গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
নির্বাচন কমিশন যে স্বশাসিত সংস্থা, বাসুদেব-প্রতিমারা সে সব জানেন না। তাঁদের কাছে সবটাই দিল্লির সরকার। ওরাই সব করে। না জেনেও খুব ভুল তাঁরা জানেন না। কমিশনার নিয়োগে যদি কেন্দ্রের পূর্ণ ক্ষমতা থাকে, তাহলে দিনক্ষণ ঠিক করার ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা কি তারা দাবি করবে না? কোন রাজ্যে কত দফায় ভোট হবে, তামিলনাড়ুর কতদিন পর গুজরাতে ভোট হবে, কোথায় কত কেন্দ্রীয় বাহিনী যাবে... এই সব প্রশ্নের উত্তর কেন্দ্রের সরকারের আস্তিনে লুকনো থাকে। চিরাচরিতভাবে। এবারও আছে। বিতর্ক হবে? হোক না। অসুবিধা কোথায়। নির্ঘণ্টের শেষ পর্বে পৌঁছে ঝুলিতে কতগুলো ভোট নিশ্চিত হল, সেটাই আসল কথা। তাই পথটা মসৃণ করতে হবে। এক এক দফার মধ্যে যদি দিন সাতেকের ব্যবধান থাকে, তাহলে নরেন্দ্র মোদিকে হুড়োহুড়ি না করলেও চলবে। তাঁরও তো বয়স হয়েছে! সরকারিভাবে ৭২। দশ বছর আগে প্রতিদিন যেভাবে তিনি দেশের কোণায় কোণায় ছুটে বেড়িয়েছিলেন, এখন তা সম্ভব নয়। এখনও তিনি হয়তো দিনে তিনটি সভা করবেন, তেলেঙ্গানা থেকে বিহার হয়ে মধ্যপ্রদেশ ছুটবেন... কিন্তু মাঝে একটু বিরাম তো চাই! ভোট ঘোষণার পর থেকে শেষ দফা পর্যন্ত আড়াই মাস তাই পর্যাপ্ত সময়। ঘুঁটি সাজানোর যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। সময় নরেন্দ্র মোদির জন্য, অমিত শাহের জন্যও। দ্বিতীয়জন প্ল্যান করবেন, আর প্রথমজন ডেলিভার। তৃতীয় ইনিংসের জন্য কোনওরকম ফাঁক রাখা যাবে না। ৪০০ আসন না হোক, বিজেপির কোষাগারে ৩৫০’এর বেশি আসন চাইই চাই। সামনে যে অনেক কাজ! দেশজুড়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করাটা বিজেপি-আরএসএসের চিরকালীন এজেন্ডা। সঙ্গে রয়েছে সিএএ, বাছাই করা কয়েকটি রাজ্যে এনআরসি এবং অবশ্যই ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ কার্যকর করা। তার জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এক্ষেত্রে অন্তত কোনওরকম বাধার মুখোমুখি হতে নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহ চাইবেন না। সেটা সম্ভব, যদি লোকসভা এবং রাজ্যসভা—দুই কক্ষেই তাঁরা গরিষ্ঠতা পেয়ে যান। লোকসভা নির্বাচনে ৪০০’র কাছাকাছি আসন তারই প্রথম এবং প্রধান ধাপ। দুই-তৃতীয়াংশ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। তার জন্য প্রত্যেকটা রাজ্য, প্রত্যেকটা কেন্দ্র ধরে ধরে প্ল্যান সাজাতে হবে। যে কেন্দ্রে মতুয়া ভোটার বেশি, সেখানকার জন্য নাগরিকত্ব। যেখানে মুসলিম সংখ্যাধিক্য, সেই কেন্দ্রের জন্য তিন তালাক। মারাঠাদের জন্য সংরক্ষণ, গো বলয়ের হিন্দুদের জন্য রামমন্দির। ঘুঁটিগুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। গুছিয়ে নেওয়ার সময়টা চেয়েছিলেন মোদিজি। পেয়েও গেলেন।
এই নির্ঘণ্টে বাকি দলগুলোর সুবিধা বা অসুবিধা কী হল? পশ্চিমবঙ্গের আসন সংখ্যা ৪২। পাহাড় থেকে সমুদ্র—একটি কেন্দ্রের চরিত্র অন্যটির থেকে আলাদা। মাটি, আবহাওয়া, মানুষ... আলিপুরদুয়ারের সঙ্গে কলকাতা দক্ষিণের ফারাক আকাশ-পাতাল। কিন্তু মিল একটাই—গোটা বাংলা বাঁধা এক সুরে। এখানকার মানুষ রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসে, চায়ের দোকানে সিপিএম-তৃণমূলের চর্চায় ধোঁয়া ওঠে, আর ভোটের দিন সকালে সেই সব ভুলে লাইনে গিয়ে দাঁড়ায়। বুথের দরজা খোলার আগেই। বাংলার মানুষ জানে, ভোটদানটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। এটা প্রয়োগ করতে হয়। এই রাজ্যে অন্তত কমিশনকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শেখানোর কাজটা না করলেও চলে। কোনও বুথের সামনে সকাল ১০টায় হয়তো বোমা পড়ে। শুনশান হয়ে যায় চত্বর। কিন্তু দুপুরে আবার আমরা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাই। আরএসপি সমর্থক জিজ্ঞেস করেন পড়শি কংগ্রেস কর্মীকে... ‘ভাই গোলমাল আর নেই তো? তাহলে ভোটটা দিয়ে আসি।’ বুক ঠুকে বলতে পারি, দেশের কোনও রাজ্যে এই আবহ দেখা যায় না। যাবেও না। তাহলে এই বাংলার জন্য সাত দফায় ভোট কেন? তামিলনাড়ুতেও তো ৩৯টি আসন। সেখানে কেন এক দফা? উত্তর লুকিয়ে আছে নির্ঘণ্টেই। বাংলায় প্রথম দু’টি দফার ভোট উত্তরবঙ্গে। অর্থাৎ বিজেপির তথাকথিত শক্ত জমি। এবং প্রত্যেক জেলার ক্ষেত্রে বিভাজনের অঙ্ক কষে রাখা আছে। পৃথক গোর্খাল্যান্ড, পৃথক উত্তরবঙ্গ, বা সীমাঞ্চল। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের টোপ, আলাদা মুখ্যমন্ত্রী, পৃথক ফান্ড। ঠিক একইভাবে গৌড়বঙ্গের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ, তারপর জঙ্গলমহল, বনগাঁ ও বারাকপুরে ভোটগ্রহণের দিন উত্তর ২৪ পরগনার বাকি কেন্দ্র থেকে আলাদা করে দেওয়া, আর সবশেষে কলকাতা। কেন্দ্রগুলো খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এলাকার চরিত্র এবং গেরুয়া শিবিরের শক্তি নিপুণভাবে মাথায় রেখে দিনক্ষণ সাজানো হয়েছে। প্রচারে সুবিধা হবে, পাশাপাশি জোর দেওয়া যাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যবহারেও। গত লোকসভা ভোটে বাংলায় এসেছিল ৭১০ কোম্পানি আধাসেনা। এবার সংখ্যাটা হতে চলেছে ৯২০ কোম্পানি। প্রথম দফার ভোট—অর্থাৎ জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার কেন্দ্র শুরু হবে ২২৫ কোম্পানি দিয়ে। মনে রাখতে হবে, ওইদিন দেশের ২২টি রাজ্যে নির্বাচন রয়েছে। তারপর চাপ সর্বত্রই কমে যাবে। আর সব রাজ্য থেকে সিআরপি জওয়ানদের ধীরে ধীরে নিয়ে আসা হবে বাংলায়। আমাদের রাজ্যে প্রথম দফায় কিন্তু দার্জিলিং নেই। দ্বিতীয় দফায় আছে। সঙ্গে রায়গঞ্জ, বালুরঘাট। অর্থাৎ প্রথম দফার ভোট হয়ে গেলে পাশের জেলা থেকে আধাসেনার একাংশ চলে যাবে দার্জিলিংয়ে, আর বাকিটা রওনা দেবে দিনাজপুর। পারফেক্ট প্ল্যান। তাহলে প্রথম দিকে এক একটি কেন্দ্রে কত কোম্পানি বাহিনী থাকছে? প্রায় ৭০ কোম্পানি। অর্থাৎ এক একটি বিধানসভা এলাকায় অন্তত ১০ কোম্পানি আধাসেনা। মানে ১ হাজার জওয়ান। দফা যত গড়াবে, সংখ্যাটা বাড়বে পাল্লা দিয়ে।
স্যাম মানেকশ অনেক আগেই একটি চিরকুটে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে লিখে দিয়েছিলেন, ৭১’এর যুদ্ধ শুরু হবে ৩ ডিসেম্বর। সেটাই হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনকেও কি কেউ লিখে দিয়েছেন যে, ১৯ এপ্রিলের পর বাংলায় কোনও যুদ্ধ শুরুর কথা আছে? না হলে জম্মু কাশ্মীরে ৬৩৫ কোম্পানি, আর পশ্চিমবঙ্গে ৯২০ কোম্পানি আধাসেনা কেন? যদি রাজ্যের পরিধি বা জনসংখ্যা বিচার্য হয়, সেক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশে কেনই বা ২৫২ কোম্পানি? কেন্দ্রীয় সরকারি হিসেবই বলছে, অপরাধের যে কোনও নিরিখে যোগীরাজ্য বাকিদের কয়েকশো যোজন পিছনে ফেলে রেখেছে। ভোট এলে সেই অপরাধীদের বাহিনী কি বাল্মীকি হয়ে যাবে? নাকি ডাবল ইঞ্জিন রাজ্য হওয়ার সুবিধা তুলছে তারা?
আসলে কোনওটাই না। বাংলা সব সময় মোদি সরকারের জন্য স্পেশাল। তাই এখানকার ভোটারদের কাছে তাদের হর্তাকর্তাদের দাবিও বোধহয় বেশি। সেই কারণেই হয়তো বিজেপি নেতারা এখানকার মানুষকে প্রাপ্য পারিশ্রমিক না দিয়েও ভোট চাইতে পারেন। দুর্নীতির কথা বলেন, কিন্তু তা প্রমাণ হয় না। মোদি সরকারের বাঘা বাঘা অফিসাররা হাতেগোনা কয়েকজনকে জেলে ভরে রাখেন। অথচ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন না। শুধু আটকে থাকে গরিব মানুষের টাকা। ভোট আসে, যতটুকু কাজ চলছিল, সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। শব্দ শোনা যায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর বুটের। সেই শব্দ বাড়তে থাকে। বাহিনীর জওয়ানরা এই রাজ্যে থেকে যায় ভোটপুজো শেষ হওয়া পর্যন্ত। আর তাদের টাকা কাকে দিতে হয়? রাজ্য সরকারকে। অর্থাৎ, আপনার-আমার করের টাকা। সাত দফায় আড়াই মাস ধরে ভোট। প্রতিমা-বাসুদেবদের সঞ্চয় ফুরিয়ে আসে। কাজের খোঁজে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন তাঁরা। কাজ কিছু হয়তো মেলে। পেট ভরে না। টান লাগে সংসারে। ফিকে হয়ে যায় বিকাশের প্রতিশ্রুতি। আর কেন্দ্রের সরকার ব্যস্ত থাকে ভোটে। জনসভা, রোড শো... দলগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে তর্জনির এক একটি নীল কালির দাগের জন্য। পাহারায় থাকে বাহিনী। তাদের থাকা, খাওয়া, যাতায়াতের বিল আসে নবান্নে। পরে কখনও কেন্দ্র সেই টাকা মেটায় রাজ্যকে। কিন্তু রাজ্যবাসীর হকের টাকা? মিলিয়ে থাকে ধোঁয়াশাতেই।