রাজনীতিক ও পেশাদারদের ব্যস্ততা বাড়বে। বয়স্করা শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিন। ধনযোগ আছে। ... বিশদ
আমাদের কমপ্লেক্সের মধ্যেই একটা ছোট খেলার মাঠ আছে। মাঠটা খুব সুন্দর। ঘাস একদম সমান করে ছাঁটা। সোসাইটি থেকেই মাঠটার দেখভাল করে। বাবা অবশ্য বলে, এই ঘাসগুলো নকল ঘাস। এই ঘাসে বাবা ওর ছেলেবেলার খেলার মাঠের ঘাসের গন্ধ পায় না। আমরা বিকেলবেলা এই মাঠটাতেই খেলতে যাই। আমরা বড়রা ঝুকুদের খেলায় নিই না। মাঠের এককোণে ওরা সবাই খেলে। কেজি ওয়ান আর টুয়ের বাচ্চারা। সেখানে দোলনা আছে। স্লিপ আছে। আমরা যারা সিক্স সেভেনে পড়ি তারা গোটা মাঠটা জুড়ে ফুটবল খেলি। মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে কারও কারও মায়েরা আমাদের খেলা দেখে। খেলা শেষে মায়েরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফ্ল্যাটে উঠে যায়। আমাদের মা-বাবা যেহেতু দু’জনেই চাকরি করে তাই আমিই ঝুকুকে নিয়ে ফিরি। পরশুদিন ফেরার সময় শুনলাম ঝুকু ওর বন্ধুদের বলছে, ‘জানিস, এই রবিবার আমরা গ্রামের বাড়ি যাব। আমাদের গ্রামের বাড়িতে অনেক ধানগাছ আছে। আমাদের ভালুমনাগুলো ধানগাছে চড়ে বসে থাকে। সকালবেলা ঠাম্মা ওদের ডাকে, আয় আয়, ব্রেকফাস্ট কর। তখন ওরা গাছ থেকে নেমে ব্রেড-অমলেট খেয়ে জঙ্গলের ভেতরে চলে যায়।’ ঝুকু ভল্লুককে বলে ভালুমনা। বাঘকে বলে বাঘমনা। হিংস্র পশুরাও ওর কাছে খুব আদরের। যখন ওর বন্ধুদের এই সমস্ত মিথ্যে কথা বলছিল, আমি তখন কিচ্ছু বলিনি। ওর বন্ধুদেরই একজন রাকা বরং ওকে বলেছিল, ‘ধুস ভল্লুক আবার মানুষের বাড়িতে থাকে নাকি?’ শুনে ও বলেছিল, ‘ঠিক আছে, তোকে একবার আমাদের গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাব, তখন দেখবি থাকে কি না।’
ঝুকু যে ইচ্ছে করে এই সমস্ত মিথ্যে কথা বলে তা কিন্তু নয়। একটা অদ্ভুত কল্পনার জগতে ও বাস করে। ও ঠিক আমার মতো নয়। বরং আমার উল্টো। অচেনা লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব লজ্জা লাগে। ও কিন্তু যেকোনও মানুষের সঙ্গেই মুহূর্তের মধ্যে ভাব জমিয়ে নেয়, কোলে উঠে পড়ে। আমি এইসব একদম পারি না। মা বলে, আমার কনফিডেন্সের অভাব। মা বাবাকেও বলেছে, এত শাই হলে চলে না। দরকার হলে রুকুর কাউন্সেলিং করাতে হবে। বাবা শুনে কিছু বলেনি, শুধু হেসেছে। আসলে মা আজ সাতদিন ধরে আমাকে বলছে, সোমজিৎ স্যরকে একবার বল কবিতাটা তোকে তুলিয়ে দিতে। আমি কিছুতেই স্যরকে বলে উঠতেই পারছি না। কবিতাটা মানে রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’। আর ক’দিন পরেই পঁচিশে বৈশাখ। আমাদের কমপ্লেক্সে রবীন্দ্রজয়ন্তী খুব ঘটা করে উদ্যাপন করা হয়। মা খুব চাইছে এবার আমি ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটা আবৃত্তি করি। আমাদের ক্লাসটিচার সোমজিৎ স্যর বাংলার শিক্ষক। খুব ভালো আবৃত্তি করেন। আমি বললে স্যর নিশ্চয়ই কবিতাটা আমাকে শিখিয়ে দেবেন। স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশনের জন্য স্যরই আমাদের আবৃত্তি শেখান। তখন তো নিজে থেকেই আমাদের ডেকে নিয়ে কবিতা তোলান। কিন্তু এইবার তো আর স্কুলের ফাংশন নয়। স্যরকে কি বলা ঠিক হবে যে, আমাদের কমপ্লেক্সের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে একটা কবিতা বলব, আমাকে শিখিয়ে দিন স্যর? এইসব ভাবতে ভাবতেই আমি স্যরকে আর বলে উঠতে পারিনি।
দুই
নাকতলা-হাওড়া মিনিবাসে চেপে এখন আমরা হাওড়া স্টেশনে যাচ্ছি। বাবা বলেছে, কলেজে পড়ার সময় যেভাবে বাবা গ্রামের বাড়ি যেত, আমরা এবার সেভাবেই গ্রামের বাড়ি যাব। ঝুকুকে বোঝাতে হবে যে, চাইলেই হুশ করে গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়া যায় না। সেজন্যই এতদিন যাওয়া হয়নি। আমরা তাই আজ নিজেদের গাড়ি করে যাচ্ছি না। বাসে চেপে হাওড়া স্টেশনে যাব। তারপর সেখান থেকে ট্রেনে চেপে দুর্গাপুর। দুর্গাপুর থেকে আবার বাসে করে বেলিয়াতোড়।
আমরা যখন বেলিয়াতোড়ে গিয়ে পৌঁছলাম, সূর্য তখন মাথার উপরে। ঠাম্মাকে কতদিন পরে আমি সামনাসামনি দেখলাম। দাদু মারা গিয়েছেন অনেকদিন। আমাদের গ্রামের বাড়ি ঠাম্মা একাই সামলায়। দু’জন কাজের লোক আছে। একজন পবন, আরেকজন লতা। আমরা পৌঁছতেই ঠাম্মা আমাদের জড়িয়ে ধরল। ঝুকুর সঙ্গে ভিডিও কলে ঠাম্মা কথা বলে মাঝে মাঝে। কিন্তু সামনাসামনি ঝুকুকে এই প্রথম দেখল ঠাম্মা। ওকে কোলে নিয়ে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘পবনের সঙ্গে তোমাকে বিকেলে পাঠাব পলসোনায়। ধানগাছ দেখতে পাবে ওখানে। বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে এখন।’ ঝুকু জিজ্ঞেস করল, ‘ধানগাছের ওপরেও কি ভালুমনাগুলো ঘুমোয় ঠাম্মি?’ ঠাম্মা বলল, ‘কখনও-কখনও ঘুমোয় তো। কিন্তু ওদের দেখতে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কপাল ভালো থাকলে তবেই দেখা যায় ধানগাছের ওপর ভালুমনা ঘুমাচ্ছে।’
এইসব কথা শুনে বাবা কিছুই বলছে না। শুধু মিটিমিটি হাসছে। আমি ভাবছি আজই ঝুকু বুঝতে পারবে ধানগাছ আর আমগাছের তফাত।
আমরা একটু ফ্রেশ হতেই লতা পিসি নিয়ে এল আম পোড়ার শরবত। আমাদের গ্রামের বাড়ির লাগোয়া বিশাল বাগান আছে। সেখানে নানা ফলের গাছ আছে। আম, কাঁঠাল, লিচু, বাতাবি নানা রকমের ফল। যে আম পুড়িয়ে শরবত বানিয়েছে লতা পিসি, তা আমাদের গাছের। এখনও আম সব পাকেনি। কাঁচা কাঁচা আম। গাছে আম ঝুলতে দেখে ঝুকুর সে কী লাফালাফি! ফলওয়ালার ঠেলাগাড়িতে ও চিরকাল আম দেখেছে। এই প্রথম দেখল গাছের থেকে ঝুলছে আম।
বিকেলবেলা পবন কাকুর সঙ্গে ঝুকু গেল পলসোনায়। আমি গেলাম না। বেলিয়াতোড়ে আমার অনেক বন্ধু আছে। তাদের সঙ্গে বিকেলবেলা আমাদের বাড়ি লাগোয়া বিরাট মাঠে ফুটবল খেলব বলে রয়ে গেলাম। চন্দন, বুধন, সন্তু, দাশু সবার সঙ্গে দেখা হল কতদিন পরে। যখনই দেখা হয়, ওরা আমার কাছে কলকাতার গল্প শুনতে চায়। আমাদের স্কুলের গল্প শুনতে চায়। আমি যতটা পারি বলি। আজ খেলা শেষের মুখে আমরা দেখলাম, ঘন কালো মেঘ করে এসেছে। মানে কালবৈশাখী আসছে। দুদ্দাড় করে যে যার বাড়িতে ফিরে এলাম।
বাড়ি এসে দেখছি, ঝুকু ফিরে এসেছে পবন কাকুর সঙ্গে ধানগাছ দেখে। ধানগাছ যে আমগাছের মতো নয়, তা জানতে পেরে একটু মনমরা ও। কেন না ভালুমনাগুলোকে এই গাছে ও চড়াতে পারছে না। ঠাম্মাকে বলল, ‘তুমি যে বলেছিলে ধান গাছের ওপর ভালুমনা শুয়ে থাকে। কিন্তু ভালুমনার তো অনেক বড় শরীর। সে ওইটুকু নরম ছোট্ট গাছে চাপবে কী করে?’ ঠাম্মা বলল, ‘চাপে ঠিকই রাতের বেলা। কিন্তু সবাই দেখতে পায় না। পরের বার এলে তোমাকে পবনের সঙ্গে ভোরবেলা পাঠাব ধানগাছ দেখতে। তখন ভালুমনাদের দেখতে পাবে। সেজন্য তোমাকে তো আসতে হবে আমার কাছে। কলকাতা শহরে তো এসব দেখা যায় না সোনা।’
বাবা মন দিয়ে ঝুকু আর ঠাম্মার কথাবার্তা শুনছিল। বলল, ‘মা, আসলে বিশাল চাপ। আর তোমার সঙ্গে তো ভিডিও কলে ওদের কথাবার্তা হতেই থাকে। তবে এবার থেকে বছরে অন্তত একবার সবাইকে নিয়ে আসার চেষ্টা করব।’
সন্ধে একটু গাঢ় হতেই ঝড় এল। ভয়ঙ্কর ঝড়। কী শোঁ শোঁ শব্দ!
পরের দিন ভোরবেলা বাগানে গিয়ে আমরা তো অবাক। গোটা বাগান ছেয়ে গিয়েছে আমে। ওপরে তাকিয়ে দেখলাম আমগাছগুলোতে আর একটা আমকেও ঝুলতে দেখা যাচ্ছে না। ঝড় সবাইকে ফেলে দিয়েছে মাটিতে। হাতের নাগালে এত এত আম দেখে ঝুকুর তো আনন্দ আর ধরে না! আমারও খুব আনন্দ হচ্ছিল। বাবা-মাকে দেখেও মনে হল ওরা যেন আমাদেরই মতো ছোট হয়ে গেছে। তিনটে ঝুড়ি নিয়ে এসে আমরা আম কুড়োতে লাগলাম একসঙ্গে। ঠাম্মা বলল, ‘যাহ, সব আম ঝরে গেল! এ অবশ্য প্রকৃতির দান। না চাইতেই প্রকৃতি অনেক কিছু দিয়ে দেয় আমাদের।’
আম কুড়োতে কুড়োতে ঝুকু হঠাৎ চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল। ওর চোখ পড়েছে বাতাবি লেবু গাছটার দিকে। গাছটায় ঝুলছে একটাই গোল বাতাবি। অসময়ের বাতাবি। এসময় বাতাবি লেবু তো হওয়ার কথা নয়। এই লেবু তো খাই দুর্গাপুজোর সময়টায়। ভয়ঙ্কর ঝড়ও কিন্তু বাতাবি লেবুটাকে মাটিতে ফেলে দিতে পারেনি।
বাতাবি লেবুটার দিকে তাকিয়ে ঝুকু হঠাৎ ঠাম্মাকে বলল, ‘ও কেন মাটিতে পড়েনি? ওকে মাটিতে ফেলে দাও।’
বাবা বলল, ‘না চাইতেই তো ঝড় তোমাদের এত এত আম দিয়েছে। আবার বাতাবি লেবুটাকে চাইছ কেন?’
ঝুকু বলল, ‘সব আম পড়ে গেছে। ও গাছে ঝুলে থাকবে কেন? ওকে ফেলে দাও। ওকে আমার চাই।’
ঝুকুর কথা শুনে ঠাম্মা কোথা থেকে একটা বিরাট বড় বাঁশ নিয়ে এসে বাতাবি লেবুটা যেখান থেকে ঝুলে আছে, গাছের সেই অংশটায় একটা খোঁচা দিল। ধপ করে লেবুটা পড়ল মাটিতে। ঝুকুর সে কী আনন্দ!
বাবা বলল, ‘লেবুটাকে পাড়লে কেন মা?’
ঠাম্মা বলল, ‘বা রে! নাতি চাইছে, দেব না? আর ও তো ঠিকই বলেছে, ঝড় সব আম ফেলে দিয়েছে মাটিতে। তাহলে বাতাবিটাই বা থাকবে কেন? এক যাত্রায় পৃথক ফল তো ভালো নয়।’
মা বলল, ‘আর সবসময় প্রকৃতি সব কিছু আমাদের না চাইতেই দিয়ে দেয় না। কিছু কিছু জিনিস একটু চেয়ে নিতে হয়।’
শুনে আমার মনে হল, ঠিকই তো। অনেক কিছু তো চাইতে হয়। তাতে তো লজ্জা নেই। ফিরে গিয়েই আমি সোমজিৎ স্যরকে বলব ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটা আমাকে শিখিয়ে দিন স্যর।
তিন
সোমজিৎ স্যর আমাকে বলছেন, ‘সন্ধে হল, সূ্য্যি নামে পাটে — এইখানে গলাটাকে একটু খাদে নামাতে হবে।’
আজ দ্বিতীয় দিন। ফার্স্ট ব্রেকে উনি আমাকে কবিতাটা তোলাচ্ছেন গতকাল থেকে।
সোমজিৎ স্যর বললেন, ‘আর হারে রে রে রে — এটা অত জোরে বোলো না। চিৎকারের মতো শোনাচ্ছে।’
আমি বললাম, ‘আর ভুল হবে না স্যর।’