উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত সুগন্ধী ধানের ভাত তুলোর মতো নরম বলেই না কি তার নামকরণ হয় তুলাইপাঞ্জি। কেউ কেউ বলেন, তুলাই নামে এক নদীর তীরে ধানটি চাষ হতো। সেই থেকেই এই নামকরণ। তবে, শুধু গোবিন্দভোগ বা তুলাইপাঞ্জি নয়।
বাংলার সুগন্ধী ধানের তালিকায় রয়েছে বাদশাভোগ, কাটারিভোগ, রাধাতিলক, রাধুনিপাগল, দুধেশ্বর, হরিণখুরি, চিনিগুড়া, কালোজিরা, কালোনুনিয়া আরও কত কী। স্বাদে-গন্ধে একে-অপরকে টেক্কা দেয় তারা।
বাংলার এইসব সুগন্ধী ধান জড়িয়ে রয়েছে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গেও। একসময় ভালোই চাষ হতো। কিন্তু, উচ্চ ফলনশীল ধানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে ১৯৭০ সাল থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে দেশি সুগন্ধী ধানের এলাকা। হারিয়ে যায় অনেক ধান। সেসব ধানকে ফিরিয়ে আনতেই কাজ শুরু করেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে সঙ্গে নিয়ে গত ১০ বছর ধরে চলছে নিরলস প্রচেষ্টা। এতে অনেকটাই সাফল্য এসেছে। বাংলার লুপ্তপ্রায় বেশকিছু সুগন্ধী ধান আবারও ফিরেছে। উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগে বেড়েছে ফলন। ফলে চাষিরা আনন্দের সঙ্গেই সেসব ধান চাষ করছেন। এমনটাই দাবি বিজ্ঞানীদের। দেশি সুগন্ধী ধানের জাতগুলি মূলত আলোক সংবেদনশীল। ফুল আসা থেকে ধান পাকা পর্যন্ত অনেকটাই নির্ভর করে তাপমাত্রার উপর। সেক্ষেত্রে খুব বেশি গরম বা মারাত্মক ঠাণ্ডা, কোনওটাই উপযুক্ত নয়। সঙ্গে মাটির গুণ তো আছেই। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার সুগন্ধী ধান প্রকল্পের মুখ্য বিজ্ঞানী ড. মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ জানিয়েছেন, বর্তমানে খরিফ মরশুমে রাজ্যে ১ লক্ষ হেক্টর জমিতে সুগন্ধী ধান চাষ হয়ে থাকে। যা থেকে গড়ে ফলন পাওয়া যায় প্রায় ৩ লক্ষ টন। ৩০-৩৫ ধরনের সুগন্ধী ধান বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে কম-বেশি চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ৬-৭টি ধানের চাহিদা রয়েছে। সেসব ধানের ভালো বীজ উৎপাদন করে চাষের এলাকা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি উৎপাদিত চাল বিপণনের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। রাজ্য সরকারের কৃষি বিপণন নিগম ও সুফল বাংলা কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি সুগন্ধী ধান কিনছে। ফলে চাষিরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই উৎসাহিত হচ্ছেন তাঁরা। আর তাতেই সুগন্ধী ধান চাষের এলাকা বাড়ছে। বাংলার গোবিন্দভোগ রপ্তানি হচ্ছে দক্ষিণ ভারতে। তুলাইপাঞ্জি যাচ্ছে নেপাল, বাংলাদেশে।
প্রতিটি সুগন্ধী ধানের একটি নিজস্ব এলাকা রয়েছে। সেই এলাকার বাইরে গেলেই ফলন দিলেও সে সুবাস হারায়। ফলে বিজ্ঞানীরাও চাইছেন না, এক জায়গার ধানকে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে চাষ করাতে। বরং যে এলাকায় যে ধানটি চাষ হয়ে থাকে, সেখানেই কীভাবে তার উৎপাদন বাড়ানো যায় তারই প্রচেষ্টা চলছে। কোন সুগন্ধী ধানের জন্য খ্যাতি রয়েছে কোন এলাকার?
ছোট দানার সুগন্ধী, তুলাইপাঞ্জি, কালো নুনিয়া, কাটারিভোগ মূলত উত্তরবঙ্গের ধান। এর মধ্যে তুলাইপাঞ্জির আদি বাসভূমি রায়গঞ্জের মোহিনীগঞ্জ। কালো নুনিয়া চাষ হয় জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং জেলায়। কাটারিভোগ চাষ হয়ে থাকে মালদহ ও দক্ষিণ দিনাজপুরে। রাজ্যে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে গোবিন্দভোগ চাষ হয়। মূলত বর্ধমান, বীরভূম, নদীয়া জেলায় এই সুগন্ধী ধানটি চাষ হয়ে থাকে। রাধুনিপাগল বেশি চাষ হয় বীরভূম ও বাঁকুড়ায়। কিছুটা হয় বর্ধমান ও নদীয়ায়। গোবিন্দভোগ যে সব এলাকায় হয়ে থাকে, সেখানেই চাষ হয় বাদশাভোগ। তবে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পশ্চিম মেদিনীপুরেও এই সুগন্ধী চাষ করা হচ্ছে। রাধাতিলক ধানটি চাষ হয়ে থাকে নদীয়া, হুগলি ও হাওড়ায়। কালোজিরা ধানটি ছোট দানার। চাষ হয় মূলত দক্ষিণবঙ্গে। বাংলাদেশে এই ধানটি প্রচুর পরিমাণে চাষ হয়ে থাকে। রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে চাষ হয় লাল বাদশাভোগ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগর এলাকায় দীর্ঘদিন পর ফিরেছে হরিণখুরি ধান। দুধেশ্বর ধানটি চাষ হচ্ছে উত্তর ২৪ পরগনার সুন্দরবন অঞ্চলে। গোবিন্দভোগ, বাদশাভোগ ধানের চাল মূলত পায়েস ও ভোগ রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে গোবিন্দভোগের ধানের চিড়ে তৈরি করা হয়েছে। পোলাও হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এই ধানের চাল। তুলাইপাঞ্জি ব্যবহৃত হয় সুগন্ধী ভাত হিসেবে। ভোগ রান্নার পাশাপাশি তৈরি হয় পোলাও, বিরিয়ানি, চিড়ে। মাঝারি দানার কালো নুনিয়া ও কাটারিভোগ সুগন্ধী ভাত হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ড. মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের অক্টোবরে তুলাইপাঞ্জি ও গোবিন্দভোগ জিআই তকমা পেয়েছে। বিদেশে রপ্তানিতে এই জিআই লোগো অনেকটাই সুবিধা দেবে। রাজ্য যে এক্সপোর্ট পলিসি তৈরি করছে তাতে বাংলার সুগন্ধী ধানকে যুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।