সপরিবারে নিকট ভ্রমণের পরিকল্পনা। সহকর্মীরা কর্মক্ষেত্রে শত্রুতা করতে পারে। নতুন কোনও কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মক্ষেত্রে বদলির ... বিশদ
আলমারির এক কোণে রাখা ছোট্ট পুঁটলি। তার মধ্যে রাখা সরু সোনার চেন। একজোড়া বালা। নকশা কাটা কানের দুল। এই হল মধ্যবিত্ত গিন্নির সম্পত্তি। ‘স্ত্রীধন’। আপদে বিপদে যদি কাজে লাগে, তাই তুলে রাখা থাকে সেই সম্পদ। হঠাৎ প্রয়োজন হোক অথবা শেষ বয়সের সম্বল ‘স্ত্রীধন’ আঁকড়ে কেটে গিয়েছে কত না জীবন! কেউ ‘স্ত্রীধন’ সম্পূর্ণ ভোগ করতে পেরেছেন। সময়ের নিয়মের তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর হয়েছে। কেউ বা এর মানেই জানেন না। আবার ‘স্ত্রীধন’-এর উপর অধিকার বুঝে নিতে আদালতের দরজায় ঘুরে ঘুরে কারও সময় ফুরিয়েছে।
‘স্ত্রীধন’ আসলে কী? এর উপর মেয়েদের অধিকারই বা কতটা? ব্যাখ্যা করলেন আইনজীবী রুমানিয়া বাগচী ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘স্ত্রীধন কথাটার মধ্যেই এর মানে স্পষ্ট। যা নারীর সম্পত্তি। যার উপর তার একান্ত অধিকার রয়েছে। নারীর স্ব-উপার্জিত সম্পত্তি। হিন্দু সাকসেশন অ্যাক্ট, ১৯৫৬ সেকশন ১৪-এ স্ত্রীধন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। হিন্দু সাকসেশন আইনে খুব সুন্দরভাবে মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর সুবিধা শুধুমাত্র হিন্দুরাই পাবেন। এখনও আমাদের পারিবারিক আইন সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। গোটা দেশে সমান পারিবারিক আইন তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এখনও তা হয়নি।’
আইনজীবী জানালেন, পুরুষ, নারী নির্বিশেষে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা খুব জরুরি। যখন দেখা গেল সমাজে মেয়েদের মাথা উঁচু করা দরকার, তাদের পায়ের তলার জমি শক্ত করা দরকার, তখন এই আইন প্রণয়ন হল। স্ত্রীধনের অধিকার দেওয়া হল মেয়েদের। এর আওতায় কী কী রয়েছে? রুমানিয়া বললেন, ‘যে কোনও স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তি স্ত্রীধন হিসেবে গ্রাহ্য হবে। জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট হল স্থাবর সম্পত্তি। যেগুলো এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় সরানো যায় না। আর গয়না, টাকা, বিয়েতে পাওয়া উপহার হল অস্থাবর সম্পত্তি। যা এক জায়গা থেকে সরিয়ে আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। এই দুটোর ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ অধিকার মেয়েদের দেওয়া হয়েছে।’
পণপ্রথা এখনও ভারতীয় সমাজের এক ব্যাধিরই নামান্তর। যদিও পণও একপ্রকার স্ত্রীধন। তবে এই দুইয়ের মধ্যেও বিভিন্নতা রয়েছে আইনে। আইনজীবী জানালেন, ১৯৮৬ সালের ‘প্রতিভা রানি ভার্সেস সূরজ কুমার’ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট পণ এবং স্ত্রীধনের মধ্যে পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়। আদালত জানায়, বিয়ের সময় কোনও মেয়ে বাবা, মা, ভাই, দাদা, দিদি, বোনের থেকে যে উপহার পাচ্ছে তা স্ত্রীধন। শ্বশুর শাশুড়ির থেকে প্রাপ্ত উপহারও স্ত্রীধন বলেই বিবেচিত হয়। বিয়ের সময় যজ্ঞের যে আগুন জ্বালানো হয়, তার সামনে যদি কোনও উপহার মেয়েটিকে দেওয়া হয়, সেটাও স্ত্রীধন। প্রণাম করার পর আত্মীয়রা যে উপহার দিচ্ছেন, সেটাও স্ত্রীধন। এই ‘স্ত্রীধন’ স্বামী এবং শ্বশুর, শাশুড়ি ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু স্ত্রী যদি কখনও তা ফেরত চান, তা ফিরিয়ে দিতে তাঁরা বাধ্য। এছাড়া কোনও মেয়ের নিজের উপার্জন সব সময়ই স্ত্রীধনের আওতায় পড়বে। পণ হিসেবে মেয়েকে যা দেওয়া হচ্ছে তা পড়বে স্ত্রীধন-এর আওতায়।
আইনত যেসব সম্পত্তি মেয়েদের হস্তান্তর করা হয়, তার উপর অধিকার প্রমাণ করতে বিশেষ সমস্যা হয় না। কিন্তু যে ধরনের ‘স্ত্রীধন’-এর কোনও আইনি নথি নেই, সেক্ষেত্রে সমস্যা হয়। উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন রুমানিয়া। ‘জমি, বাড়ি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিলই তার প্রমাণ। কিন্তু বিয়ের সময় বাবা, মা, শ্বশুর শাশুড়ি অথবা কোনও আত্মীয় উপহার হিসেবে একটি মেয়েকে যে গয়না দিচ্ছেন, তার কোনও লিখিত তথ্য থাকে না। ফলে প্রয়োজনে সেটা যে তারই ‘স্ত্রীধন’, তা আদালতে প্রমাণ করা একটু কঠিন হয়ে যায়। অনেক সময় বিয়ের তারিখের আগের কোনও তারিখে যদি গয়নার দোকানের কোনও ‘ক্যাশমেমো’ মেয়েটি দেখাতে পারেন, তখন ধরে নেওয়া হয়, মেয়ের বিয়ের আগে তাঁর বাবা ওই গয়না বিয়ে উপলক্ষ্যেই কিনেছিলেন এবং তাকে উপহার দিয়েছিলেন। সেটা প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হবে। ধরে নেওয়া হয় বিয়ের আগে বানিয়েছেন মানে মেয়ের জন্যই বানিয়েছেন।’
২০০৫-এর সেপ্টেম্বরে হিন্দু সাকসেশন আইনে একটি সংশোধন হয়। সেখানে মেয়েদের আরও বেশি অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেটা কী? রুমানিয়া বলেন, ‘২০০৫ থেকে পিতৃপুরুষের সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার দেওয়া হল। সুপ্রিম কোর্ট জানায়, একজন মেয়ে বাবার সম্পত্তিতে ভাইয়ের সমান অধিকার পাবে। তার আগে পৈতৃক সম্পত্তি বিশেষত বাড়ির ক্ষেত্রে মেয়েদের কোনও অধিকার ছিল না। কিন্তু আদালত জানাল, বাবার সম্পত্তিতে সমান অধিকার পাবে মেয়েরাও। শুধু সম্পত্তির অধিকার পাওয়াই নয়। বাবা, মায়ের সব দায়িত্বও সমানভাবে মেয়েদের নেওয়ার কথা আইনেই রয়েছে।’
শুধু স্ত্রীধন ভোগ করা নয়, তা যাতে বংশপরম্পরায় সঠিক ব্যক্তি হাতে পৌঁছয় তার দিক নির্দেশও দেওয়া রয়েছে আইনে। কোনও মহিলার মৃত্যুর পর ‘স্ত্রীধন’-এর কী হবে? আইনজীবীর কথায়, ‘মহিলার সন্তান এবং স্বামী বেঁচে থাকলে তাদের মধ্যে স্ত্রীধন সমানভাবে ভাগ হয়ে যাবে। আর কোনও মহিলা নিঃসন্তান হলে এবং স্বামী মারা গেলে, কী হবে? আইনত যে সম্পত্তি মেয়েটিকে তাঁর বাবা দিয়েছিলেন, তা আবার বাবার পরিবারের কাছে বা তাঁদের উত্তরাধিকারীদের কাছে ফেরত যাবে। আর যে সম্পত্তি শ্বশুরবাড়ির তরফে প্রাপ্ত, সেগুলো ওই পরিবারের পরের প্রজন্মের কাছে ফেরত যাবে।’