বিজ্ঞান গবেষণা ও ব্যবসায় আজকের দিনটি শুভ। বেকাররা চাকরি প্রাপ্তির সুখবর পেতে পারেন। ... বিশদ
লোকসভা ভোটে দেশের শাসক দল সাধারণত কিছুটা অ্যাডভান্টেজ পায়। চব্বিশের ভোটে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে বিরোধীদের কোনও সর্বসম্মত প্রার্থীই ছিল না। তাই হ্যাং পার্লামেন্ট, ফের ভোট প্রভৃতির আশঙ্কায় ফ্লোটিং ভোটারদের একটা বড় অংশ বিজেপির দিকে গিয়েছিল। আবার বিধানসভা উপ নির্বাচনে সাধারণত অ্যাডভান্টেজ পেয়ে থাকে রাজ্যের শাসক দল। তবে উল্টোটাও হয়। তাকে ব্যতিক্রমী বলাই ভালো। প্রার্থী বাছাই ঠিক না হওয়ায় জেতা আসনের উপ নির্বাচনেও হেরেছিল তৃণমূল। উদাহরণ সাগরদিঘি।
এবার যে ছ’টি আসনে উপ নির্বাচন হতে চলেছে, তার মধ্যে মূল আকর্ষণ মাদারিহাটকে ঘিরে। একুশের নির্বাচনে বিজেপি জিতেছিল। লোকসভা ভোটেও এগিয়েছিল। এখন প্রশ্ন, উপ নির্বাচনেও বিজেপি কি সেই ট্র্যাডিশন ধরে রাখতে পারবে?
অনেকে মনে করেন, মনোজ টিগ্গার জন্য মাদারিহাটে বিজেপির মাটি কিছুটা হলেও শক্ত হয়েছে, একই সঙ্গে বেড়েছে দ্বন্দ্বও। আলিপুরদুয়ার লোকসভা আসনটি হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী জন বার্লাকে ছেঁটে টিগ্গাকেই টিকিট দিয়েছিল বিজেপি। মনোজ জিতেছেন ঠিকই। কিন্তু বিজেপির অন্দরের ফাটল চওড়া হয়েছে। জন বার্লা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। ফলে চা বাগানে বিজেপির ভোট ভাগাভাগি নিশ্চিত।
একুশের নির্বাচনে মাদারিহাটে বিজেপি জিতেছিল প্রায় ২৯ হাজার ভোটে। লোকসভা নির্বাচনে তা নেমে এসেছে ১১ হাজারে। এবার আরও ধস নামার আশঙ্কা। তা সত্ত্বেও রাহুলকে প্রার্থী করেছেন মনোজ। রাহুল জিতলে দলে টিগ্গাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কেউ থাকবে না। এমনকী, তাঁর কপালে জুটতে পারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বও। আর রাহুল হারলে? চাপে পড়বেন মনোজ। তাই মাদারিহাটের লড়াই যতটা বিজেপি-তৃণমূলের, ঠিক ততটাই মনোজ টিগ্গা-জন বার্লার।
মাদারিহাটের বিজেপি প্রার্থীকে নিয়ে তোলপাড় চলছে। বাম আমলের দাপুটে সিটু নেতা তারকেশ্বর লোহারের ছেলে রাহুলকে বিজেপি প্রার্থী করায় অনেকেই চা-বাগানে ‘লাল সন্ত্রাসে’র দিনগুলো ফিরে আসার ভয় পাচ্ছেন। চা-বাগানে মিটিং, মিছিল, প্রচার জোরকদমে চলছে। তবে, এই আসনের ললাট লিখন হবে ১২ নভেম্বর রাতে। লোকে বলে, চা-বাগানে ভোটের আগের রাতটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘অতিথি আপ্যায়নে’র উপরেই ঠিক হয় বাগানের ভোটের অভিমুখ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র রাষ্ট্রমন্ত্রী নিশীথ অধিকারীকে হারিয়ে ছিলেন সিতাইয়ের বিধায়ক জগদীশ বাসনিয়া। তারপর থেকেই কোচবিহারে বিজেপির ছন্নছাড়া অবস্থা। সিতাইয়ে বিজেপি অনেকটাই ব্যাকফুটে। লড়াইয়ে ফিরতে মরিয়া বিজেপি নেমেছে ব্যক্তি আক্রমণে। তৃণমূল প্রার্থী সঙ্গীতা রায় বাসনিয়ার সঙ্গে জগদীশবাবুর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বৈধ না অবৈধ, এই প্রশ্ন তুলে বাজার গরম করছে। তাতে ভোটে প্রভাব পড়বে কি না বলা কঠিন। কিন্তু এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মীরা দলীয় প্রার্থীকে রেকর্ড ভোটে জেতানোর শপথ নিয়েছেন। সেটা বিজেপির জন্য একটু বেশিই চাপের হতে পারে।
বাঁকুড়ার তালডাংরা আসনে উপ নির্বাচন হচ্ছে। বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রে সিপিএমের বাসুদেব আচারিয়াকে হারিয়ে ‘জায়ান্ট কিলার’ হয়েছিলেন মুনমুন সেন। তাতে তৃণমূল এককালীন লাভ ঘরে তুলেছিল। কিন্তু ক্ষতি হয়েছিল দীর্ঘমেয়াদি। বীরভূমের শতাব্দী রায়ের মতো মুনমুন সেন ‘জনপ্রতিনিধি’ হতে পারেননি, ‘সেলিব্রিটি’ ইমেজেই আটকে ছিলেন। তারপর থেকে ‘সেলিব্রিটি’ ও কলকাতার প্রার্থীদের উপর বাঁকুড়ার ভোটারদের ভীষণ অনীহা। এই কারণেই মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতো ‘কাজের মানুষ’ও বাঁকুড়ায় হেরেছিলেন। একুশের ভোটে হেরেছেন অভিনেত্রী সায়ন্তিকাও। এবার ভূমিপুত্রকে প্রার্থী করার দাবি মানতেই কিস্তিমাত। জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি তথা তালডাংরার বিধায়ক অরূপ চক্রবর্তীকে টিকিট দিয়েছিল তৃণমূল। তাতেই সুভাষ সরকারের মতো হেভিওয়েট নেতাকেও অরূপবাবু হারিয়ে দিলেন। পৌঁনে দু’লক্ষ ভোটের ব্যবধান মুছে দিলেন অনায়াসে। অরূপ চক্রবর্তী জিতলেন প্রায় ৩৩ হাজার ভোটে।
এবার উপ নির্বাচনেও তালডাংরার প্রার্থী হওয়ার জন্য কলকাতার এক তৃণমূল নেতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু লোকসভার কথা মাথায় রেখে তৃণমূল ভরসা রেখেছে সেই ভূমিপুত্রেই। অন্যদিকে বিজেপির প্রার্থী বাঁকুড়া পুরসভার কাউন্সিলার। তাঁর বিরুদ্ধে আঙুল তোলার কিছু নেই। কিন্তু গায়ে লেগে রয়েছে তৃণমূলের গন্ধ। প্রার্থী হওয়ার কয়েক দিন আগেই সুকান্ত মজুমদারের হাত ধরে বিজেপি হয়েছেন তিনি। তাই বিজেপিতে জমেছে ক্ষোভ। কেউ ক্ষোভে বসে গিয়েছেন, কেউ আবার ‘দলবদলু’দের টিকিট দেওয়ার প্রতিবাদ জানাতে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। যোগদান প্রক্রিয়া অব্যাহত। তাতে বিজেপির জন্য লড়াইটা একটু বেশিই কঠিন হয়ে গেল।
প্রার্থী নির্বাচন সঠিক হলে কঠিন লড়াইও সহজ হয়। আর ভুল হলেই ‘সাগরদিঘি’। জেতা আসনও হাতছাড়া হয়। তাই উপ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে গুরুত্ব দিয়েছে তৃণমূল। মেদিনীপুরে তৃণমূলের প্রার্থী ভূমিপুত্র সুজয় হাজরা। জেলা সভাপতি। সাংগঠনিক মানুষ। এটা তৃণমূলের বাড়তি অ্যাডভান্টেজ। তবে, এখানে দিলীপ ঘোষকে বিজেপি প্রার্থী করলে ‘খেলা’টা জমে যেত। তৃণমূল লড়াইটা এত হালকা চালে নেওয়ার সাহস পেত না।
নৈহাটি কেন্দ্রেও অর্জুন সিংকে প্রার্থী করার পক্ষে ছিল বিজেপির একাংশ। তাতেও লড়াই হাড্ডাহাড্ডি হতো, এমনটা বলা যায় না। কারণ লোকসভা ভোটে নৈহাটিতে তৃণমূলের পার্থ ভৌমিকের চেয়ে অর্জুনবাবু প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার ভোট কম পেয়েছেন। অর্জুনকে প্রার্থী না করলেও নৈহাটি কেন্দ্র নজর কেড়েছে। সৌজন্যে সিপিএম। ডুবন্ত সিপিএম বাঁচার জন্য যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই আঁকড়ে ধরছে। এবার সঙ্গী নকশাল। তবে, এই ‘আচমকা জোট’ সিপিএমেরই অনেকে মানতে পারছেন না। এখানে কংগ্রেস প্রার্থী প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ভোট পেলে বুঝতে হবে, সেলিম সাহেবদের বৃহত্তর বামঐক্য গড়ার ইচ্ছায় সায় নেই দলের নিচুতলার।
উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া কেন্দ্রের জয়-পরাজয় নিয়ে চর্চা অর্থহীন। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ‘দেবী দুর্গা’র প্রতীক রেখা পাত্র হাড়োয়া বিধানসভা কেন্দ্রে পেয়েছিলেন ৩৪ হাজার ২৩৫টি ভোট। তৃণমূলের নুরুল ইসলাম পেয়েছিলেন ১ লক্ষ ৪৫ হাজার ৩৫৬টি ভোট। ব্যবধান প্রায় ১ লক্ষ ১১ হাজার। আর সিপিএমের নিরাপদ সর্দ্দার? সিপিএমের দাবি মোতাবেক, যিনি না থাকলে ‘সন্দেশখালি কাণ্ড’ মানুষ নাকি জানতেই পারত না, সেই নিরাপদবাবু পেয়েছেন ৭৪৭০ ভোট। সিপিএম বুঝেছে, আর জি কর নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফোলানো মিথ্যের ফানুসে আলপিন ফোটানোর জন্য হাড়োয়া একাই যথেষ্ট। সেইজন্যই কি সিপিএম দলীয় প্রার্থী না দিয়ে আইএসএফকে ‘হাড়িকাঠে’ চড়িয়ে দিল?
জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিবাদকে ‘গণআন্দোলনে’র পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পিছনে সোশ্যাল মিডিয়ার অবদান অনস্বীকার্য। ব্যক্তিগত লালসার পরিণতিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ‘প্রাতিষ্ঠানিক সন্ত্রাসে’র মোড়কে মোড়ার মরিয়া চেষ্টা হয়েছিল। নানা বিকৃত ও ভুয়ো তথ্যে ভরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ফেসবুক পেজ। পরিকল্পিতভাবে ‘সূত্রের খবরে’র মোড়কে ছড়ানো হয়েছিল বিদ্বেষের বিষ। সেই বিষের ছোবলে ক্ষিপ্ত মানুষ শামিল হয়েছিল রাতদখল, ভোরদখল কর্মসূচিতে। একথা ঠিক, এমন আন্দোলন আগে দেখেনি বাংলা। তবে এমন পরিকল্পিত মিথ্যাচারও বাংলায় এই প্রথম। অনেকে মনে করেন, একমাত্র ১৪ আগস্টই হয়েছিল মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। পরে বাম ও অতিবামেদের সৌজন্যে তা শাসক বিরোধী শহুরে মধ্যবিত্তের আন্দোলনে পরিণত হয়। কর্পোরেটের উস্কানিতে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কালিমালিপ্ত করার সেই চক্রান্ত জারি আছে এখনও। সোশ্যাল মিডিয়ায় রক্তমাখা গ্লাভস ও অপারেশনের জংধরা ভাঙা কাঁচি সরকারি হাসপাতালের বলে চালানোর চেষ্টা, সেই প্রয়াসেরই অঙ্গ।
তাই এই উপ নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দলকে শুধু বিরোধীদের সঙ্গে নয়, লড়তে হবে সোশ্যাল মিডিয়ার নেট নাগরিকদের বিরুদ্ধেও। এবারের লড়াইটা আক্ষরিক অর্থেই নেট নাগরিকের ভেকধারীদের মিথ্যে প্রচার ও আস্ফালনের সঙ্গে মানুষের বাস্তব উপলব্ধির। সোশ্যাল মিডিয়ার বিপ্লবীরা বাংলায় তিল তিল করে গড়ে তোলা মানুষের বিশ্বাসের প্রাসাদে আদৌ আঁচড় কাটতে পারল কি না, এবারের ভোটে হবে তারই অগ্নিপরীক্ষা।