গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
সামনের চায়ের কাপ থেকে যেন পাকিয়ে উঠছে রহস্যের ধোঁয়া। চুপ করে বসে তার দিকে তাকিয়ে তোপসে। ওদিকে লালমোহনবাবু প্লেটে চা ঢেলে ‘সুড়ুৎ’ শব্দ করে সেটা খেলেন। এরপর উসখুস হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। তোপসে মুখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল, এখন কোনও কথা বলবেন না।
একটু পরে ফেলুদা বিড়বিড় করে স্বগতোক্তির মতো করে বললেন, ‘নিশ্চিন্তে আর থাকা গেল না রে তোপসে!’
সেই কথার রেশ টেনে লালমোহনবাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘ভেরি সাসপিশাস্ অ্যান্ড মিস্টিরিয়াস!’
তোপসে বলল, ‘এখানেও দেখছি ডক্টর হাজরা অ্যান্ড মন্দার বোস জুটি। অর্থাৎ ভণ্ড ভবানন্দ ও তার চ্যালা।’
ফেলুদা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘হুম, কিংবা বলতে পারিস মগনলাল ও মছলিবাবা। জুটি দেখলেই বুঝবি, কোনও গণ্ডগোল আছে। আর টাক মাথার লোক দেখলেই সাবধান!’
জটায়ু সেই কথা শুনে একটা বিষম খেলেন। আর একটু হলে মুখের চা ছিটকে পড়ত। চায়ের কাপটা নামিয়ে তিনি নিজের টাকে হাত বুলিয়ে নিলেন। মুখটা কুঁচকে তাকালেন ফেলুদা আর তোপসের দিকে।
ফেলুদা বলল, ‘দ্যাখ, ছিল বন্দে ভারতের স্লোগান। সেটার আড়ালে চলছিল বন্ড-এ ভারতের লুকাছুপি খেলা। একদিকে মগনলাল বাবাজি অন্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির হুঙ্কার ছাড়ছেন, অন্যদিকে তাঁরই লাখ টাকার পোশাকে লেগে গেল দুর্নীতির পাঁক। বোঝা গেল, ইলেকশন বন্ডের খেলায় রাজনীতিকরা আসলে বন্ডেড লেবার।’
তোপসে বলল, ‘পুরো খেলাটা মগনলাল এমনভাবে খেলেছেন, যাতে ফুল ক্যাশ অন্যের ঘরে না ঢোকে। শুধু নিজেদের তহবিলেই আসে শিল্পপতিদের টাকা। তার জন্য অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে ইডি, সিবিআইকে।’
লালমোহনবাবু বললেন, ‘সিরেফ ম্যায় খাউঙ্গা, কিসিকো খানে নেহি দুঙ্গা।’
ফেলুদা বলল, ‘একেবারে ঠিক বলেছেন লালমোহনবাবু। ব্ল্যাকমেল পলিটিক্স। আমরা এতদিন চোর দেখেছি, এবার তো ডাকাত ধরা পড়ে গেল।’
লালমোহনবাবু বললেন, ‘ডেকয়েট, এরা কি আরাবল্লির ডেকয়েটের মতোই ভয়ঙ্কর?’
ফেলুদা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘না লালমোহনবাবু, এরা তার থেকেও ভয়ঙ্কর।’
তোপসে বলল, ‘তুমি কি আজকের কাগজটা দেখেছো ফেলুদা? বিভিন্ন রাজ্যের প্রচারে এর মধ্যেই ওদের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছে। চান্দা চোর চান্দা চোর বলে।’
ফেলুদা খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘পুলওয়ামা, নোটবাতিল, ইডির হানা, সিবিআইয়ের চমকানি, ইলেকশন বন্ড, সিএএ, এনআরসি আর মগনলাল মেঘরাজ।’
লালমোহনবাবু হতভম্ব মুখ করে শুধু বললেন, ‘দেখুন এর থেকে ঢের সহজ হতো যদি আপনি বলতেন চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ আর রুমালের মা।’
ফেলুদা বলল, ‘বেশ, সহজ করেই বলব, তবে আপনাকে একটা কথা দিতে হবে।’
লালমোহনবাবু চোখ বুজে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘নিন, টেক।’
ফেলুদা বলল, ‘শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে থাকলে আপনার বিপদ হতে পারে। এমনকী জীবন বিপন্নও হতে পারে।’
লালমোহনবাবু একটা উপেক্ষার হাসি হেসে বললেন, ‘আপনি জটায়ুকে বিপদের ভয় দেখাচ্ছেন? গড়পাড়ের লালমোহন গাঙ্গুলিকে?’
ফেলুদা বলল, ‘আমাদের দেশ ঘোর সঙ্কটে লালমোহনবাবু। মগনলাল মেঘরাজরা আগে চোরাই মূর্তি বিদেশে বেচত। এখন ক্ষমতায় এসে ওরা পুরো দেশটাকেই বিক্রি করে দিতে চাইছে। দেশটাকে ধর্মের ভিত্তিতে, হিংসার ভিত্তিতে ভাঙতে চাইছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে এরা তলে তলে নিজেরাই দুর্নীতির হাইরাইজ হয়ে উঠেছে। সেই মৌচাক এবার আমাকে ভাঙতেই হবে। হয় আমি মগনলালের মুখোশ খুলে দেব, নাহয় গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব।’
লালমোহনবাবু বললেন, ‘ওদের বাহুবলীর জোর সম্পর্কে আপনার নিশ্চয় আইডিয়া আছে। এখন রাজনীতি মানেই বাহুবলীদের আস্ফালন। ওদের দলে হাজার হাজার গুণময় বাগচী আছে।’
ফেলুদা বলল, ‘আপনি ভুল বললেন লালমোহনবাবু। বডিবিল্ডার গুণময় বাগচীদের কাছে দেহ হল মন্দির। আর মগনলালদের কাছে মন্দির হল ক্ষমতা দখলের অস্ত্র। মগনলাল, মছলিবাবা, ভবানন্দরাই আজ ভারত ভাগ্যবিধাতা, এটাই আমাদের বড় দুর্ভাগ্য।’
লালমোহনবাবু আবৃত্তি শুরু করলেন, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছো অপমান, তাদের ভোটেই এবার তুমি হবে গোহারান।’
লালমোহনবাবুকে থামিয়ে ফেলুদা বলল, ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে আপনাকে প্যারডি করতে কে বলেছে?’
লালমোহনবাবু বললেন, ‘না মানে একটা দেশাত্মবোধের মুড এসে গেল।’
ফেলুদা বলল, ‘ব্যাপারটা এত সরল নয় লালমোহনবাবু। অনেক জটিলতা। কারা কারা টাকা দিয়েছে, টাকা দেওয়ার পর কী কী স্বার্থ তাদের রক্ষিত হয়েছে, কেন ইডি হানা হল, ইডি হানার মাধ্যমে কি কোম্পানিগুলোকে ব্ল্যাকমেল করা হল? তার পরপরই বা কেন সেই কোম্পানিগুলি বন্ড কিনল? কোম্পানিগুলির সঙ্গে মগনলালের কী ডিল হয়েছিল? কেন ওষুধ কোম্পানিগুলি বন্ডে টাকা দেওয়ার পরই বাজারে নির্বিচারে বেড়ে গেল ওষুধের দাম? টাকাগুলো তোলার পর গেল কোথায়? কোন রাজ্যের সরকার ভাঙতে কত টাকা ঢালা হয়েছে? সে টাকার জোগান দিয়েছে কে? কত টাকার বিনিময়ে বিরোধী বিধায়কদের কেনা হয়েছে? সব অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে রে তোপসে! অনেক জাল। সব এক এক করে খুলতে হবে। তার আগে একবার কলকাতায় ফিরে সিধুজ্যাঠার সঙ্গে দেখা করতে হবে। কয়েকটা জিনিস জানার আছে।’
তোপসে বলল, ‘ফেলুদা, আমরা আর দিল্লিতে ক’দিন আছি?’
ফেলুদা বলল, ‘আর একটা বিষয় জানার আছে। সেটা মিটলেই চলে যাব। যাকগে, তোপসে তুই একটা লিস্ট করে ফেল। পুরো কেস স্টাডি করে লিখবি কোন কোম্পানির ঘরে কবে ইডি হানা দিয়েছে এবং তার কতদিন পরে বন্ডে শত শত কোটি টাকার তোলা পড়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি বন্ডের হিসাব নোট করে রাখবি। ঘুঘু তুমি চুপি চুপি খেয়ে যাও ধান।’
তোপসে বলল, ‘আমি এখনই কম্পিউটারে বসে পুরো কেসটার একটা স্ট্যাটিসটিক্স করে ফেলছি।’
ফেলুদা বলল, ‘আর ওই ‘শত্রু’ দেশের কোম্পানির ব্যাপারটা আলাদা করে লিখে রাখিস। শত্রু দেশ থেকে কেন মগনলাল, ভবানন্দদের তহবিলে টাকা বারবার টাকা আসছে?’
জটায়ু বললেন, ‘ঠিক বলেছেন, ওটা নিয়ে আলাদা করে কাল্টিভেট করা দরকার।’
ফেলুদা বলল, ‘করব, তবে আমার কী মনে হয় জানেন, এটা একটা ফ্রড কোম্পানি। এই নামে খোলা হয়েছিল নির্বাচনী বন্ডে টাকাটা ঢোকানোর জন্য। তারপর সেটা উধাও হয়ে যায়। সকলের চোখে ধুলো দেওয়ার এটা একটা পন্থামাত্র। আরও দেখতে হবে, সুইস ব্যাঙ্ক থেকে কালো টাকা আনার প্রতিশ্রুতির আড়ালে বিদেশের কোন কোন ব্যাঙ্কে মগনলালদের টাকা ঢুকেছে। যাকগে দেখা যাক। আচ্ছা লালমোহনবাবু, আপনার কাছে সেই সাধুর পোশাকটা আছে তো? সেই যে বেনারসে যেটা পরে গঙ্গার ঘাটে বসেছিলেন?’
জটায়ু বললেন, ‘হ্যাঁ আছে। ওটা কি আবার পরতে হবে নাকি মশাই?’
ফেলুদা বলল, ‘সাধুদের দলে ঢুকে তদন্ত করতে গেলে সাধু সাজতেই হবে।’
জটায়ু উল্লসিত হয়ে দু’হাত উপরে তুলে লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘ব্রেভো ব্রেভো!’
ফেলুদা তাঁকে থামিয়ে বললেন, ‘দাঁড়ান, এখনই অত লাফাবেন না। আপনার অতি উৎসাহে একবার হাতে পেয়েও ভবানন্দের চ্যালাকে ধরতে পারিনি।’
জটায়ু কিছুটা নিরুৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘এখন কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
ফেলুদা বলল, ‘করুন।’
জটায়ু কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, ‘এই যে ইলেকশন বন্ডের ব্যাপারটা, এটার বাংলা কি আমরা দুর্নীতির হাতবাক্স করতে পারি?’
ফেলুদা বলল, ‘আংশিকভাবে পারেন। দুর্নীতি না হলে আমি তদন্তে নামলাম কেন?’
লালমোহনবাবু বললেন, ‘ঠিক ঠিক।’
ফেলুদা বলল, ‘তাহলে লালমোহনবাবু বুঝতে পারলেন, মগনলালের রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য কী?’
লালমোহনবাবু হেসে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে থাকতে থাকতে এখন বেশ বুঝতে পারি, মগনলালের মূল উদ্দেশ্য হল, অন্যদের ভাঁড়ার শূন্য করে গোপনে গোপনে নিজেদের তহবিল ভরানো। আর রাজনীতিতে নিজেকে আধুনিক হিটলার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা।’
ফেলুদা বলল, ‘বাহ, এই তো আপনার বুদ্ধি ক্রমেই প্রখর রুদ্রকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।’
লালমোহনবাবু বললেন, ‘আপনার সঙ্গে থেকে থেকে মশাই কত কিছু শিখলাম।’
ফেলুদা বলল, ‘তাহলে আপনার পরবর্তী উপন্যাসটা উতরে যাবে বলছেন?’
জটায়ু বললেন, ‘সবই আপনার অনুপ্রেরণায়। একটা জবরদস্ত নাম দিতে হবে।’
তপসে বলল, ‘ওই হন্ডুরাসে হাহাকারের মতো?’
জটায়ু বললেন, ‘হ্যাঁ, আমাকে তাড়াতাড়ি কলকাতায় ফিরতে হবে। লিখতে হবে আমার আটত্রিশতম উপন্যাস, বন্ড রহস্য ও ব্যান্ডিটস!’