নাটক: বীরপুরুষ
প্রযোজনা: হাওড়া শিল্পী সংঘ
পরিচালনা: কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

সম্প্রতি গিরিশ মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটি নাট্যাঙ্গিকে মঞ্চস্থ করল হাওড়া শিল্পী সংঘ। নাটকে অবশ্য শিশুর বীরত্বর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজরের এক মর্মস্পর্শী কাহিনী মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়। বিষয়টি অন্যরকম এবং হৃদয়বিদারক সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
সেনা অফিসার মেজর অভিষেক রায় হঠাৎ একটা ছুটি পেয়ে একমাত্র পুত্র তাতাইয়ের জন্মদিনে বাড়ি চলে আসে। তাঁর হঠাৎ উপস্থিতি সকলকে অবাক করে দেয়। আশাতীতভাবে বাবাকে কাছে পেয়ে তাতাই ও তার মা খুশি। তাদের দু’জনের আনন্দের বাঁধ ভেঙে পড়ে। নানা প্রসঙ্গে কথোপকথনের পর রাতের খাওয়া শেষ করে অভিষেক ছেলেকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। ছেলে বায়না ধরে গল্প শোনার। অভিষেক বলে যুদ্ধ, জঙ্গল, সেনাবাহিনীর সব গল্পই তুমি শুনেছ। আজ আমি তোমাকে এক বীরপুরুষের কাহিনী শোনাব। এরপরেই শুরু হয় সেই বালক খোকার কথা। মঞ্চে দেখা যায় ঘোড়ায় চেপে একটি বাচ্চা ছেলে টগবগ করে ছুটে চলেছে। তার পাশে পালকিতে চলেছে মা। হঠাৎ আক্রমণ কয়েকজন ডাকাত। তাদের মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কানে গোঁজা লাল জবা ফুল। তরোয়াল দিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে সবাইকে ঘায়েল করে খোকা মাকে উদ্ধার করে। গল্প শুনতে শুনতেই খোকা ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ সেনাবাহিনী থেকে ফোন আসে আর মেজরের ডাক পড়ে। সব আনন্দ উপেক্ষা করে ছেলে-স্ত্রীকে ছেড়ে তখনই ফিরে যেতে হয় অভিষেককে। স্ত্রীর অনুরোধে পারিবারিক জীবনকে বেছে নেওয়া তো দূর অস্ত নিজের ইচ্ছামতো ছুটি কাটানোর সুযোগটাও সেনার কাছে নীতিবিরুদ্ধ কাজ। এ কথা জানিয়ে মাতৃভূমি রক্ষা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ এক সেনা দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ দেশ সেবার কাজে ছুটে যায়। প্রবল পরাক্রমে সীমান্তবর্তী এলাকায় যুদ্ধ করে প্রাণ যায় মেজরের। ঘরে ফিরে আসে তাঁর মরদেহ। কান্নায় ভেঙে পড়ে স্ত্রী-পুত্র।
বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, তাৎপর্যপূর্ণ ও অর্থবহ। নাটকে খোকা যেমন তাতাই তেমনই খোকা তাতাইয়ের বাবাও। তাতাইয়ের মা যেমন পৌলমী, তেমনই অভিষেকের মা তাঁর মাতৃভূমি। দুটো বিষয়কে একসঙ্গে মেশানোটা অভিনব। শিশু কিশোর শিল্পীদের দ্বারা অভিনীত নাটকটি দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাওয়া, মঞ্চের ওপর পর্দায় নীল আকাশে চাঁদের আনাগোনা এক অপূর্ব দৃশ্য সৃষ্টি করে। প্রত্যেকের অভিনয়ে দক্ষতার ছাপ নজরে পড়ে। শিশু তাতাইয়ের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে শতাদিত্য পাল। বিষয়টিকে মনোগ্রাহী করে তুলতে সাহায্য করে রবীন্দ্রনাথের গানের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার। দেশের জন্য সেনাবাহিনীকে কতখানি তৎপর ও সজাগ থাকতে হয় সাধারণ নাগরিকের তেমন কোনও ধারণাই থাকে না। যখন যুদ্ধ বাধে তখন এইসব সেনারা কীভাবে আত্মত্যাগ করে চিরবিদায় নেয় সেটাও লক্ষণীয়। নাটকে খুব সামান্য হলেও বিষয়টিকে খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাতাইয়ের স্বপ্নে আসা বাবার কথা যে তুমি তোমার মাকে রক্ষা করো আমি আমার মা অর্থাৎ দেশমাতার জন্য ফিরে যাই। অন্তিম দৃশ্যে ছোট্ট শিশুটি যখন ভারতীয় পতাকা হাতে শপথ করে বাবা আমিও যাব দেশের কাজে, কর্নেল হব, রক্ষা করব মাতৃভূমিকে তখন চোখে জল এসে যায়। নাটকটি বেশ ভালো। দুটোই বীরত্বের কাহিনী। এর মধ্যে সূক্ষ্ম হলেও একটু তফাত রয়েছে। একটা আত্মবলিদান অন্যটা বিজয়ী হওয়া। রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় অনুপ্রাণিত কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় পেশাদারিত্বের ছাপ স্পষ্ট হলেও উপস্থাপনায় গভীরতার দিকটা আরও একটু নজর দিলে সর্বাঙ্গীন সুন্দর হতে পারত নাটকটি। অভিনয়ে শতাদিত্য পাল (তাতাই), দেবজ্যোতি গাঙ্গুলি (অভিষেক), প্রজাক্তা পাল (পৌলমী) এককথায় অনবদ্য। দেবসোম রায়, বীপ্রজিৎ মণ্ডল, শুভম কর ও অন্যান্যরা যথাযথ।
বিষয় ভাবনার অভিনবত্বের জন্য স্বপ্নজয় ও রাজর্ষিকে প্রশংসা করতেই হয়। মঞ্চসজ্জায় মদন হালদার, আলোর প্রয়োগে সাধন পাড়ুই ও দীপঙ্কর দে, আবহে সব্যসাচী পাল মানানসই। মুখোশে সুদীপ গুপ্ত ছোটদের মনোরঞ্জন করে।
কলি ঘোষ