চিত্তকে প্রসাধিত করা, স্বচ্ছ করা, প্রসন্ন শব্দের এটিই প্রকৃত প্রাচীন অর্থ ছিল। “প্রসন্ন সলিলা গোদাবরী। চিত্তকে স্বচ্ছ কিভাবে করা যেতে পারে? ব্যবহারকে শুদ্ধ করলে। ব্যবহার হল নিজের প্রতিক্রিয়া। প্রত্যেক বস্তু সুখকর বা দুঃখকর, ভালো বা মন্দ—এইরূপে আমাদের নিকটে প্রতিভাত হয়। বাইরে থেকে যে আঘাত আসে—তাকে সুখকর বা দুঃখকর মানি, কিন্তু অন্তরের প্রতিক্রিরা কি তা আমরা দেখতে পাই না, নিজের প্রতিক্রিয়া মৈত্রী বা করুণা হওয়া উচিত। মিত্রের সুখদর্শনে যেপ্রকার চিত্ত প্রসন্নতা হয় সেইরকম প্রসন্ন হয়ে সেইরকম প্রসন্নতা চিত্তে আনা দরকার। চিত্ত মাৎসর্য্যহীন হওয়া উচিত। মাৎসর্য্য দূর করা সহজ নয়। মাৎসর্য্য দূর হলে চিত্তে প্রসন্নতা আসে। অন্যের সুখে সুখী হওয়াকে মৈত্রীভাব বলা হয়। এইপ্রকার অন্যের দুঃখ দেখে করুণা আসা উচিত। বৌদ্ধরা করুণাকে খুব উঁচু স্থান দিয়েছেন। বুদ্ধচিত্তের দুটি অবস্থা-চিত্ত যখন স্বরূপে অবস্থান করে তখন করুণার ভাব। এইজন্য বৌদ্ধরা নির্বাণের সাথে করুণাকেও উঁচু স্থান দিয়েছেন। যেখানে কোন ভালো কাজ হয়, কারও উন্নতি হয়, এমন দেখে সামান্যতমঃ ঈর্ষার উদ্রেক হয়। কিন্তু ঈর্ষান্বিত না হয়ে খুশি হওয়াকে মুদিতা হওয়া বলা হয়। নিজের জুগুপ্সা প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণ বিদূরিত করা উচিত। যে পাপ করে, তার প্রতি ধিক্কার ভাবনা না এনে উপেক্ষার ভাবনা আনা উচিত। অবশ্য অন্যায়ীর প্রতি উপেক্ষা কৃষ্ণমতের বিরুদ্ধ। যোগ হল ব্যক্তিগত মত। যেখানে ব্যক্তি নিজে involved রয়েছে, সেখানে উপেক্ষা করা যেতে পারে। যে ধর্ম ব্যক্তিগত তাকে সামাজিক রূপ প্রদানে বাধা এসে দাঁড়ায়, যেমন, গান্ধীজীর অহিংসা। অন্যায় সহন করা হল মুনির ধর্ম, কিন্তু অন্যায়ের বিরোধিতা করাও একটি ধর্ম। এটি হল গৃহস্থের, সমাজের ধর্ম। ভারতবর্ষে এই বিষয়ে একটি দ্বিধাবোধ আছে, কিন্তু তা ভ্রমজন্য। শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে বলছেন, “যুধ্যস্ববিগতজ্বরঃ’।—যুদ্ধ করো। কিন্তু সন্তাপহীন চিত্তের সাথে। কোন উদ্দেশ্য পূরণের জন্য, কেবল স্বার্থসিদ্ধির জন্য যুদ্ধ করতে বলা হয়নি। নিঃস্বার্থভাবে, লোককল্যাণের জন্য, অন্যায়ী, আততায়ীর বিরুদ্ধে লড়াই করা অধর্ম নয়। তটস্থভাবে যুদ্ধ করাও উপেক্ষারই অন্তর্গত। শ্রীকৃষ্ণ ও বুদ্ধ দুজনের ভাবনার মিশ্রণ করা দরকার। এই প্রকার মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষার আচরণে চিত্ত প্রসন্ন হয়। মৈত্রী আর মুদিতা এই দুইভাবে চিত্ত হল প্রীতিসহগত। এর অনুকূল ধ্যানচিত্ততা আনা প্রয়োজন। প্রীতির ভূমিতে উঠতেই চিত্তে প্রসন্নতা আসে। লোকব্যবহার প্রীতির অনুশীলন করলে এর ভাব প্রবল হয়। চিত্ত প্রসন্ন হলে সানন্দসমাপ্তি সহজে আয়ত্ত হয়। চিত্তে উপেক্ষার প্রাবল্যে চতুর্থ ধ্যানভূমিতে ওঠা যেতে পারে। যথার্থ চিত্তবৃত্তি নিরোধ উপেক্ষার অবলম্বনের হয়। যোগী যেমন যেমন উপরে ওঠেন, তেমন তেমন নীচের মনুষ্যগণের প্রতি করুণার প্রবাহ প্রবাহিত হয়। এইজন্য সম্পূর্ণ চিত্তনিরোধ করুণার অবস্থায় সম্ভব হয় না।
চিত্ত নিরোধ করবার আরেকটি উপায় বলছেন। প্রাণকে, শ্বাসকে বাইরে বার করে বা তাকে ধারণ করেও চিত্ত স্থির করা যেতে পারে। এখানে প্রাণায়ামের কথা বলা হয়েছে। অনেক মানুষ কেবল প্রাণায়ামকে একমাত্র যোগ বা যোগের একমাত্র পন্থা মানেন। কিন্তু এটি ঠিক নয়। প্রাণায়াম যোগের অনেক সাধনের একটি সাধন মানা যেতে পারে। পতঞ্জলি এখানে তিনপ্রকার প্রাণায়াম একসাথে করবার উপদেশ দিচ্ছেন। ‘প্রাণের প্রচ্ছর্দন’-এর অর্থ হল শ্বাসকে বাইরে বার করা; বিধারণার অর্থ হল শ্বাসকে ভিতরে টানা বা তাকে স্তম্ভন করা। প্রাণায়ামের মূল কথা হল, শ্বাসের প্রতি লক্ষ্য রাখা। শ্বাসকে ছেড়ে, কিছু সময়ের জন্য শ্বাসকে ধরে রাখা, বা শ্বাসকে গ্রহণ করে কিছু সময়ের জন্য ভিতরে রাখা দুটির মধ্যে ব্যক্তি নিজের সুবিধানুসারে কোন এক প্রকারের পন্থা গ্রহণ করতে পারে। কোন কোন সাধক একসাথে দুটি পন্থা গ্রহণ করতে পারেন।
শ্রীমৎ অনির্বাণ রচিত ‘অনির্বাণ আলোয় পাতঞ্জল যোগ-প্রসঙ্গ’ থেকে