বিদ্যার্থীদের পঠনপাঠনে আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের কর্মপ্রাপ্তির যোগ। বিশেষত সরকারি বা আধা সরকারি ক্ষেত্রে যোগ প্রবল। ... বিশদ
হাসপাতাল তৈরি করবেন এমন ভাবনা মাথায় এল কীভাবে?
আমি জয়পুরের মেয়ে। ওখানকার মেডিক্যাল কলেজ থেকেই ডাক্তারি পাশ করেছি। তারপর চাকরিসূত্রে ১৯৮৬ সালে কলকাতায় এলাম। কেরিয়ারটা চাকরি দিয়ে শুরু করেছিলাম বটে, কিন্তু নিজের হাসপাতাল গড়ে তোলার একটা ইচ্ছে মনে মনে ছিল। সেই মতো নিজেকে তৈরি করছিলাম। কিন্তু দেখলাম, ভাবনা আর বাস্তবের মধ্যে অনেক ফারাক থেকে যাচ্ছে। যেমন ভেবেছিলাম, কাজের বেলায় ঠিক তেমনটা করতে পারছি না। ফলে প্রস্তুতিটা আরও বাস্তবোচিত করতে শুরু করলাম। অনেক পড়াশোনা আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই আমার নিজস্ব হাসপাতাল তৈরি করতে পেরেছি। এবং প্রতি পদে বুঝেছিলাম হাসপাতাল তৈরি করা মুখের কথা নয়! আমার সৌভাগ্য, আমার স্বামী ও গোটা পরিবার এই কাজে সবসময় সাহায্য করেছে।
কিন্তু নিজের হাসপাতাল গড়ে তোলার এই প্রবল ইচ্ছেটা পেয়ে বসেছিল কেন?
পড়াশোনা, ইন্টার্নশিপ এবং চাকরিসূত্রে বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করেছি। সেইসব হাসপাতালের পরিবেশ খুঁটিয়ে দেখেছি। সেখানকার কাজের পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। এবং এসব করতে করতেই হাসপাতাল তৈরি করার ইচ্ছেটা প্রবলভাবে পেয়ে বসেছিল আমাকে। বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে এবং কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয় চিকিৎসামাধ্যমের এমন কিছু দিক রয়েছে, যার পরিষেবা এখনও সঠিকভাবে পূরণ হয়নি। সেই ভাবনা থেকেই নিজস্ব হাসপাতাল তৈরির ইচ্ছে জাগে মনে।
আপনার হাসপাতাল আইএলএস-এর ইউএসপি বা বিশেষ আকর্ষণ কী?
ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি। ১৯৯৮ সাল নাগাদ যখন আমার হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল, ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির কনসেপ্ট বা ধারণা আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে খুব একটা স্পষ্ট ছিল না। ওটা তখনও ছিল তথাকথিত নতুন কনসেপ্ট। ফলে সেই নিয়ে নাড়াচাড়া করা এবং এই ধরনের সার্জারির সঠিক পরিষেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদেই আমি আইএলএস হাসপাতালটাকে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি স্পেশালিটি হসপিটাল হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। প্রথম যখন হাসপাতাল তৈরি করলাম তখন মাত্র ৮টা বেড নিয়ে ল্যাপারোস্কোপিক স্পেশালিটি ইনস্টিটিউট হিসেবেই তা শুরু করি।
ক্রমশ হাসপাতাল বাড়ানোর ভাবনা কি ব্যবসায়িক না কি পরিষেবা কেন্দ্রিক?
অবশ্যই পরিষেবা কেন্দ্রিক। ক্রমশ বুঝতে পারলাম মাত্র ৮টা বেড আর একটা বিভাগ থাকলে রোগীদের সঠিক পরিষেবা দেওয়া অসম্ভব। তখন লোকের চাহিদা অনুযায়ী তা বাড়ানোর চেষ্টা করলাম। যখন যেমন সংস্থান হয়েছে, তখন তেমনভাবেই হাসপাতালটা বাড়িয়েছি। যেমন আটটা বেডের ল্যাপারোস্কোপিক স্পেশালিটির পর হাসপাতালে আর একটা তলা যুক্ত করে সেখানে মেটারনিটি ইউনিট শুরু করি। তখন ল্যাপারোস্কোপি আর মেটারনিটি দিয়েই হাসপাতাল চালাচ্ছিলাম। তারপর ক্রমশ আরও তলা যুক্ত করি এবং সার্জিকাল ইউনিট, মেডিসিনাল ইউনিট ইত্যাদি খুলতে শুরু করি। তবে এগুলোর জন্য অনেক সময় লেগেছে। ব্যবসায়িক মনোভাব থাকলে প্রথমেই বড় করে হাসপাতাল খুলতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি। লোকের প্রয়োজন, চাহিদা ও রোগীদের সঠিক পরিষেবার কথা মাথায় রেখেই একে একে ইউনিট বাড়িয়েছি।
একজন মহিলা হিসেবে হাসপাতাল চালানোর অভিজ্ঞতা কেমন?
দেখুন, আমি প্রথমে একজন ডাক্তার, তারপর মহিলা। ফলে হাসপাতাল চালানোর ক্ষেত্রে আমার পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ বজায় রাখি। একজন ডাক্তার হিসেবে হাসপাতাল গড়ে তোলা এবং চালানোটাই আমার ইউএসপি, মহিলা সত্তাটা সেক্ষেত্রে গৌণ। তবে হাসপাতাল তৈরি ও চালানোর কাজটা সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং। নিজের হাসপাতালে নিজের মতো করে ডাক্তারি করতে পারছি, এটা আমার সৌভাগ্য। তাতে অবশ্য হাসপাতাল চালানোর চ্যালেঞ্জটা একটুও কমে না। তবে আমি যেহেতু নিজের ডাক্তারিতে মনঃসংযোগ করতে চাই, তাই হাসপাতাল চালানোর প্রশাসনিক দিকটা পেশাদার হাতে তুলে দিয়েছি। একজন সিইও আছেন যিনি হাসপাতালের প্রশাসনিক দিকটা দেখেন। আমি মন দিয়ে রোগী দেখতে পারি।
সংসার, পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রকে ব্যালান্স করেন কীভাবে?
একজন স্ত্রী, মা এবং মহিলা হিসেবে প্রতি মুহূর্তেই অনুভব করেছি যে সংসার, সন্তান, পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রকে সঠিকভাবে ব্যালান্স করা খুবই কঠিন। তাই বলে যে তা অসম্ভব তা-ও নয়। আমি জীবনটাকে বিভিন্ন বিভাগে ভেঙে নিয়েছি। দিনের ২৪ ঘণ্টার হিসেবে সেই বিভাগগুলো একে অপরের চেয়ে একেবারেই পৃথক। যেমন সকালে উঠে প্রথম দু’ঘণ্টা সময় সংসারের পিছনে ব্যয় করি। তারপর মোটামুটি পাঁচ থেকে ছ’ঘণ্টা বরাদ্দ থাকে কর্মক্ষেত্রের জন্য। তারপর দুপুরের পর থেকে বেশ খানিকটা সময় শুধু ছেলেমেয়েদের পিছনে ব্যয় করে বাকি কিছুটা নিজের জন্য আর কিছুটা পরিবারের অন্যান্যদের পিছনে ব্যয় করি। এই রুটিনে রোজ চলে দেখেছি বেশ ভালোই ফল পাওয়া যায়। জীবনের কোনও ক্ষেত্রই অবহেলিত হয় না। তবে কর্মক্ষেত্র ছাড়া বাকি সময়টা অন্যান্যদের প্রয়োজন অনুযায়ী ভাগ করতে হয়। যেমন অনেক সময় সংসার বেশি সময় দাবি করে, সন্তান কম। আবার কখনও সন্তান বেশি সময় চায়, তখন সংসার বা অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে সময় কমিয়ে তার পিছনে দিতে হয়। তবে কর্মক্ষেত্র যেহেতু অনেকটা সময় নিয়ে নেয়, তাই আমি ঠিক করেছি ওই সময়টাকে বেঁধে দেব। মানে রোজই দুপুর ৩টে পর্যন্ত হাসপাতালে কাটাই। ৩টের পর থেকে বাদ বাকি সময় বাড়ি, সংসার, পরিবার এবং নিজের জন্য তোলা থাকে। এইভাবেই সবদিক বজায় রেখে চলছি।
মহিলা ব্যবসায়ী হিসেবে জীবনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
আমি যেহেতু ডাক্তার হিসেবে হাসপাতাল তৈরি করেছি, তাই মহিলা ব্যবসায়ী হিসেবে কোনওদিন নিজেকে দেখিনি। আমার আশপাশেও কেউ আমাকে মহিলা ব্যবসায়ী হিসেবে দেখেন না। বরং ডাক্তার হিসেবেই দেখেন। ফলে মহিলা ব্যবসায়ী হিসেবে কোনও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন কখনও হতে হয়নি। কিন্তু ডাক্তার এবং হাসপাতালের কর্ণধার হয়ে কাজ করাটা অবশ্যই একটা চ্যালেঞ্জ। বিশেষত বাচ্চারা যখন ছোট ছিল তখন তাদের সময় দেওয়া, ডাক্তার হয়ে রোগীদের সময় দেওয়া এবং হাসপাতালের কাজ সামলানোর মধ্যে সর্বক্ষণের একটা টানাপোড়েন চলত। কিন্তু আমার পরিবারের সবাই সেক্ষেত্রে আমায় সাহায্য করেছে। হাসপাতালে রোগীদের প্রয়োজনে যখন আমায় বেশি সময় থাকতে হয়েছে, তখন পরিবার আমার বাচ্চাদের দেখভাল করেছে। আমি মন দিয়ে ডাক্তারি করেছি। পারিবারিক সমর্থন ছিল বলেই একজন সাধারণ ডাক্তার থেকে একটা হাসপাতালের কর্ণধার হয়ে উঠতে পেরেছি।
আগামী দিনের মহিলা ব্যসায়ীদের প্রতি আপনার বার্তা কী?
যে কোনও কাজই কঠিন। যে কোনও কাজেই চ্যালেঞ্জ আছে। কিন্তু নিজেকে সম্পূর্ণভাবে যদি কোনও কাজে ঢেলে দেওয়া যায়। একনিষ্ঠভাবে, মন দিয়ে যদি কোনও কাজ করা যায় তাহলে সাফল্য আসবেই। ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে চলবে না। অনেকেই বলেন, আমাদের সমাজ মেয়েদের সহায় হয়ে ওঠে না সহজে। কিন্তু আমার তো মনে হয় আমাদের সমাজেও মেয়েদের যথেষ্ট সুযোগ আছে। বিশেষত মহিলা ব্যবসায়ীদের তো নানারকম সুযোগ সুবিধে দেয় আমাদের সমাজ। যেমন স্বল্প লগ্নিতে ঋণের ব্যবস্থা রয়েছে। মেয়েদের উচিত চোখ-কান খোলা রেখে প্রতিটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। তাহলে কোনও কাজই কঠিন হবে না। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন হল ভারসাম্য বজায় রাখা। পারিবারিক জীবন আর কর্মক্ষেত্রকে ব্যালান্স করতে না পারলে কিন্তু কোনও কাজই করা সম্ভব নয়। আর সেটা শুধু ব্যবসার ক্ষেত্রেই নয়, চাকরির ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। আমার মনে হয় সঠিক মানসিকতা ও পরিশ্রমী মেজাজ মেয়েদের সাফল্যের চাবিকাঠি। এই দু’টি জিনিস থাকলে আমরা মেয়েরাই পারি শিখরে পৌঁছতে। সহজে কোনও কিছুই হয় না। সজাগ দৃষ্টিভঙ্গিতে নিজের ১০০ শতাংশ দিয়ে কোনও কাজ করলে সাফল্য আসবেই।