গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
পূর্ব বর্ধমান জেলার নসরৎপুরের কিশোরীগঞ্জে গণেশ গোঁসাইয়ের বাড়ি। পেটের ব্যবস্থা করতেই তাঁর দিন কেটে যায়। তবে সব খোঁজখবর রাখেন। তাঁদের নাগরিকত্ব দিতেই যে আইন হয়েছে, সেটাও তিনি জানেন। আবেদন করবেন কি না জিজ্ঞাসা করতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, ‘কিছুতেই করব না। আমাদের কি সুখে থাকতে ভূতে কিলিয়েছে?’
কাটোয়ার পানুহাটের বেশিরভাগই পূর্ববঙ্গ থেকে আসা পরিবার। সেই গ্রামেও সিএএ নিয়ে কোনও হেলদোল নেই। উল্টে নতুন করে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলায় বেশিরভাগ মানুষই বেশ বিরক্ত। তাঁদের প্রশ্ন, ভোটের মুখে খুঁচিয়ে ঘা করার কি খুব দরকার ছিল? সত্যেন বারুই, নীতীশ ঘরামিরা জানিয়ে দেন, কোনও মতেই আবেদন করবেন না। নীতীশবাবুর হুঁশিয়ারি, কেউ কাগজপত্র দেখতে এলে আগে তাঁরই নাগরিকত্বের প্রমাণ দেখতে চাইব। তারপর অন্য কথা। এতদিন এদেশে আছি। ভোট দিচ্ছি। এখন আবার নতুন করে নাগরিকত্ব নিতে হবে? ইয়ার্কি হচ্ছে!
তবে, সিএএ চালু হওয়ায় কালনার সাতগেছিয়া পঞ্চায়েতের পূর্ব সাহাপুরের শ্যামল ডাকুয়া বেজায় খুশি। তিনি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবেন। যদিও তিনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন প্রায় ৫০ বছর আগে। তাঁর ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, সব আছে। ছেলের আছে পাসপোর্টও। তবুও তিনি আবেদন করবেন। তার প্রথম কারণ প্রতিবেশীরা মাঝেমধ্যেই তাঁকে ‘উদ্বাস্তু’ বলে কটাক্ষ করে। নাগরিকত্ব পেলে সেটা আর শুনতে হবে না। দ্বিতীয় কারণ তাঁর বিশ্বাস, নরেন্দ্র মোদি যা করেন, সেটা মানুষের ভালোর জন্যই করেন। তাই প্রয়োজন থাক বা না থাক তিনি আবেদন করবেন।
শ্যামল ডাকুয়া নাকি নীলরতন বিশ্বাস, কাদের পাল্লা ভারী, সেটার প্রমাণ পাওয়া যাবে চব্বিশের ভোটে। শ্যামলবাবুরা সংখ্যায় বেশি হলে নির্বাচন ঘোষণার মুখে সিএএ চালুই হবে বিজেপির মাস্টার স্ট্রোক। আর নীলরতনবাবুরা সংখ্যায় বেশি হলে সেটাই হবে ব্যুমেরাং।
সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে জোর চলছে সিএএ নিয়ে কাটাছেঁড়া। চলছে যুক্তি, পাল্টা যুক্তি। তাতে অনেকেই মনে করছেন, এতদিন নাগরিকত্ব নামক যে গাজরটি ঝোলানো হচ্ছিল, তা আসলে ‘ফাঁদ’। কারণ নাগরিকত্বের আবেদন খারিজ হয়ে গেলে তাঁর কী হবে, তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা সংশোধিত আইনে বলা নেই। যদি যাচাই কমিটি আবেদনকারীর দাখিল করা নথি সন্তোষজনক নয় বলে মনে করে তাহলে তিনি নাগরিকত্ব পাবেন না। সেক্ষেত্রে কি তিনি ‘অনুপ্রবেশকারী’ হয়ে যাবেন? নাকি ফের আবেদনের সুযোগ পাবেন? এরও কোনও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া নেই।
সবচেয়ে বড় কথা নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যে সমস্ত প্রমাণ চাওয়া হচ্ছে তা জোগাড় করাই কঠিন। অশান্তির কারণে রাতারাতি এককাপড়ে যাঁরা সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছেন, তাঁদের পক্ষে কি এইসব নথি আনা সম্ভব ছিল? তাছাড়া তাঁরা কী করে প্রমাণ করবেন যে ধর্মীয় অত্যাচারের কারণেই জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
সিএএ-তে কোথাও নাগরিকত্ব খারিজের কথা বলা নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক আধার নম্বর লক হওয়ার ঘটনায় ‘ঘাড়ধাক্কা’ খাওয়ার ভয় বহু মানুষকেই তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কারণ যাঁদের আধার নম্বর অচল হয়েছিল তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই অন্য দেশ থেকে এসেছেন। আর তাঁদের বেশিরভাগই এসেছেন ২০০০ সালের পর। মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে আধার নম্বর ফের চালু হয়েছে। কিন্তু সেটা কতদিন চালু থাকবে, তার কোনও গ্যারান্টি নেই। এখন অনেকেই বলছেন, তখন আধার নম্বর লক করে সিএএ লাগুর রেকিটা সেরে ফেলা হয়েছে। আসল ‘খেলা’ শুরু হবে নির্বাচনের পর।
পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের সুপ্রসেন সরকারের লক হওয়া আধার নম্বর ফের চালু হয়েছে। কিন্তু তিনি স্বস্তিতে নেই। এই অবস্থায় সিএএ চালু হওয়ায় আতঙ্ক তীব্র হয়েছে। নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবেন কি না, তা বুঝতে পারছেন না। তাঁর ভোটার ও আধার কার্ড আছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে কবে এসেছেন, তার কোনও প্রমাণ নেই। তিনি শখ করে দেশ ছাড়েননি। এসেছেন অত্যাচারে ও আতঙ্কে। কিন্তু সেটা প্রমাণ করবেন কী করে? তাই সিএএ নিয়ে এখন তাঁর কাছে ‘সাপের ছুঁচো গেলা’ অবস্থা। একদিকে নাগরিকত্বের টোপ, অন্যদিকে সব হারানোর ভয়। নথিপত্র দেখে যাচাই কমিটি সন্তুষ্ট না হলে বন্ধ হতে পারে সরকারি সুযোগ সুবিধাও।
অসমের ঘটনা এরাজ্যের নাগরিকত্ব প্রত্যাশী মতুয়াদের মনেও সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। অসমে এনআরসির সময় প্রায় সাড়ে ২৬ লক্ষ মানুষের আধার কার্ড ‘হোল্ড’ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে তাঁরা সরকারি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অসমে ডাবল ইঞ্জিন সরকার। তা সত্ত্বেও ঝুলে থাকা আধার কার্ডের নিষ্পত্তি হয়নি। আর বাংলায় তেমনটা ঘটলে তো কথাই নেই। একে অপরের দিকে আঙুল তুলেই বছরের পর বছর কাটিয়ে দেবে।
বঙ্গ বিজেপির নেতারা ভেবেছিলেন, সিএএ লাগুর ঘোষণামাত্র মতুয়াদের উচ্ছ্বাস সুনামির মতো আছড়ে পড়বে। জ্বালানির জ্বলুনি, বেকারত্ব, সব ইস্যু পিছনে চলে যাবে। নাগরিকত্ব পাওয়ার আনন্দে পূর্ববঙ্গ
থেকে আসা মানুষজন রাস্তায় নেমে বিজয় উৎসব পালন করবে। আনন্দ প্রকাশের ধরনটা কেমন হবে, তার একটা ‘ডেমো’ও শান্তনু ঠাকুরের
অনুগামীরা ঠাকুরবাড়িতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার কোনও প্রভাবই পড়ল না। কিছু কিছু এলাকায় বিজেপির উদ্যোগে নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়ে মিছিল হল ঠিকই। কিন্তু যাঁরা মিছিলে হাঁটলেন তাঁরাও আবেদন করতে চাইছেন না। ভয় পাচ্ছেন। পাছে আম ও ছালা দু’-ই যায়।
বঙ্গ বিজেপির নেতারাও সেটা বুঝতে পেরেছেন। তাই আবেদনে উৎসাহ দেওয়ার বদলে নাগরিকত্ব খারিজ হবে না, এই অভয় দিতেই তাঁরা ব্যস্ত
হয়ে পড়েছেন। তাঁরা প্রতিটি জনসভায় গিয়ে একটা কথাই বলছেন, ‘এটা নাগরিকত্ব দেওয়ার
আইন, কেড়ে নেওয়ার নয়।’ কিন্তু যাঁদের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই, তাঁদের কী হবে? এর কোনও উত্তর নেই।
এতদিন যাঁরা নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় বিজেপি ডাকে জয়ডঙ্কা, কাঁসর, সিঙ্গা ফুঁকতে ফুঁকতে রাস্তায় নেমে পড়তেন, তাঁরাই গিয়েছেন থমকে। কারণ দিন যত যাচ্ছে নাগরিকত্ব পাওয়ার পদ্ধতি ততই জটিল হচ্ছে। শুধু আবেদন করলেই হবে না, দিতে হবে ইন্টারভিউও। ফলে সিএএ লাগুর ঘোষণায় প্রথমে যাঁরা হাতে চাঁদ পেয়ে গিয়েছেন বলে ভেবেছিলেন তাঁরাই এখন হেনস্তা হাওয়ার ভয়ে আবেদন করতে পিছিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, যদি নাগরিকত্ব দেওয়াই উদ্দেশ্য হয় তাহলে কেন চাপানো হচ্ছে এত শর্ত? ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড দেখেই নাগরিকত্ব দিলে তো ল্যাটা চুকে যেত।
রামমন্দির বাংলায় কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না, সেটা বঙ্গ বিজেপির নেতারাও বিলক্ষণ জানতেন। তাই দিল্লির দেওয়া রামমন্দির কেন্দ্রিক ‘টাস্ক’ পালনে ছিল না কোনও আগ্রহ। সন্দেশখালি নিয়ে খানিক হইচই হলেও তা ‘গেম চেঞ্জার’ হতে পারল না। বঙ্গ বিজেপির শেষ ভরসা ছিল সিএএ। কিন্তু যাঁদের জন্য এই আইন তাঁরাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তবে, এরপরেও হয়তো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের শেখানো রাস্তায় সিএএ-কে স্বাগত জানিয়ে মহা উৎসাহে বাজানো হবে ঢাক, কাঁসর, জয়ডঙ্কা। কিন্তু তাতে কি মতুয়া ভোট গেরুয়া শিবিরে আছড়ে পড়বে? তা নিয়ে রয়েছে ঘোর সংশয়। কারণ তাঁরাও বুঝে গিয়েছেন, বিজেপি তাঁদের হাতে নাকের বদলে ধরিয়ে দিয়েছে ‘নরুন’।