গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
পক্ষে
দেবাজীব সরকার,বেসরকারি চাকুরে
বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দেখভালের ক্ষেত্রে এই প্রজন্মের উদাসীনতার প্রধান কারণ এই যুগের আর্থসামাজিক অবস্থা। আজকের প্রজন্ম প্রতিযোগিতার ইঁদুরদৌড়ে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যস্ত। তাদের জীবনে অবসর কম, উপার্জনই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এখনকার প্রজন্ম ভালো চাকরি, ভালো উপার্জনের লক্ষ্যে নিজের পরিবারকে ছেড়ে বাইরে থাকতে কুণ্ঠাবোধ করে না। প্রয়োজনে অর্থের বিনিময়ে বৃদ্ধ বাবা মায়ের দেখভালের জন্য লোক রাখতে রাজি, কিন্তু নিজে পেশাগত জীবনের সঙ্গে আপস করতে রাজি নয়। কর্মক্ষেত্রের সারাদিনের চাপ সামলানোর পর তাদের আর বৃদ্ধ বাবা মাকে সেবাযত্ন বা দেখভাল করার মতো মানসিকতা থাকে না। বর্তমান জীবনের কঠিন পরিস্থিতিই এই প্রজন্মকে উদাসীন করেছে।
সঙ্গীতা কর্মকার, সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিভাগের ছাত্রী
ভারতে জন্মের পর থেকে একটি শিশুকে সম্মানের চিহ্ন হিসাবে বড়দের পা স্পর্শ করতে শেখানো হয়। বাবা-মা সন্তানকে মানুষ করেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানকেই অভিভাবক মানতে চান তাঁরা। তবে বর্তমান প্রজন্ম যৌথ পরিবার থেকে নিজেদের দূরে রাখাকে প্রাধান্য দেয়। তাদের কর্মব্যস্ততা এবং কর্মসূত্রে ভিনরাজ্যে বা ভিনদেশে পাড়ি দেওয়ার কারণে তারা বৃদ্ধ বাবা মায়ের দেখভালে অত্যন্ত উদাসীন। বাইরে থেকে টাকা পাঠালেই আদর্শ সন্তান হওয়া যায় না। অসুস্থতার সময়ে নিজের হাতে সময়মতো ওষুধ দেওয়া আর কয়েকশো কিলোমিটার দূর থেকে খোঁজ নেওয়ার মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাওয়া, দুর্বল বয়সে তাদের ভরণপোষণ না করাটা অসম্মান। ফলস্বরূপ তাঁদের মানসিক অবস্থার অবনতি হয়। ২০০০ সালে ভারতে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যাটা হাজারের অনেক কম ছিল কিন্তু ২০২৪-এ সেই সংখ্যা হয়েছে ৫০২০, যা দিনে দিনে আরও বাড়ছে। এটা বৃদ্ধ বাবা মায়ের দেখভালের ক্ষেত্রে এই প্রজন্মের উদাসীনতাকে আরও স্পষ্ট করে।
সুপ্রিয়া সেন, গৃহবধূ
যৌথ পরিবার যখন ভেঙে টুকরো হয়ে একক পরিবার হল, তখন শুরু হল নতুন সমাজ, নতুন সংস্কৃতি, নতুন পরিকল্পনা নিয়ে নতুন প্রজন্ম। যৌথ পরিবারের হাসি আনন্দ, স্বার্থত্যাগ, আর মূল্যবোধ সব উধাও হল এই একক পরিবারে। ঝামেলাহীন সংসারে মনের মতো ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য মা বাবা প্রতিযোগিতামূলক রণক্ষেত্রে রণবীর করার জন্য সর্বস্ব দিয়ে তাদের পালন করতে লাগল। তাঁরা এত ব্যস্ত, মানুষ করার মূল মন্ত্র মূল্যবোধটাই শেখাতে ভুলে গেলেন। সন্তান বড় হল, পরিণত হল, কিন্তু তাঁরা লক্ষ্য করলেন না ফল্গুধারার মতো উচ্ছৃঙ্খলতা, স্বার্থপরতার ধারা নিঃশব্দে বয়ে চলেছে। একদিন সমৃদ্ধবান সন্তান আরও বড় হল, গর্বিত মা বাবা মনে করলেন তাঁদের দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফল সার্থক। এই প্রজন্ম তখন নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত, মত্ত। মা-বাবার জীবনে তখন সন্ধ্যা শেষ। সন্তান সুখের জোয়ারে ভাসাবে এই স্বপ্ন তাঁদের চোখে। ছেলেমেয়রা দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে চায় না এ সংবাদ তাদের স্বপ্নের বাইরে! ধীরে ধীরে অসুস্থ-অপটু বাবা মা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েন। থম মেরে শুয়ে দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবেন ফসল বপনে গলদ ছিল! এই প্রজন্মের এমন অবনতির দায়ভার কিছুটা অভিভাবকেরও বটে!
সোহিনী রায়চৌধুরী, শিক্ষিকা
‘স্বামী-স্ত্রী আর অ্যালসেশিয়ান/ জায়গা বড়ই কম/ আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম!’ প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তীর এই গানের লাইনগুলো বড়ই হৃদয়স্পর্শী। আমরা বলে থাকি, ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।’ কিন্তু আজকের প্রতিষ্ঠা যাদের পরিশ্রম, ত্যাগ ও যত্নের ফসল, তাঁরাই হলেন বাবা-মা। আজকের এই বৃদ্ধরাই একসময় ছিলেন সমাজের ভবিষ্যৎ ও নিজ পরিবারের নির্মাতা। অথচ কালের বিবর্তনে কিছু সংখ্যক হয়েছেন অকর্মণ্য, নিজের ঘরে পরগাছা, সন্তানের চোখের বালি, পরিবারের ও সমাজের বোঝাস্বরূপ। তাদের চিকিৎসা, ওষুধ পথ্য ও নিয়মিত পরিচর্যা করতে বিরক্ত হয়ে অনেক সময় ছেলেমেয়েরা পরিত্রাণের পথ খুঁজতে চায়। এই ভরণপোষণের ব্যয় তাদের কাছে জলে যাওয়া পণ্যের মতো, ন্যূনতম অংশ ফেরত পাওয়ার আশা নেই! কোথাও আবার দেখা যায়, সংসারে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই (দেশে-বিদেশে) চাকুরিরত, তাদের কি ফুরসত আছে বৃদ্ধ বাবা-মার দিকে ফিরে তাকানোর? আয়ারাই ভরসা! আর নয়তো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবে বৃদ্ধাশ্রম! এই ভোগবাদী জীবন তাদের করে তুলেছে আত্মকেন্দ্রিক। পণ্যই মূল্যবান। আর ভালোবাসা? ভয় হয়, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দেখে। তারা কী শিখবে? শেষ বয়সে কি তাদের বাবা-মায়ের ও ঠিকানা হবে বৃদ্ধাশ্রম?
বিপক্ষে
তৃণা মণ্ডল, শিক্ষিকা
সহমত হতে পারছি না। এই প্রজন্ম দেখভালের ক্ষেত্রে আরও বেশি সচেতন। এখন লিঙ্গসাম্যের যুগ। আগে মনে করা হতো দেখাশোনার দায়িত্ব শুধুমাত্র ছেলেদেরই। এখন মেয়েরাও দায়িত্বশীল। এখনকার প্রজন্ম স্মার্টওয়ার্কে বিশ্বাসী। বাবা-মার প্রেশার, সুগার, কোলেস্টেরল, এমনকী মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও তারা ওয়াকিবহাল। বাইরে যেতেই হবে কাজ করার জন্য। সদিচ্ছা থাকলে দূরে থেকেও বাবা মায়ের দেখভাল সম্ভব। আরেকটা ব্যাপার যে এখনকার বাবা-মা তাদের সন্তানের প্রতি অনেক বেশি যত্নশীল। আগে সন্তান বেশি হওয়ার জন্য ততটা যত্ন সম্ভব হতো না। এই প্রজন্ম ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে যে তাদের বাবা-মা তাদের প্রতি কতটা যত্নশীল, তাই তারাও বাবা-মার প্রতি যত্নশীল হবে।
দীপ্তি রায়, ছাত্রী
সাল ২০২৪। যুগ এগিয়েছে, তার সঙ্গে আমরাও। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার এই মন্ত্র দিয়ে বড় করছেন আমাদের মা-বাবারই। তার ফলে আমরা এতটাই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে বাবা-মাকে আর সময় দিতে পারছি না। তবে বাবা-মায়ের দেখভালে এই প্রজন্ম উদাসীন, এই কথাটা এ প্রজন্মের হয়ে আমি মানতে নারাজ। আমরা হয়তো ব্যস্ততার কারণে বাবা-মাকে সময় দিতে পারি না কিংবা তাদের অসুস্থতায় নিজের হাতে পরিচর্যা করতে পারি না, ঠিক যেমনটা বাবা-কাকাকে করতে দেখেছি। কিন্তু আমরা তাদের জন্য যা ভালো, সেসব বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। শত ব্যস্ততার মাঝেও তাদের সময় দেওয়ার চেষ্টা করি। আর এখন বাবা-মায়েরাও চিন্তাধারায় অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে, ফলে তারাও আমাদের সঙ্গে চলতে পারছে।
অস্মিতা গুহ চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক
শুধুমাত্র এই প্রজন্মকে দোষ দিলে হবে না। সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই নির্ভর করে শিক্ষার উপর। ছোট থেকে শিশুরা ঠিক যেভাবে তাদের বাবা-মায়েদের দেখবে, তারই প্রতিফলন হবে তাদের কাজে। আমার সন্তান যদি ছোট থেকে দেখে তার মা এবং বাবা সমানভাবে তার ঠাকুরমা-দাদু এবং দিদা-দাদুর দেখভাল করছে, সেই ভাবনাচিন্তা তার মননে এমনিতেই ঢুকে যাবে। তাই বিষয়টা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে একজন শিশুর ছোট থেকে বড় হওয়ার উপর, তার শিক্ষার উপর। এ শিক্ষা পুঁথিগত শিক্ষা নয়। এই শিক্ষা দায়িত্ববোধের শিক্ষা। যে শিক্ষা বোঝায়, বৃদ্ধ বাবা-মা কখনও বোঝা নয়, তাঁরা আশীর্বাদ।
ইতুশ্রী রাহা, গৃহবধূ
সময় ও পরিস্থিতির কারণে যখন বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকা সম্ভব হয় না, তখন বৃদ্ধাশ্রমই শেষ ভরসা। শেষ জীবনে বাবা-মা একটু ভালো থাকুন, যত্ন পান, সময়মতো খাবার-ওষুধ পান, এই চিন্তাভাবনা থেকেই তাদের বৃদ্ধাশ্রমে রাখা। এটা কখনওই উদাসীনতা হতে পারে না। স্বামী বা স্ত্রীর বিয়োগে একাকিত্বের যন্ত্রণা ভুলতে, ছেলের সংসারে বোঝা না হতে অনেক বাবা-মাও স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রম বাছেন। একমাত্র কন্যাসন্তানের বিয়ের পর মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গিয়েও অনেকে স্থায়ীভাবে থাকতে চান না। বৃদ্ধাশ্রমে থাকার কারণ হাজারটা হতে পারে, কিন্তু তার সম্পূর্ণ দোষ সন্তানের, এমনটা নয়। দূরত্ব বাড়লে দাায়িত্ব-কর্তব্যের ধরন বদলায়। কিন্তু মনের অনুভূতি কমে না। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বাবা-মায়ের সন্তানদের মনে একটা অনুশোচনার ক্ষতও থাকে, যেটা কাউকে দেখানো যায় না।