বেশি বন্ধু-বান্ধব রাখা ঠিক হবে না। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য আসবে। বিবাহযোগ আছে। কর্ম পরিবেশ পরিবর্তন হতে ... বিশদ
আমিও শুনেছি আগেকার দিনে চিকিৎসকরা নাড়ি ধরে, গতি বুঝে রোগ বলে দিতেন! সেসব দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে আমি যে সময়ে বড় হয়েছি সেই সময়ে, চিকিৎসকের কাছে রোগীর কথা শোনা, রোগীকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা জরুরি বিষয় ছিল। কিন্তু একটা বিষয় বুঝতে হবে, আমার ছোটবেলার সময়েও, চিকিৎসাব্যবস্থা আজকের মতো উন্নত হয়নি। আর উন্নত ছিল না বলেই চিকিৎসা ক্ষেত্রে ‘অ্যাকুইটি অব অবজারভেশন’ খুব গুরত্বপূর্ণ ছিল। অর্থাৎ তীক্ষ্ণভাবে একজন মানুকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করা। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এই পর্যবেক্ষণ এবং অসুখ ধরার দক্ষতাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
এমনকী আমরা যখন ডাক্তারির পরীক্ষা দিয়েছিলাম তখন ‘স্পট ডায়াগনোসিস’ নামে আলাদা করে পরীক্ষা দিতাম। অর্থাৎ রোগীকে শুধু চোখে দেখে বলতে হবে কী অসুখ হয়েছে! আমাদের খুব সতর্ক হয়ে রোগীর কথা বলার ভঙ্গি, হাঁটাচলার ধরন, মুখের গঠন দেখতে হতো। একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। ধরা যাক একটা ঘরে চিকিৎসক বসে আছেন। রোগী ঢুকলেন সেই ঘরে। দেখা গেল রোগী ভারসাম্যহীনভাবে হাঁটছেন। তার হাত কাঁপছে। বোঝা গেল তাঁর পারকিনসনস হয়েছে। এমনকী এভাবে শুধু মুখ দেখে হাইপোথাইরয়েডিজম নির্ণয় করতে হয়েছে আমাদের! হাতের নড়াচড়া ভঙ্গি দেখে পক্ষাঘাতের সমস্যাও নির্ণয় করেছি।
অগ্রজ শিক্ষক চিকিৎসকের কাছেই শিখেছি, চিকিৎসা শাস্ত্রে পর্যবেক্ষণ অতি জরুরি একটা ব্যাপার। কারণ, প্রত্যেক মানুষ আলাদা। একই অসুখ পাঁচটি ভিন্ন মানুষের হলে, তাদের চিকিৎসা করা ও সারিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও ভিন্ন ভাবে ভাবতে হবে। তার জীবনযাত্রার ধরন সম্পর্কেও জানতে হবে। সেই বুঝে পরামর্শ দিতে হবে।
একটা কথা বুঝতে হবে, আমাদের দেশে ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ বাস করেন। সেই অনুযায়ী বদলে যায় খাদ্যাভাস ও রীতি রেওয়াজ। এমনকী আর্থসামাজিক পরিবেশের হেরফেরে বদল ঘটে জীবনচর্চার। ফলে রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানতে হবে ঠিক কোন কারণে তাঁর শারীরিক সমস্যা হচ্ছে! অনেকসময় জীবনপ্রণালীর, রোজকার কিছু খাদ্যাভ্যাস থেকেও শারীরিক সমস্যা তৈরি হয়। তাই রোগীকে ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসকের কর্তব্য, ওই রোগীকে তার জীবনযাত্রার সমস্যার দিকগুলি সম্পর্কেও অভিহিত করা। নইলে শুধু রিপোর্ট দেখে চিকিৎসা করলে আর চিকিৎসকের প্রয়োজন কী! কতকগুলি যন্ত্র থাকলেই কাজ মেটে। আর একটা কথা— চিকিৎসককে বুঝতে হবে যে কেউ কোনও বিষয়ে সংবেদনশীলতা প্রকাশ করছেন মানেই তাকে সেই বিষয়ে রোগ নির্ণয়ক পরীক্ষা করাতে দিতে হবে এমন নয়। অর্থাৎ কোনও রোগী এসে কিছু লক্ষণের কথা বললেন যা শুনে চিকিৎসক সুগার টেস্ট করাতে দিলেন। পাশাপাশি রোগী বললেন, মনে হচ্ছে নাকটা অবশ হয়ে যাচ্ছে! নাক দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ধীর গতিতে চলছে! আর তাই শুনে চিকিৎসক এমআরআই করাতেও দিয়ে দিলেন। এমন হলে চলবে কেন! পরে তো ওই রোগী বলবেন, চিকিৎসক বিনা কারণে গুচ্ছের টেস্ট দিলেন! এখানেই আসে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণের গুরত্ব। কাকে কোন পরীক্ষা করাতে দেওয়া দরকার আর কতটুকু কাউন্সেলিং-এ কাজ হবে, তা চিকিৎসককে স্থির করতে হবে। কথা বললে চিকিৎসকের প্রতি রোগী বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে বই কমে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি পরীক্ষার কোনও মূল্য নেই!
না তা কখনই নয়। ক্লিনিক্যাল অবজারভেশন এবং আধুনিক পরীক্ষা পাশাপাশি চলুক। তাতেই মানুষের কল্যাণ। কারণ চিকিৎসক রোগীর রোগ লক্ষণ শুনে অসুখ সম্পর্কে ধারণা করছেন। কিন্তু তাঁর ধারণা যে সঠিক তা যাচাই করার জন্যই দরকার ল্যাবরেটরির পরীক্ষা!
এই যে আমরা আগেকার দিনে নাড়ি টিপে রোগ নির্ণয় করার কথা বলছিলাম, হয়তো সত্যিই তখন পালস গুণে চিকিৎসক বলতেন রোগীর টাইফয়েড হয়েছে না ডেঙ্গু হয়েছে। সেই বুঝে ওষুধও দিতেন। কিন্তু সেইসব রোগীদের মধ্যে সবাই সুস্থ হয়ে গিয়েছেন এমন নিশ্চয় নয়। কারও কারও ক্ষেত্রে রোগনির্ণয়ে ভুল হওয়া আশ্চর্য নয়। কারণ সেই যুগে রোগনির্ণয়ক পরীক্ষার প্রযুক্তি ছিল অমিল। ফলে ভুল-ঠিক যাচাই করার কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু আজ আছে। আর আছে যখন, তখন প্রযুক্তির সাহায্য না নেওয়ার কোনও অর্থ হয় বলে মনে হয় না।
একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উদাহরণ দিই। এক রোগীকে পরীক্ষা করে কিছুতেই রোগ ধরা যাচ্ছে না। দু’সপ্তাহ-তিন সপ্তাহ ধরে জ্বর আছে। অনেক টেস্ট করেও রোগ ধরা যাচ্ছে না। শেষে বোন ম্যারো পরীক্ষা করে দেখা গেল টিউবারক্যুলোসিস এর জীবাণু রয়েছে! বিরল ধরনের টিবি! উন্নত রোগনির্ণয়ক পরীক্ষা ব্যবস্থা না থাকলে আমরা রোগীর এই অসুখ ধরতে পারতাম না! অতএব রোগনির্ণয়ক পরীক্ষার দরকার অবশ্যই রয়েছে।
এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা আরও আধুনিক হচ্ছে। ভবিষ্যতে জিন পরীক্ষা করেও বলে দেওয়া সম্ভব হবে সম্ভাব্য অসুখ সম্পর্কে! তাহলে কী আমরা সেসব জানব না? মুখ ফিরিয়ে থাকব প্রযুক্তির উন্নতি থেকে!
আসলে বর্তমান পরিস্থিতিও খুব ভালো নয়। চিকিৎসকেরও কিছু করার থাকছে না। কারণ ‘মেডিক্যাল এরর’ যে থাকতে পারে তা মানুষ মেনে নিতে পারছেন না। তাই রোগীর মৃত্যু হলেই সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের দিকে আঙুল উঠছে! তারপর মামলা-মকদ্দমা! সামাজিক সম্মানহানি! চিকিৎসকও তাই কোনও ত্রুটি রাখতে চাইছেন না। রোগী সামান্য সমস্যার কথা বললেও টেস্ট করাতে দিচ্ছেন। কেই বা বিনা কারণে সমস্যায় পড়তে চায়?
অতএব রোগীকেও বুঝতে হবে চিকিৎসক ঈশ্বর নন। তিনি তার জ্ঞানগম্যি দিয়ে সর্বতোভাবে রোগীকে সারিয়ে তুলতে চান। আর সেজন্য যতরকম চেষ্টা করা যায় তিনি করেন। এই বিশ্বাসটুকু রোগী চিকিৎসকের উপর রাখা দরকার। তাহলেই এই গুচ্ছের টেস্ট দেওয়ার অভিযোগগুলোও ধীরে ধীরে কমে আসবে। চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কও সুস্থির হবে।
অনুলিখন: সুপ্রিয় নায়েক