গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
মাথার উপর দিয়ে ধোঁয়ার মতো উড়ে যাচ্ছে সাদা চিতাভস্ম। তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে লাল, সবুজ ও গোলাপি আবির। মুঠো মুঠো ছাই নিয়ে ওড়াচ্ছে সকলে। মাখছে মুখে-চোখে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে রয়েছেন সাধুরাও। চিতা থেকে ছাই তুলে মাথায় ছোঁয়াচ্ছে কেউ কেউ, সারা অঙ্গে মাখছে। সেই সঙ্গে একে অপরকে মাখিয়ে দিচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় প্রবল ভিড়। ওদিকে কিনারাম আশ্রম থেকে অঘোরী সাধুরা আসছেন। বিশাল শোভাযাত্রা রাস্তায়। সামনে বিশাল ষাঁড়ের ট্যাবলো। তার ওপরে বসে আছেন শিব-পার্বতী। গায়ে মাখা ছাইভস্ম। গলায় করোটির মালা। হাতে বিশাল ত্রিশূল। নানা ধরনের বাজনা বাজছে, চলছে নাচ, উড়ছে আবির।
আজ সব রাস্তার একটাই গন্তব্য, মণিকর্ণিকা ঘাট। ঘাটের একদিকে একটা চিতা জ্বলছে। অন্যদিকে সদ্য নিভে যাওয়া চিতার ছাই মুঠো মুঠো তুলে ওড়াচ্ছেন সাধুরা। তাঁদের ঘিরে ভক্তের দল।
ভিড়ের থেকে একটু আড়ালে সরে গিয়ে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে প্রিয়ব্রত আর অনুরাধা। যেন এক অপার্থিব, অলৌকিক কোনও দৃশ্য তারা প্রত্যক্ষ করছে। প্রিয়ব্রত বলল, ‘অন্য সব দোলের থেকে বেনারসের দোলের একটা পৃথক বৈশিষ্ট্য আছে। অন্য জায়গায় দোলের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন রাধাকৃষ্ণ। আর বেনারসের দোল খেলা হয় মহাদেবকে ঘিরে।’
অনুরাধা অবাক হয়ে দেখে। এমন দোল খেলা সে কখনও দেখেনি। আসার আগে প্রিয়ব্রত যখন তাকে বলেছিল, ‘চলো, এবার দোলটা বেনারসে কাটিয়ে আসি।’ তখন অনুরাধা কিন্তু-কিন্তু করেছিল। সে বলেছিল, ‘শুধু তো দোল উৎসব নয়, এবার আমাদের বিয়ের রজতজয়ন্তী। অন্য কোথাও চলো। শান্তিনিকেতন কিংবা পুরুলিয়া।’
প্রিয়ব্রত বলেছিল, ‘চলো না এমন হোলিখেলা তোমাকে দেখাব, যা তুমি কোনওদিন দেখনি। ভাবতেও পারবে না।’ এখানে এসে তার মনটা একেবারে ভরে গেল। তবু মনটা একটু খারাপ। ছেলেটার পরীক্ষা বলে আসতে পারেনি। বেঙ্গালুরুতে পড়ে, লাস্ট সেমিস্টার চলছে।
আনমনা অনুরাধাকে ঠেলা দিয়ে প্রিয়ব্রত বলল, ‘বুঝলে তো শুধু লাল পলাশের উল্লাস আর শান্তিনিকেতনের আবহেই দোলের আনন্দ সীমাবদ্ধ থাকে না। ভারতের এক এক প্রদেশে দোলের বৈচিত্র্য এক একরকম। তবে আমাদের শুধুই দোল। অন্যদের হোলিখেলা।’
প্রিয়ব্রত দেখল, মানুষের আনন্দের বাঁধ যেন ভেঙে গিয়েছে। সমবেত উল্লাস। কেউ চিৎকার করে গান গাইছে, ‘আও খেলো মশান হোলি।’ কেউ গাঁজা টানছে, চলছে ভাং খাওয়া। উপস্থিত সাধুদের গলায় করোটির মালা। হাতে ত্রিশূল। বাজছে ডম্বরু, শিঙা, নাকাড়া। এর মধ্যে শিব আর পার্বতীর সাজেও আছেন কেউ কেউ। শ্মশানের মধ্যে দাঁড়িয়ে শিব ও পার্বতীর মালা বদল হচ্ছে।
সেদিকে দেখিয়ে প্রিয়ব্রত বলল, ‘এই মণিকর্ণিকা বা হরিশচন্দ্র ঘাটে যাঁরা এসে হোলি খেলছেন, তাঁরা সবাই নিজেদের মনে করেন, শিবের চ্যালা বা অনুচর। এই যে ছাই মেখে হোলি খেলা হচ্ছে, একে বলে মশান হোলি বা ভস্ম হোলি। এ নিয়ে পুরাণে দু’রকমের গল্প চালু আছে। একটি হল শিব একবার যমরাজকে পরাজিত করেন। তারপর সেই আনন্দে তাঁর দলবল নিয়ে এসে এখানে চিতার ছাই মেখে হোলি খেলেন। আর একটি কাহিনি থেকে জানা যায়, শিব-পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল শিবরাত্রির দিন। বিয়ের পর রঙ্গভরী একাদশীর দিন শিব পার্বতীকে নিয়ে প্রথম কাশীতে আসেন। দোল পূর্ণিমার আগের একাদশীকেই রঙ্গভরী একাদশী বা আমলকী একাদশী বলে। সেদিন পার্বতীকে কাশীতে আবির, গুলাল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। দেবতারা আবির উড়িয়ে পার্বতীকে কাশীতে স্বাগত জানিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে শিবের সঙ্গীদের প্রবেশ নিষেধ ছিল। তাই শিব তার পরদিন ভূত, যক্ষ, গন্ধর্ব সহ তাঁর অনুচরদের সঙ্গে হোলি খেলায় মাতেন। সেদিন তিনি মণিকর্ণিকা ঘাটে চিতার ছাই দিয়ে হোলি খেলেছিলেন। রঙ্গভরী একাদশীর দিন শুরু হয় কাশীর হোলিখেলা। সেটা ছ’দিন ধরে চলে। মশান হোলি খেলার জন্য আগে থেকেই বস্তা বস্তা ছাই সংগ্রহ করে রাখা হয়।’
অনুরাধা বলল, ‘এমন উদ্দাম খেলা দেখে সত্যিই প্রথম দিকে একটু ভয় ভয় লাগছিল। কঙ্কালের মুণ্ডমালা পরে, ভূত-প্রেত সেজে চিতার ছাই মাখার মধ্যে কেমন একটা বীভৎস রস আছে। রাধাকৃষ্ণের হোলি খেলার মতো মাধুর্য এখানে নেই।’
প্রিয়ব্রত বলল, ‘ঠিক বলেছ। আসলে রাধাকৃষ্ণের হোলিখেলার মধ্যে আছে প্রেমের সম্পর্ক। আর এখানে হোলি খেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রলয় তথা মৃত্যুর সম্পর্ক। তবে এখানে মৃত্যুবোধের মধ্যে কোনও শোক-তাপ জড়িয়ে নেই। কেন জানো?’
অনুরাধা বলল, ‘কেন?’
প্রিয়ব্রত বলল, ‘কাশীতে মৃত্যু কোনও শোক নয়। তা এক আনন্দের অনুভূতি। মানুষের বিশ্বাস, কাশীতে মৃত্যু হলে স্বর্গবাস হয়। কবিগুরুও মৃত্যুকে অমৃতসমান মনে করেছিলেন।’
অনুরাধা বলল, ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান কিংবা মৃত্যু অমৃত কর দান।’
প্রিয়ব্রত বলল, ‘এখানকার মানুষ মনে করে মরণ রে তুঁহু মম শিবসমান। এই যে ছাই দিয়ে হোলিখেলা। ওরা মনে করে ওই ছাইয়ের স্পর্শের মধ্যেই যেন মিশে আছে অমৃতের গান। পুণ্যলোভাতুর মানুষ তাকেই স্পর্শ করে খোঁজে মুক্তির আনন্দ, জীবনের জয়োল্লাস কিংবা শেষ পারানির কড়ি। একদিন আমরা সবাই চলে যাব। এই রং একদিন শূন্যতায় মিশে যাবে। সেটাই ওই সাদা ছাইয়ের প্রতীকে প্রকাশ পায়।’
অনুরাধা বলল, ‘অমন করে বোলো না। তোমাকে ছেড়ে থাকার কথা কোনওদিন ভাবতেই পারি না।’
অনুরাধার চোখে জল। তার মাথায় চুলের ওপর গুঁড়ো গুঁড়ো ছাই। চোখ মুছিয়ে দেয় প্রিয়ব্রত। বলে, ‘তোমার সঙ্গে এই যে পঁচিশটা বছর কাটিয়ে এলাম, তার সবটাই তো রঙের উৎসবের মতো।’
কথা বলতে বলতে প্রিয়ব্রত পাঞ্জাবির পকেট থেকে আবির বের করে অনুরাধার গালে, কপালে মাখিয়ে দেয়। অনুরাধাও মাখিয়ে দেয় প্রিয়ব্রতর মুখে।
অনুরাধা বলল, ‘ভাগ্যিস তোমার কথা শুনে এসেছিলাম, নাহলে এমন হোলিখেলা তো দেখা হতো না।’ হাত ধরে ওরা এগিয়ে যায় গঙ্গার দিকে। দু’হাতে আঁজলা ভরে জল নিয়ে মুখে ছিটিয়ে নিল, মাথায় দিল।
হাত ধরে দাঁড়াল দু’জনে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। অনুরাধা বলল, ‘তোমার সঙ্গে থাকতে চাই আরও অনেকদিন। বাবা বিশ্বনাথ যেন আমাকে সেই সুযোগ দেন।’
প্রিয়ব্রত হেসে বলল, ‘আমিও তাই চাই। চলো এবার হোটেলে ফিরে যাই। আজ রাতে হোটেলের বারান্দায় বসে গঙ্গার অনন্ত স্রোতের দিকে তাকিয়ে গান শুনব। অনেকদিন তোমার গান শুনিনি। তুমি গাইবে, আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। সেটাই হবে আমাদের হোলিখেলা ও বিয়ের রজতজয়ন্তী পালন।’