পারিপার্শ্বিক কোনও ঘটনা চিন্তা বাড়াতে পারে। সাংস্কৃতিক কর্মে যোগদান ও মানসিক তৃপ্তিলাভ। শরীরের খেয়াল রাখুন। ... বিশদ
কেরিয়ার যখন বাচিকশিল্প
ডাক্তারি পাশ করে সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন গায়ক সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ওরফে সিধু (ক্যাকটাস), পল্লব কীর্তনিয়া, অর্কপ্রভ মুখোপাধ্যায়ের মতো বেশ কয়েকজন। ইঞ্জিয়ারিং পাশ করে ভালো চাকরি পেয়েও তা ছেড়ে নিজের ক্যাফে খুলেছেন চন্দননগরের অভীক দেবনাথ, বড়িশার শাম্ব দত্ত, বেঙ্গালুরুর
ধৃতি শ্রীমানি।
গতভাঙা চাকরির লেখা লিখতে বসে প্রথমেই এই উদাহরণগুলো দিয়ে রাখা সুবিধাজনক। বহু মানুষ যে নিজের কোনও বিশেষ গুণের উপর আস্থা রেখে, সে পথে এগিয়ে কেরিয়ারে সফল হয়েছেন, তা জানলে আত্মবিশ্বাস খানিক বাড়ে।
ইদানীং বিভিন্ন পডকাস্ট, অডিও নাটক, গণমাধ্যমে নিজের পেজে পারফরম্যান্স ইত্যাদি বাচিকশিল্পকে অনেক বেশি পরিচিত করে তুলেছে। তাই বাচিকশিল্পকে কেন্দ্র করে অনেকেই নিজের কেরিয়ার তৈরি করছেন।
বাচিকশিল্প কী?
আপনি ভালো বক্তা, যখন কথা বলেন তখন উপস্থাপনার গুণেই আপনার কথা সকলে শোনেন। তাহলেই কি আপনি বাচিকশিল্পী? তা কিন্তু নয়।
‘বাচন’ থেকে বাচিক কথাটি এলেও বাচিকশিল্প শুধু বলার ভঙ্গি ও উপস্থাপনের উপর নির্ভর করে না। বরং এই শিল্পের অন্যতম জরুরি ক্ষেত্র কণ্ঠস্বরের আবেদন, ওঠাপড়া (মডিউলেশন), উপস্থাপন, কণ্ঠ দিয়ে নাটক তৈরি করতে পারার ক্ষমতা, সুর ইত্যাদি। বাচিকশিল্পে তাই ভয়েস ট্রেনিং অত্যন্ত জরুরি বিষয়। গান, আবৃত্তি, সংবাদ পাঠ, সঞ্চালনা, শ্রুতিনাটক, অভিনয় সবই বাচিকশিল্পের পর্যায়ে পড়ে। তবে গান, আবৃত্তি ও অভিনয়ের ক্ষেত্রে বাচিক চর্চা আঙ্গিকগত দিক থেকে আলাদা। অর্থাৎ এক বাচিকশিল্পে নানা ভাগ রয়েছে। তবে একজন ব্যক্তি একসঙ্গে একাধিক বাচিকশিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আবৃত্তির চর্চা ও শিক্ষা থাকলে তা থেকে সংবাদ পাঠ, সঞ্চালনা, ডাবিং, ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েস ওভার, অডিও নাটক, শ্রুতি নাটক ইত্যাদিতে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে সুবিধা হয়। উচ্চারণ, গলার মডিউলেশন, কণ্ঠ নিয়ন্ত্রণ ও উপস্থাপনার শিক্ষা সবচেয়ে বেশি হয় নাটক ও আবৃত্তিতে। সঙ্গীতচর্চায় উচ্চারণের পাশাপাশি সুরের শিক্ষা, গলার স্কেল তৈরির পাঠ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ।
কীভাবে পেশা করে তুলবেন?
চিরাচরিত অফিসকাছারি বা ব্যবসায় না জড়িয়েও বাচিকশিল্পের মাধ্যমে ইদানীং বেশ মোটা অঙ্কের রোজগার সম্ভব। তবে তার জন্য শুধু ভয়েস ট্রেনিংই যথেষ্ট নয়। সকলের আগে প্রয়োজন নিজের ইচ্ছা ও কাজটির প্রতি নিষ্ঠা ও ভালোবাসা। এ কাজে পরিশ্রমও নেহাত কম নয়। ভালো জায়গা থেকে প্রথমে ভয়েস ট্রেনিং নিন। আবৃত্তি বা শ্রুতি অভিনয়ের চর্চায় যুক্ত হতে পারেন। এরপর নিজের একটি ভয়েস প্রোফাইল তৈরি করুন। নানা আবৃত্তি ও নাটকের অংশ বাদ্যযন্ত্র ছাড়া বা বাদ্যযন্ত্র সহযোগে রেকর্ড করে একটি পেনড্রাইভে ভরে নিজের কাছে রাখুন। আজকাল নানা জায়গায় অনলাইন অডিশন হয় বা পেন ড্রাইভ জমা নেওয়া হয়। সেখানে নিজের একটি পরিবেশনা পেন ড্রাইভের মাধ্যমে জমা দিতে পারেন। তাছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন বিজ্ঞাপন, নানা ওয়েবসাইট, সর্বোপরি নিজের যোগাযোগের উপর ভিত্তি করে দেখতে হবে কোথায় অডিশন চলছে। সেখানে নিজের পারফরম্যান্স নির্বাচিত হলে আপনিও ডাক পাবেন নানা ধরনের কাজে। রাজ্যস্তরেও সরকারি নানা অনুষ্ঠানের জন্য মাঝে মাঝে অডিশন নেওয়া হয়। তবে সেখানে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি, চর্চিত শিল্পীর সংখ্যাও বেশি। আকাশবাণীর মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাও তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী নানা সময়ে নানা বিভাগে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা ও গানের জন্য অডিশন নেয়। তবে সেক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষা, ইন্টারভিউ, ভয়েস টেস্ট— এই তিনটি ধাপ সাফল্যের সঙ্গে পেরলে তবেই সুযোগ মেলে। ভয়েস ওভার শিল্পী হতে চাইলে নিজের বাড়িতেও ছোটখাট স্টুডিও সেট আপ বানিয়ে নিতে পারেন। শিখে নিতে পারেন মিক্সিং, ভয়েস এডিটিং-এর কাজ। এতে কাজের সুবিধা হবে।
কোন কোন পথে রোজগার
চোখ রাখতে হবে সোশ্যাল মিডিয়ায়। অডিশনের খোঁজ মিলতে পারে সেখানেও।
কোনও সংস্থায় বাচিক শিক্ষা ও চর্চার জন্য ভর্তি হলে সেখান থেকেও নানা রকমের অনুষ্ঠান ও কাজের সুযোগ আসতে পারে। এতেই ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের আবৃত্তি বা পাঠের ভিডিও বা রিল বানিয়ে পোস্ট করতে পারেন। তাতেও কিছুটা পরিচিতি পাওয়া যায়। আপনার পারফরম্যান্স অন্যদের কেমন লাগছে, সেটা জানা যায়। টেলিভিশনে বা বেতারে সঞ্চালনা করতে চাইলে তাদের বিজ্ঞাপন ও ঘোষণার উপর চোখ রাখতে হবে। নিজস্ব যোগাযোগের পরিধি ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করলে ও নিজে একটি স্তর পর্যন্ত শেখার পর নিজস্ব প্রতিষ্ঠানও খুলতে পারেন।
নিজে নিজে বাচিকশিল্প শেখা যায়?
এই ক্ষেত্রটি অনেকটাই আগ্রহ, ভালোবাসা ও দক্ষতার একটি মিলিত রূপ। তাই নিজের আগ্রহের সঙ্গে যোগ করতে হবে দক্ষতাকে। ইদানীং সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে নানা কিছু বিনামূল্যেই শেখা যায়। তবে যে কোনও শিল্পকে প্রথম থেকে একটু একটু করে আয়ত্তে আনার কিছু পদ্ধতি আছে। সেসবের জন্য উপযুক্ত ‘গুরু’ বা ‘শিক্ষক’ প্রয়োজন হয়। যেমন ফুটবল, ক্রিকেট বা যে কোনও খেলা শেখার পদ্ধতি শুধু ভিডিও দেখে বা রিলসে দেওয়া নিয়ম দেখে শেখা যায় না, তেমনই যে কোনও শিল্প পেশাগত ভাবে শিখতে চাইলে, একটা স্তর পর্যন্ত তা প্রথাগত শিক্ষার দাবি রাখে। নিজের শখে শিখলে অবশ্য সবসময় শিক্ষকের শরণ না নিয়ে নিজের ইচ্ছামতো চর্চা করে বা অনলাইনেও শেখা যায়।
বাচিকশিল্পে টিকে থাকার যোগ্যতা কী?
কাজটিকে ভালোবাসা, স্পষ্ট উচ্চারণ, ভাষার উপর দখল ও একটি ভালো কণ্ঠের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। ‘ভালো’ কণ্ঠ মানেই খুব রিনরিনে বা চাঁছাছোলা গলা হতে হবে এমন নয়, বরং অনুশীলনের মাধ্যমে এমন একটি চর্চিত গলা তৈরি করতে হয় যার মডিউলেশন, উপস্থাপন, স্বরক্ষেপণ সবেতেই দারুণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তবে বহু বিশেষজ্ঞের মতে, সুর ও কণ্ঠ অনেকটাই ঈশ্বরদত্ত। চর্চা তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
রোজগার কেমন?
কোন সংস্থায় কাজ করছেন, কাদের পরিষেবা দিচ্ছেন এগুলোর উপর নির্ভর করে রোজগার কত হবে। এই শিল্পে বেশ নামডাক আছে এমন শিল্পীরা কেবল বাচিকশিল্পের উপর নির্ভর করে সুন্দরভাবে সংসার চালাচ্ছেন, এমন নজির ভুরি ভুরি রয়েছে। তবে একজন নবীন শিল্পীর পক্ষে এই বিপুল রোজগার প্রথম থেকেই সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে দক্ষতা বাড়ার সঙ্গে অডিশনে নির্বাচিত হলে কাজের পরিধি ও রোজগার দুই-ই সমান তালে বাড়ে।
মনীষা মুখোপাধ্যায়