উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
এদিন মৃতার ঠাকুমা বৃদ্ধা চাঁপাদেবী বলেন, বড় নাতনি ছোট থেকেই পড়াশোনায় মেধাবী। যে কারণে খুব সহজে কলকাতার সরকারি জায়গায় নার্সিং পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। কষ্ট হলেও ওর বাবা কখনই মেয়ের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, অভাবের ছায়া পড়তে দেয়নি। কিন্তু, এর চেয়ে ভালো ছিল, যদি নিজের গ্রামেই বাড়িতে ভিক্ষা করে দিন কাটাত। তবুও অকালে তো নাতনিকে প্রাণ হারাতে হতো না।
অন্যদিকে, মৃতা ছাত্রীর প্রতিবেশী গৃহবধূ মল্লিকা রুইদাস বলেন, সমাপ্তি মৃত্যু আমাদের কাছে পরিষ্কার করে দিয়েছে, গ্রামের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখতে নেই। এরপর গ্রামের কোনও বাবা-মা চাইবেন না, তাঁদের ছেলেমেয়েদের কলকাতায় পাঠিয়ে পড়াশোনা করাতে।
প্রসঙ্গত, গত শনিবার ভোরে কলকাতার চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের জিএনএম নার্সিং হস্টেল প্রথম বর্ষের মেধাবী ছাত্রী সমাপ্তি রুইদাসের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। দেহ উদ্ধারের পর থেকেই মৃতার পরিবারের পক্ষ থেকে সমাপ্তির মৃত্যুকে হত্যা বলে দাবি করা হয়েছিল। ঘটনার পাঁচদিন পরেও পরিবারের কাছে ফোন না আসায় কলেজ কর্তৃপক্ষের মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশ।
এনিয়ে কোতুলপুরের তাজপুর রামচরণ উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালন সমিতির সদস্য অশোক দাস বলেন, সমাপ্তির দেহ আনতে ওর পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিলাম। কিন্তু, ওই কলেজ কর্তৃপক্ষের আচরণ প্রথম থেকেই আমাদের কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছিল। ছাত্রীর মৃত্যুতে ওরা বিন্দুমাত্র সহানুভূতি পর্যন্ত দেখায়নি। এমনকী আমরা কতক্ষণে সমাপ্তির দেহ নিয়ে রওনা দেব সেই দিকেই তারা তাকিয়ে ছিল। পুলিসের তরফেও আমাদের সুইসাইড নোট সম্পর্কে কোনও কিছুই বলা হয়নি।
এদিকে, সামান্য রং মিস্ত্রির কাজ করা মৃতার বাবা সুকুমারবাবুর পক্ষে অর্থ খরচ করে কলকাতায় দৌড়ঝাঁপ করে মেয়ের মৃত্যুর কারণ জানাটা সম্ভব নয়। এবং আর্থিক অনটনের জেরে ঘরে চাল কেনার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই। একথা জানাজানি হতেই, এদিন সকালে অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসেন স্থানীয় শাসকদলের জনপ্রতিনিধিরা। শাসক দলের পক্ষ থেকে এদিন ওই পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় এক বস্তা চাল। এব্যাপারে কোতুলপুর পঞ্চায়েত সমিতির জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ওই অসহায় পরিবারের পাশে থেকে সব রকম আর্থিক সাহায্য আমাদের পক্ষ থেকে করা হবে। পাশাপাশি সমাপ্তির বাবা যদি চান, তবে তদন্তের জন্য কলকাতায় যাতায়াত সহ যাবতীয় খরচ করতে আমরা প্রস্তুত আছি। মন্ত্রী শ্যামলবাবু আমাদের এমনটাই বলেছেন।
মাটির ছোট একটা ঘরে দিনরাত বই পড়াতে ব্যস্ত থাকতেন সমাপ্তি। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, নিজের থেকেও বই বেশি ভালোবাসতেন তিনি। এদিনও সেই মাটির ঘরের দেওয়ালে চোখ রাখতেই দেখা যায়, সমাপ্তির নিজের হাতে সাজিয়ে রাখা পুরস্কার পাওয়া বইগুলি। যার মধ্যে রয়েছে, কপালকুণ্ডলা, পল্লিসমাজ, মাকড়সার জাল, ঠাকুরমার ঝুলি ইত্যাদি। মেধাবী ছাত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যু, মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না তাঁর প্রাক্তন স্কুলের শিক্ষকরাও।
তাজপুর রামচরণ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলেন, আচার-ব্যবহার পড়াশোনায় সমাপ্তির কোনওদিন কোনও ত্রুটি খুঁজে পাইনি। সেই মেয়েটির নার্সিং পড়তে গিয়ে এমন করুণ পরিণতি হতে পারে, এটা কল্পনাও করতে পারছি না। নার্সিং পাশ করতে পারলে চাকরি নিশ্চিত ছিল। এটা ভেবেই ও নার্সিং পড়তে গিয়েছিল।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক সৌরভ সিংহ রায় বলেন, গ্রামের ছেলে মেয়েরা যখন শহরে পড়তে যায়, তখন তাদের মধ্যে সামান্য হলেও একটা হীনমন্যতা কাজ করে। তারপর সহপাঠীরা ও সিনিয়ররা যদি চাপ দেয় তবে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। তাজপুর সহ পার্শ্ববর্তী গ্রামের গরিব পরিবারের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী অভিভাবকদের এই ঘটনার পর উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সন্তানদের শহরে পাঠানোর পথটা অনেকটাই কঠিন হয়ে গেল।