পারিপার্শ্বিক কোনও ঘটনা চিন্তা বাড়াতে পারে। সাংস্কৃতিক কর্মে যোগদান ও মানসিক তৃপ্তিলাভ। শরীরের খেয়াল রাখুন। ... বিশদ
মিঞা বিবি রাজি, তো কেয়া করেগা কাজী’— এই প্রবাদবাক্য তো সকলেরই চেনা। বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে দু’টি ছেলে, মেয়ে। নিজেরাই পছন্দ করেছে। অথবা সম্বন্ধ করে বিয়ে ঠিক করেছেন দুই পরিবারের সদস্যরা। চেনা ছকে এভাবেই শুরু হয়ে যায় দু’টি মানুষের নতুন জীবন। সেই যৌথ বেঁচে থাকায় অন্য কারও আপত্তিই টেকে না। কিন্তু যদি থাকে গোড়ায় গলদ? অর্থাৎ অপরিচিত দু’টি পরিবার যখন এক সূত্রে গাঁথা হবে, একসঙ্গে পথ চলবে দু’টি মানুষ তখন সবদিক থেকে খবর নিয়ে সম্পর্কে এগনো জরুরি।
সম্বন্ধ করে আজও এই সমাজে প্রচুর বিয়ে হয়। সেসব দাম্পত্যের ইনিংস দারুণ চমকপ্রদ। কিন্তু প্রদীপের তলায় লুকিয়ে থাকে অন্ধকারও। সম্বন্ধের বিয়েতে ঠিকমতো খোঁজ নেওয়া হয়নি, তার
জেরে চরম পরিণতির পরিস্থিতিও আসে সংবাদ শিরোনামে। সে কারণে বিয়ের আগে সম্বন্ধের সময় জালিয়াতি আটকাতে ঠিক কী ধরনের বিষয়ে সতর্ক থাকবেন?
ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটগুলো বর্তমানে জনপ্রিয়। কারণ মানুষের হাতে সময় কম। ফলে সহজেই পাত্র-পাত্রী খুঁজে পাওয়ার সুযোগ করে দেয় এই ধরনের ওয়েবসাইট। তবে, এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধও সংঘটিত হতে পারে। সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ রাজর্ষি রায়চৌধুরী জানালেন, সাইবার অপরাধীরা ভুয়ো প্রোফাইল তৈরি করে প্রতারণা, ব্ল্যাকমেল, অর্থ আত্মসাৎ, ফিশিং, স্টকিং এবং অন্যান্য অপরাধ করে। ফলে ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইট থেকে বিয়ের সম্বন্ধ করলে কয়েকটি বিষয় যাচাই করে নিতে হবে।
বিয়েতে সাইবার অপরাধের ধরন
প্রতারণামূলক প্রোফাইল তৈরি করে প্রতারণার ঘটনা প্রচুর ঘটে। অপরাধীরা ভুয়ো ছবি ও মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করে বিয়ের বাজারে আকর্ষণীয় প্রোফাইল তৈরি করে। উচ্চপদে চাকরি, ভালো পারিবারিক ঘরানা, বিদেশে স্থায়ী বসবাসের দাবি করে। এই প্রোফাইল দেখে কারও পছন্দ হলে, সেখান থেকে অপরাধীরা ভুয়ো প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। সম্পর্ক কিছুদূর এগলে তারা ভিসা, টিকিট, মেডিকেল ইত্যাদি নানা কারণ দেখিয়ে অর্থ দাবি করে। সেই অর্থ আদায় হয়ে গেলে নিমেষে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।
বিয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়ার ওয়েবসাইটে ফিশিং ও ব্যক্তিগত তথ্য চুরির ঘটনা বহুলাংশে ঘটে বলে দাবি করলেন রাজর্ষি। প্রতারকরা বিভিন্ন লিঙ্ক পাঠিয়ে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে। সম্পর্ক তৈরি করে আস্থা অর্জন করে। তারপর ইমেল বা মেসেজের মাধ্যমে বিভিন্ন পাসওয়ার্ড, ব্যাঙ্কের নানা তথ্য সংগ্রহ করে নেয়। এমনকী ভুয়ো ওয়েবসাইট বানিয়ে লগ-ইন করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। সেখান থেকেও ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করা হয়।
এই ধরনের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অপরাধীদের হাতে একটি মানুষের বেশিরভাগ ব্যক্তিগত তথ্য চলে আসার ফলে ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায় বা সাইবার হুমকি দেওয়া খুব সহজ কাজ। অপরাধীরা প্রথমে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও বা তথ্য সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে সেটাই কাজে লাগিয়ে ব্ল্যাকমেল করে এবং অর্থ দাবি করে। যদি ভুক্তভোগী টাকা দিতে অস্বীকার করে, তবে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য বা ছবি ফাঁস করার হুমকি দেয়।
সাইবার স্টকিং ও হয়রানির শিকার হন অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখতে আসা বহু বিবাহে ইচ্ছুক ব্যক্তি। পুরুষ, মহিলা নির্বিশেষে এই ধরনের হয়রানির শিকার হন। অপরাধী ভুক্তভোগীর বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে তাকে অনলাইনে তাকে অনুসরণ করে ও হয়রানি করে। সোশ্যাল মিডিয়া, ইমেল, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বারবার বিরক্ত করা হয়। কখনও কখনও ভুয়ো প্রোফাইল তৈরি করে মানহানিকর তথ্য ছড়ানো হয়।
যে মানুষটিকে আপনি চেনেন না, অথচ তার সঙ্গে আলাপ কোনও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে, তাকে যাচাই করে তবে বিশ্বাস করুন। হতে পারে তিনি স্বল্প পরিচয়েই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু তার নেপথ্যে অর্থ আত্মসাৎ ও লোভনীয় প্রতারণার (ফিনান্সিয়াল ফ্রড অ্যান্ড ম্যারেজ স্ক্যাম) পরিকল্পনা রয়েছে কি না, তা যাচাই করে নিন। প্রতারক প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং অর্থ চায়। কখনও কখনও ব্যবসায় বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়। আবার ‘ফরেন গিফট স্ক্যাম’ নামক কৌশলে উপহার পাঠানোর নাম করে কাস্টমস ফি বা অন্যান্য চার্জ দাবি করার ঘটনাও ঘটে। প্রতারক দাবি করে যে সে বিদেশে থাকে এবং একটি মূল্যবান উপহার পাঠিয়েছে, কিন্তু কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য টাকা দরকার।
শুধু যে প্রাপ্তবয়স্করা হেনস্তার শিকার হন, তা নয়। অনেক সময় এই ধরনের সাইবার অপরাধের শিকার হয় কিশোর-কিশোরীরাও। তাদের টার্গেট করে শোষণ করা হয়। বিয়ের বয়স, মানসিকতা না তৈরি হলেও এই ধরনের ওয়েবসাইটে অপ্রাপ্তবয়স্কদেরও যাতায়াত রয়েছে। মোবাইল এখন সকলের হাতে থাকায়, যে কোনও জায়গায় যোগ্যতা ছাড়াও প্রবেশাধিকার প্রায় সকলেরই। সেই সুযোগই নেয় প্রতারকরা। অপরাধীরা কিশোর-কিশোরীদের টার্গেট করে এবং ধীরে ধীরে তাদের বিশ্বাস অর্জন করে। অনলাইনে গোপনে দেখা করার জন্য প্রলুব্ধ করে। পরে ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও সংগ্রহ করে এবং ব্ল্যাকমেল করে।
ডিপফেক ও ডিজিটাল ম্যানিপুলেশনের ঘটনা সাইবার অপরাধের ধারায় অনেকটা বেড়েছে বলে দাবি করলেন রাজর্ষি। প্রতারকরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে ডিপফেক ছবি বা ভিডিও তৈরি করে। ভুক্তভোগীর সম্মানহানির জন্য মিথ্যা ভিডিও বানানো হয়। পরে এটি ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেল করা হয়।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। মোবাইলে বন্দি দুনিয়া। ফলে আপনাকেও এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কৌশল শিখতে হবে। অনলাইন বিজ্ঞাপন দেখে বিয়ে হওয়ার পর সুখে আছেন, এমন দম্পতির সংখ্যা অনেক। ফলে কোন পথে এগলে খানিক নিশ্চিন্তে পা ফেলা সম্ভব, তার হদিশ দিলেন রাজর্ষি।
নিরাপদে প্রোফাইল তৈরি করুন। পরিচয়পত্র যাচাই করা সাইট বেছে নিন। নিজের ব্যক্তিগত তথ্য সীমিত রাখুন। পরিচয় পর্ব, সামনে দেখা হওয়া ইত্যাদি বাড়লে তখন ব্যক্তিগত তথ্যের আদানপ্রদান বাড়ুক। তার আগে সমঝে চলাই শ্রেয়।
অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে কোনও তথ্য শেয়ার করবেন না। ফোন নম্বর, ঠিকানা, ব্যাঙ্কের কোনও তথ্য অপরিচিতদের দেবেন না। সন্দেহজনক প্রোফাইল মনে হলে যোগাযোগ সীমিত রাখুন।
বিয়ের বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত সাইটগুলোতে ঢুকে যাদের সঙ্গে প্রথম আলাপ হল, তাদের সঙ্গে কোনওরকম আর্থিক লেনদেন এড়িয়ে চলুন। কোনও অবস্থাতেই অপরিচিত ব্যক্তির জন্য অর্থ লেনদেন করবেন না। গিফট বা কাস্টমস চার্জের ফাঁদে পড়বেন না।
সন্দেহজনক কার্যকলাপ দেখলেই রিপোর্ট করুন। মনে রাখবেন, সম্পর্ক তৈরি হওয়া মানেই তার ভবিষ্যৎ রয়েছে, তা নয়। নানাভাবে যাচাই করার পর যদি আপনার সঙ্গীকে নিজের যোগ্য মনে করেন, তবেই এগবেন। প্রয়োজনে ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটের রিপোর্ট অপশন ব্যবহার করুন। সাইবার ক্রাইম সেল বা পুলিসে অভিযোগ জানান।
অনলাইন আলাপে ভিডিও কল অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু অচেনা ব্যক্তির সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলার আগে নানা দিক যাচাই করে নিন। এমনকী মুখোমুখি দেখা করার সময়ও সতর্ক থাকুন। পাবলিক
প্লেসে দেখা করার চেষ্টা করুন। দেখা করতে যাওয়ার আগে কোথায় যাচ্ছেন, তা পরিবারের সদস্য বা কাছের বন্ধুদের জানিয়ে রাখুন।
ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটগুলি বৈধ সম্পর্ক তৈরির একটি ভালো মাধ্যম হলেও, অপরাধীরা এসব প্ল্যাটফর্মকে টার্গেট করে থাকে। তাই সুরক্ষিত থাকার জন্য প্রযুক্তিগত সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। সন্দেহজনক কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।