দেবতা নাই ঘরে...
আচ্ছা দেবতার বাস কোথায়? মন্দিরে কি? যেখানে ফুল, ফল, দুধ, ভোগ্য সামগ্রী দিয়ে মহা সমারোহে, আড়ম্বরে পুজোর নাম দিয়ে প্রচুর অর্থব্যয়ে রাজসূয় যজ্ঞ হয় প্রতিদিন, সেইখানে? নাকি সেই বাচ্চাটা, যার দুটো হাত নেই, মন্দিরে আসে ভোগ-প্রসাদের আশায়, তার মধ্যে? ভগবান তো সবার। ঈশ্বর কখনও কারও তাবেদারিতে থাকেন কি? মন্দিরের পুরোহিত, পাণ্ডারা যেভাবে দেবতাকে ছাতা করে নিজেদের স্বার্থপরতা, স্বেচ্ছাচারিতাকে সামনে রেখে মন্দিরে মৌরসিপাট্টা কায়েম করে, তারপরেও কি ঠাকুর মন্দিরে থাকতে পারেন? নাকি তিনি ওই অনাথ মেয়েদুটির হৃদয়ে বিরাজমান, যারা অনেক পূণ্যার্থীদের কাছে পয়সা না নিয়েও ফুল, পুজোর ডালা দিয়ে থাকে। নাকি ঈশ্বর সেই ছিঁচকে চোর দুটির মধ্যে রয়েছেন, যারা সততার পরাকাষ্ঠে একশোভাগ উর্ত্তীণ। বিশেষত পাণ্ডাদের নীচতার নিরিখে। প্রকৃত ভগবানের সন্ধান তো আছে সেই মহিলার কাছে, যার নাম মনোমায়া সোরেন। যিনি দর্শনার্থীদের জুতো রাখেন বিনা পারিশ্রমিকে। তাদের হাতে ধুইয়ে দেন। মন্দিরে গিয়েও যাতে জুতোতেই না মন আবদ্ধ থাকে, সেই দায়টা তিনি নিয়ে থাকেন।
অস্থির এই সময়, যেখানে ধর্মের নামে, জাতের নামে, ঈশ্বরকে সামনে রেখে চলছে নোংরা রাজনীতি। ঠিক এই সময়ের প্রেক্ষিতে ‘কালিন্দী নাট্যসৃজন’ নিয়ে আসছে প্রাসঙ্গিকতার মোড়কে তাদের নতুন প্রযোজনা ‘মন সারানি’।
উত্তর কলকাতার কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে চলছে দলের রুদ্ধদ্বার মহড়া। শীতের সন্ধে যখন শহরের বুকে জাঁকিয়ে বসতে চলেছে, তখনই মনের টানে, মন সারিয়ে দেওয়ার মানুষটিকে দেখার, জানার জন্য সরাসরি হাজির হলাম মহড়া কক্ষে। সামনেই পাওয়া গেল নির্দেশক বিল্বদল চট্টোপাধ্যায়কে। ‘মন সারানি’কে জানতে এসেছি, বললাম। স্মিতহাস্যে জানালেন, ‘মনোমায়া সোরেন এক সময় শ্মশানে কাজ করত। মৃত্যু, বেদনা, মানুষের দুঃখ দেখতে দেখতে ক্লান্ত মহিলা, একদিন ছেড়ে দিল তার কাজ। চলে এল এক মন্দির চত্বরে। এখানে কিছু পাওয়ার আশায় ভগবানের কাছে মানুষ আসে। আশার আলোয় তাদের হাসিভরা মুখ দেখতে পায় মনোমায়া। আবার মনোস্কামনা পূর্ণ হয়েছে, তাই আনন্দে ভক্তরা আসে দেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে। এই হাসিমুখগুলো মনোমায়াকে প্রেরণা দেয়। সে বলে, আমার কাজই হল মনকে ঝালাই করা, মনকে সারানো। আর তাই এই নাটকের নাম ‘মন সারানি’। রমাপ্রসাদ বণিকের অসাধারণ এক রচনা।’
এই মন্দির এবং মন্দির চত্বরকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকে জীবন যুদ্ধে সামিল মাধবী, মালতী, সন্ধ্যা, খাওয়া, ধুলিয়া, চাদু, বাদুরা। দারিদ্র এদের এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে। অন্যদিকে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে রঘুবীর পাণ্ডা, ঘনশ্যাম, গুণধরদের নীচতা, হিংস্রতা আর লোক ঠকানোর ব্যবসা। এদের মাঝে এসে পড়ে মনোমায়া সোরেন। মানুষকে সুখী দেখাই তার একমাত্র লক্ষ্য। যে জোর গলায় বলে, ‘ঈশ্বর তো বাইরে, এইসব মানুষদের মধ্যে। মন্দিরে বসে পুজো করলে তাকে পাওয়া যায় না।’ সিস্টেমের বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলা মানেই ঘোরতর বিপদ। ইতিহাস তো তার সাক্ষী। কাজেই মনোমায়ার সৎ চিন্তা, সুস্থ ভাবনার সঙ্গে সংঘাত ঘটে স্বার্থপর, ক্ষমতালোভী পাণ্ডাদের। কী পরিণতি হবে মনোমায়ার? মেয়েকে নিয়ে পুজো দিতে আসা সৎ, কর্তব্যপরায়ণ ডিএসপি শ্রাবণী কি পারবে সিস্টেমের মধ্যে থেকেও মনোরমার পক্ষ নিতে? নাকি মন্দিরের চত্বরে থাকা অনাথ, দরিদ্র অথচ সৎ মানুষগুলোর একত্রিত প্রতিবাদের আঁচে দগ্ধ হবে অসৎ পূজারী? দেবতা কি চুপ করে বসে থাকবেন? নাকি মন সারানি মনোমায়াকে সঙ্গ দেবেন? এই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে আগামী ১৭ জানুয়ারি, শুক্রবার, তপন থিয়েটারে, ঠিক সন্ধে ৬-৩০। ওইদিনই প্রথম মঞ্চস্থ হতে চলেছে কালিন্দী নাট্যসৃজন প্রযোজিত, বিল্বদল চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত, রমাপ্রসাদ বণিকের নাটক ‘মন সারানি’।
পরিচালক জানালেন, ‘মনোমায়া সোরেন জাতিতে সাঁওতাল। তাই চরিত্রটিতে বাস্তবতা আনার জন্য আমরা বোলপুরের সাঁওতাল গ্রামে দু’দিনের ওয়ার্কশপ করেছি। এ বিষয়ে আমাদের সাহায্য করেছেন বিশ্বভারতীর সংগীত ভবনের নাট্যবিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক তারক সেনগুপ্ত।’
ছোট-বড় মিলিয়ে নাটকে রয়েছে মোট ২৮টি চরিত্র। দেখলাম, কত সহজে, চমৎকার নিষ্ঠায় এবং একাগ্রতায় ‘আমি’ থেকে চরিত্র হচ্ছেন আবার চরিত্রর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন অরূপ দত্ত, শ্রেয়া দত্ত, সুতপা চট্টোপাধ্যায়, অরিন্দম বন্দোপাধ্যায়, শুভরাজ মল্লিক, সায়ন্তি দাস, দেবলীনা রায়চৌধুরী, প্রভাত, কাজল, শম্ভু, অনসূয়া মুখোপাধ্যায়, প্রতাপ মণ্ডল, অরিন্দম হালদার, সায়ন হালদার, অচিন্ত্য মজুমদার, বৈশাখী চক্রবর্তী, শর্মিষ্ঠা বসু, সুমিতা, রনদীপ, বিল্বদল চট্টোপাধ্যায়, মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়রা। চারমাসের দীর্ঘ মহড়ার পর একেবারে তৈরি কুশীলবরা। এমন এক ভাবনা, এমন এক পরিস্থিতিকে নির্দেশক বিল্বদল মঞ্চায়ন করতে চলেছেন, যা দর্শদের ভাবাবে, সমূলে নাড়া দেবে। সরল ছন্দে, গভীর অনুভবের সহজতম প্রকাশের মধ্যে দিয়ে।
মঞ্চ ভাবনায় রনদীপ নন্দী এবং মঞ্চ নির্মাণে মদন হালদার। আলো বাবলু সরকার, সাজসজ্জা শেখ ইব্রাহিম এবং সংগীত মুরারি রায়চৌধুরী।
অজয় মুখোপাধ্যায়
11th January, 2020