গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
‘না পারে না’, জড়তাহীন গলায় জবাব প্রবীণ অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্তীর। বললেন, ‘ইদানীং অনেক রকম দিবস পালন করার হিড়িক উঠেছে। মা দিবস, বাবা দিবস, ভালোবাসা দিবস—একমাত্র ওই দিনটিই পালন করা হয়, তারপর সবাই ভুলে যায়। দিবস মেনে কি নারীদের সত্যি শ্রদ্ধা-সম্মান করা হয়? আদৌ কি কোনও স্বার্থকতা আছে?’ বরং তাঁর সওয়াল স্বনির্ভরতার পক্ষেই। বলেন, ‘নারীরা নিজেদের চেষ্টায় এখন অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল হয়েছে। বহুক্ষেত্রে পুরুষের সাহায্য ছাড়াই নিজেদের সামলে নিতে পারে। এই লড়াই প্রতি মুহূর্তের। তাই আমার কাছে প্রতিটি দিনই নারী দিবস।’
‘যদি নারী দিবসে শুধুমাত্র মেয়েদের নিয়ে কথা বলি, তাহলে নিজেদেরই ছোট করব। আমাদের মনটা তুলনায় বড়। আসলে শিক্ষা আর আর্থিক স্থিতিশীলতার অভাবেই বিপরীত লিঙ্গের মানুষ মহিলাদের অমর্যাদা করতে পারে,’ মত অভিনেত্রী ঈশা সাহার। তাঁর বক্তব্য, ‘স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও সমাজের সর্বস্তরে শিক্ষার হার আশানুরূপ নয়। শিক্ষার অভাব থেকেই অর্থনৈতিক বৈষম্যের সূত্রপাত। অন্যদিকে পড়াশোনা করতে গেলে অর্থ চাই। আমি শহরে থাকি। শহরের মেয়েরা নিজেদের সামলে নিতে পারে। যাঁদের সবচেয়ে বেশি দরকার, সেই প্রান্তিক মানুষদের কাছে শিক্ষার সুযোগ আরও বেশি করে পৌঁছনো উচিত। তাহলে নারী-পুরুষ উভয়ের আত্মমর্যাদা বাড়বে। বৈষম্যটা অনেক কমে যাবে।’ ঈশা বললেন, ‘নারী দিবসের ইতিহাসের মধ্যে যেতে চাই না। যে সময়ে যে দাবি নিয়ে নারী দিবসের সূচনা হয়েছিল, তার থেকে মেয়েরা এখন অনেক বেশি স্বাধীন, নিজের লড়াইটা নিজেরা করতে পারে। সর্বস্তরে আর্থিক স্বনির্ভরতা তৈরি হলেই আর আলাদা করে নারী দিবসের কোনও প্রাসঙ্গিকতা থাকবে না।’
আর্থিক সচ্ছলতাই মুক্তির পথ বলে মনে করেন বাচিকশিল্পী ঊর্মিমালা বসু। তাঁর উপলব্ধি, ‘সামগ্রিক পরিস্থিতি খুব একটা এগয়নি। যদি তৃণমূল স্তরের কথা বলি, সেখানে আশান্বিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। যে ভারতের আমি প্রতিনিধি সেটাই তো আমার দেশ নয়, এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে এখনও মেয়েদের লেখাপড়া করতে দেওয়া হয় না। যে হার্ডলসগুলো থেকে বেরবার জন্য নারী দিবস, সেই মর্যাদা মেয়েরা পান না। শিক্ষিত মানুষরাও দেন না।’ রোজকার জীবনেও এমন অনেক টুকরো অভ্যাসের দিকে আঙুল তুললেন ঊর্মিমালা, যা সত্যিই ভাববার বিষয়। বললেন, ‘মা খবরের কাগজটা পড়ছেন, সন্তান যেকোনও সময় সেটা টেনে নিয়ে পড়তে পারে। স্ত্রীকে স্বামী যখন তখন, যেখানে সেখানে বলতে পারেন, এই তুমি চুপ করতো তো, কিছু বুঝবে না।
আসলে ভেতর থেকে বহু বছরের পুরুষতন্ত্রের বদভ্যাসে অজান্তেই মেয়েদের এভাবে ছোট করে দেওয়া হয়।’ এখনকার মেয়েদের ঊর্মিমালার পরামর্শ, ‘স্বাবলম্বী হতে হবে। শুধু লেখাপড়া শিখলেই হল না, মেয়েদের প্রতীজ্ঞা করতে হবে চাকরি করেই বিয়ে করব। যে যাই বলুক, অর্থই হচ্ছে সবচেয়ে বড় অবলম্বন।’
এই সময়ের আর এক জনপ্রিয় বাচিকশিল্পী ছন্দা রায় অবশ্য দিনটি পালনের পক্ষে। বললেন, ‘তাও তো বিশেষ একদিন উপলক্ষে নারীদের উপর ঘটে চলা অত্যাচার, অনাচার নিয়ে সমাজের কিছু স্তরে আলোচনা হয়। মহিলাদের সম্মান ও সুরক্ষার রূপরেখা তৈরির চেষ্টা হয়। এটুকুও অনেক।’ বলে তাঁর সংযোজন, ‘বর্তমান সময় নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নারীরা এগিয়ে চলেছে, তেমনই এই এগনোকে উচ্ছৃঙ্খলতার দিকে ধাবিত করাও ঠিক নয়। একদিকে যেমন আমরা নারী শোষণ নিয়ে সোচ্চার হচ্ছি, তেমনই একটা স্তরে নারী স্বাধীনতার নামে যথেচ্ছাচারটাও শোভন নয়। সেটা আবার সামাজিক শোষণের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। সেই পরিস্থিতির জন্য আঙুল উঠছে এক শ্রেণির নারীর দিকেই। সামাজিক শিষ্টাচার দুই তরফেই বজায় থাকা উচিত।’
নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার উপর জোর দিলেন সঙ্গীত শিল্পী শ্রাবণী সেনও। বললেন, ‘মানছি মেয়েরা আজ অনেক স্বনির্ভর। তবুও সিংহভাগ পিছিয়ে। তাই এতকিছুর পরও বলব, নারীদের আর্থিক নিরাপত্তা নিজেদেরকেই তৈরি করতে হবে। নিজেকেই সবকিছু অর্জন করতে হবে। মেয়ে বলে কেউ একচুল জায়গা ছাড়েও না, দেয়ও না। সুতরাং যতটুকু করতে হবে নিজেকেই করতে হবে।’
‘আমরা যদি ফেমিনিজম বা ইকোয়ালিটির কথা বলে থাকি তাহলে একইসঙ্গে পুরুষ দিবসও পালন করা উচিত’ বলে মনে করেন সঙ্গীত শিল্পী সোমলতা আচার্য চৌধুরি। বললেন, ‘নারী দিবস আসলেই আমরা মেয়েদের অমর্যাদা, অবিচার নিয়ে সরব হই। পুরুষরাও কিন্তু ভায়োলেন্সের শিকার হন, অনেকক্ষেত্রে আমরা খবরই পাই না। মেয়েদের দুর্দশার প্রতিকারে যেমন মেয়েদেরই বেশি করে এগিয়ে আসা উচিত, তেমনই পুরুষরা অত্যাচারিত হলে সমাজেরই কর্তব্য প্রতিবিধান করার।’ তাঁর মতে, ‘একটা ছেলে বা মেয়েকে সংবেদনশীল করে গড়ে তোলার দায়িত্ব প্রথমে বাবা-মায়ের। ছোটবেলা থেকেই ছোট ছোট করে সন্তানের মানসিক ও ব্যক্তিত্ব গঠন করাটা জরুরি। তবেই ভবিষ্যতে নারী পুরুষ একে অপরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করবে।’
ছোটপর্দার জনপ্রিয় মুখ অন্বেষা হাজরার কাছেও ‘রোজই নারী দিবস। আলাদা কোনও দিন নয়।’ বরং অন্বেষা নারী দিবসে এই ভাবেই প্রতিটি নারীকে প্রতিনিয়ত দেখতে চান। শারীরিক শক্তিতে মেয়েরা ছেলেদের থেকে পিছিয়ে মেনে নিয়ে সন্ধ্যাতারা’র ‘সন্ধ্যা’ বললেন, ‘যখন অধিকারের প্রশ্ন আসে তখন সেটা ইকোয়াল হওয়াই উচিত। এটা ওই একদিনের নারী দিবস দিয়ে যাবে না।’ নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক বলেই মনে করেন অন্বেষা। ‘মেয়ে বলে আমাকে আলাদা করে মর্যাদা পেতে হবে কেন? সম্মান, মর্যাদা পাওয়ার জন্য একজন পুরুষের যেমন জন্ম হয়েছে, তেমনই আমিও জন্মেছি। কোনও অন্যায় না করলে, ভালো মানুষ হতে পারলে, আমি নিশ্চয়ই সম্মান মর্যাদা পাব। তাই আমার কাছে প্রতিটা দিবসই নারী দিবস।’ অন্বেষার অকপট জবাব।