের জন্য ধরে রাখতে বলে নদীতে স্নান করতে গেলেন। ফিরে এসে দেখেন লিঙ্গটি মাটিতে পড়ে রয়েছে এবং বালক অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। তিনি বহু চেষ্টা করে শিবলিঙ্গটিকে তুলতে চাইলেন কিন্তু বিফল হলেন। রেগে হয়ে লঙ্কায় ফিরে গেলেন।
কুম্ভীরগড়িতে বড় উৎসব শিবরাত্রি। জাঁকজমক করে পালিত হয়। দূরদূরান্ত থেকে ভক্ত ও দর্শনার্থী আসেন এই পুজোয়। মকর সংক্রান্তিতে মেলাও বসে। ভোগরাইয়ের অখ্যাত পল্লী কুম্ভীরগড়ি ভূষণ্ডেশ্বর মহাদেবের জন্য পবিত্র পীঠ রূপে পরিগণিত হয়েছে।
কীভাবে যাবেন: চন্দনেশ্বর থেকে নানা যানবাহন আছে। জলেশ্বর থেকে ৩৬ কিমি দূরত্ব। বাস চলাচল করে। বালেশ্বর থেকে ৯২ কিমি দূরত্ব। রাত্রিবাসের জন্য সরকারি পান্থনিবাস আছে। পর্যটকরা রাত্রে থেকে সুন্দর শান্ত প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন। আর দেখবেন সুবর্ণরেখা নদী কেমন লীলায়িত গতিতে আকুল হয়ে সাগরে মিলিত হতে চলেছে।