সত্য-প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ব্রহ্মচর্য্যের পরম-সহায়ক। সত্যই ব্রহ্ম,—ইহা শাস্ত্রের নির্দ্দেশ, ইহা মুনিগণের উপলব্ধি। সত্যে যে বিচরণ করে, ব্রহ্মে বিচরণ তার কেন কঠিন হইবে? সত্যে দৃঢ় প্রতিষ্ঠা অর্জ্জন কর। যে পরের প্রাপ্যের প্রতি অন্যায় ও লুব্ধ দৃষ্টি দেয় না, তাহার পক্ষে সত্যে সুদৃঢ় হওয়ার পথ সুগম। যে অন্যের প্রতি মনে বিদ্বেষ পোষণ করে না, তাহার পক্ষে সত্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সহজ। যে অপরের অনুগ্রহ-লাভের প্রত্যাশী নহে, নিজের কার্য্য নিজের শক্তিতেই সাধন করিতে চেষ্টিত, তাহার পক্ষেও সত্যে প্রতিষ্ঠালাভ সহজ। জগতের অধিকাংশ মিথ্যাই অসৎ পথে বস্তু লাভের লোভ হইতে সৃষ্ট হয়। যাহা সৎপথে লাভ করিতে পারিবে না। তাহার প্রতি যদি লোভ থাকে, মানুষ মিথ্যা কহিতে বাধ্য হয়। যাহার প্রতি বিদ্বেষ আছে, ক্ষমার মহিমায় যদি তাহার প্রতি অন্তরের শত্রুতা-বোধ প্রশমিত করিতে না পার, তাহা হইলে তাহাকে অপদস্থ, হতমান ও পরাভূত করিবার জন্য মিথ্যার আশ্রয় লইতে তুমি প্রলুব্ধ হইবেই। পরের অনুগ্রহের উপরে যাহার জীবনের উন্নতি নির্ভর করিবে, সে তোষামোদ ও চাটুকারিতা করিবেই এবং নতজানু হইয়া নিজের বিবেক-বিরুদ্ধ অসত্যের অর্চ্চনা বারংবার করিবে। লোভ মনকে নীচ করে, মনকে সে চৌর্য্যের পথে ধাবিত করে। চৌর্য্যের কত সহস্র প্রকার ভেদ আছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। পিতা-মাতার অজ্ঞাতসারে তুমি কোন কুমারী কন্যার সহিত গোপনে দেখা-সাক্ষাৎ করিলে, আলাপ করিলে, গল্প স্বল্প করিলে। ইহাও তোমার চৌর্য্য। সত্যে প্রতিষ্ঠিত হইলে তোমার চিত্ত স্বচ্ছ হইবে, তখন তুমিবুঝিতে পারিবে যে, অভিভাবককে না জানাইয়া কোনও কুমারী মেয়ের কাছে একখানা পত্র পাঠাইলেও তুমি চৌর্য্যের অভিযোগে পড়িতে পার। গোপনতা চোরেরই স্বভাব। চোর না হইলে তুমি এই অন্যায় গোপনতার পথ ধরিবে কেন? প্রকাশ্যে যাহা করিতে পার না, তাহাই গোপনে করিবার জন্য তুমি অগ্রসর হইতে পার মাত্র তখন, যখন তোমার ভিতরে চোরের স্বভাব আসিয়া গিয়াছে। গুপ্ত লম্পট আর তস্কর, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য শুধু এইটুকু যে লম্পট পরকন্যার বা পরনারীর মন চুরি করিতে চাহে, তস্কর তৈজস-পত্র অপহরণ করিয়াই সন্তুষ্ট হইয়া যায়। গুপ্ত লম্পট সাধারণ তস্কর অপেক্ষা সমাজের বৃহত্তর অনিষ্টকারক। নিজেকে সর্ব্বদা সত্যে প্রতিষ্ঠিত রাখিবার চেষ্টা করিলে তোমার পক্ষে এমন দোষাবহ পথে পাদচারণা অসম্ভব হইবে। সত্যকে চরিত্রের শ্রেষ্ঠ ভূষণ বলিয়া সম্মান কর।
কৌমার যৌবন সঞ্চয়ের কাল। বিবাহের পূর্ব্ব পর্য্যন্ত নিজের শক্তিকে কেবল সঞ্চয়ই করিয়া যাইতে থাক। কৃপণ যেমন করিয়া কণা কণা সঞ্চয় করিতে করিতে একদা ধনী হয়, তুমিও তেমন কণা কণা করিয়া সামর্থ্য সঞ্চয় কর, ইচ্ছাকৃত অপব্যয় সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করিয়া দাও, অনিচ্ছায় অজ্ঞাতসারে অপচয় ঘটিয়া গেলে তাহার সম্পর্কে মনকে একেবারে নিরুদ্বেগ রাখ।
স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের ‘প্রবুদ্ধ যৌবন’ থেকে