গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
এই তো সেদিন, বড়দিনের বিকেলে চৌরাসিয়া ঝিমোচ্ছেন। পুজোয় পরা জামা-জিন্স গায়ে বান্ধবীর হাতে হাত মফস্সলের ভাই হাজির। একটু ঝুঁকে প্রশ্ন, ‘কাকু, এসবিআই কোথায়?’ চৌরাসিয়া চুপ। ‘কাকু, এসবিআই কোথায়?’ চৌরাসিয়া চুপ। বান্ধবীকণ্ঠ বলে ওঠে, ‘উনি হিন্দুস্তানি। হিন্দিতে বল।’ ফের, ‘এসবিআই কিধার হ্যায়?’ চৌরাসিয়ার মুখে রা নেই। আবার একই প্রশ্ন। এবার ঝাঁঝালো গলা উত্তর এল, ‘এসবিআই জিধার থা, উধারই হ্যায়।’ এই পাঞ্চলাইনে গোটা পার্ক স্ট্রিট মুহূর্তে চুপ। ফুটপাতে থমকে দাঁড়ায় স্লিপ অন শ্যু থেকে অ্যাঙ্কেল লেংথ বুট। পাঁচ আঙুলে নেইল আর্ট করা তন্বী ঢেকে নেয় হাসতে থাকা ঠোঁট। সবে টান দেওয়া সিগারেট-তরুণ কেশে ওঠে। চৌরাসিয়ারা এমন করলে ঠিকানাটা বলবে কে? কেন, যাদের দেখতে শহুরে! যাদের অবাক চোখ বহুতলের উপরে উঁকি মারে না!
বড়দিনের পরদিন। আবার সেই পার্ক স্ট্রিট। ভর দুপুরে গলায় মাফলার জড়িয়ে এক ব্যক্তির প্রশ্ন, ‘দাদা, জাদুঘর কীভাবে যাব?’ শহুরে তরুণের উত্তর, ‘সোজা গেলে পার্ক স্ট্রিট মেট্রো। সেখান থেকে ডান দিকে।’ বিশ্বাস হয় না ওই ব্যক্তির। মনে হয় এর আগে বার কয়েক এসেছেন কলকাতায়। তাই তাঁর চোখ বলে দিচ্ছে, ‘হু হু, বাওয়া! সহজে ঠকানো যাবে না।’ কাজেই ধেয়ে এল পাল্টা প্রশ্ন, ‘কেন এখান দিয়ে যাওয়ার রাস্তা নেই?’ শহুরে তরুণ এবার খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘বললাম তো, সোজা গিয়ে ডান দিকে।’ এবার মফস্সলিয় আবেগে সেই ব্যক্তির গলা নরম, ‘ঠিকাছে বাবা। জানি না বলেই তো জিজ্ঞেস করলাম।’ মাফলার ঝেড়ে উল্টো পথে হাঁটা শুরু। পিছনে তরুণের গজগজ, ‘কোথা থেকে যে সব চলে আসে...!’
দোকানি, পথচলতি মানুষে আস্থা না থাকলে ঠিকানা জানার বড় ভরসা পুলিস। তাই বড়দিনে পার্ক স্ট্রিটে ট্রাফিক পুলিসের কাছে মেট্রো স্টেশনের ঠিকানা জানতে গিয়েছিলেন এক দম্পতি। পুলিসবাবু হেসেই বললেন, ‘রাস্তা পেরতে হবে না। এই ফুটপাত ধরে এগলেই মেট্রো।’ সব শুনেটুনে দম্পতি রাস্তা পেরতে উদ্যত হলেন। পুলিসবাবু আবার বললেন, ‘এদিক দিয়েই যান।’ ‘হ্যাঁ ঠিক আছে’, বলে তাঁরা এগলেন নিজেদের পথে। পুলিসবাবু গাড়ি ডাকতে ডাকতে বললেন, ‘অদ্ভুত! না বললেও সমস্যা। আবার বললেও শুনবে না।’ নাজেহাল দশা ফুচকা-আইসক্রিমওয়ালাদেরও। তাঁরা অবশ্য রেগেও যান মাঝেমধ্যে। রাগবেন না-ই বা কেন? একদম সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ যদি জানতে চায়, ‘দাদা, সেন্ট পলসটা কোথায়?’ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন এক ফুচকাওয়ালা। ‘আরে কেয়া ইয়ার! ইধার তো বেঙ্গলি মে লিখা হ্যায়। ফির ভি পুছ রাহে হো!’
শুধু যে মফস্সল বা জেলা নয়, উৎসবের দিনে ঠিকানার খোঁজে নামে শহরের স্কুল-কলেজ টপকানো সদ্য প্রেমে পড়া কিংবা বন্ধুদলের সঙ্গে ভেসে যাওয়া ছেলে-মেয়েরাও। পথেঘাটে লোকজনকে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করাটা অবশ্য ওদের কাছে আউটডেটেড। ভরসা তাই গুগল ম্যাপ। গুগলবাবাজি ফেল করলে তবেই লজ্জার মাথা খেয়ে মানুষের কাছে যায় তারা। এই অবস্থাটা ঠিকানা বলা মানুষগুলি বেশ উপভোগই করেন। এমন ভাব নেন যে, ‘সেই আমাদের কাছইে আসতে হল।’ আবার এই মানুষ-গুগল সকলের ঊর্ধ্বে সমস্ত দলে থাকে একজন ‘রাস্তাজান্তা’। পুজো হোক কিংবা বড়দিন—সে নিজেই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের অ্যাডমিন। নিজেই রুট বানায়। তারপর হঠাত্ দেখা যায়, বউবাজারে গলির ভিতরে দলের মধ্যে তুমুল বচসা। শিয়ালদহ যাওয়ার রাস্তা গুলিয়েছে। ‘রাস্তাজান্তা’র তখন ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাড়ি যাই হাল।
ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে সুকুমার রায়ের ‘ঠিকানা’ মনে পড়ে যায় বারবার। ‘ঠিকানা চাও? বলছি শোন; আমড়াতলার মোড়ে/ তিন–মুখো তিন রাস্তা গেছে, তারই একটা ধ’রে/ চলবে সিধে নাকবরাবর, ডানদিকে চোখ রেখে,/ চলতে চলতে দেখবে শেষে রাস্তা গেছে বেঁকে;/ দেখবে সেথায় ডাইনে বাঁয়ে পথ গিয়েছে কত,/ তারই ভিতর ঘুরবে খানিক গোলোকধাঁধার মতো।’ শহরের এই গোলকধাঁধায় কমবেশি সকলেই পড়েছেন। আর কেউ দেবদূতের মতো আবির্ভূত হয়ে পথ বলে দিয়েছেন। কেউ আবার অজান্তেই হয়ে উঠেছেন রাস্তা এক্সপার্ট। বাড়ির নম্বর বললেই নেতাজির জন্মসাল মনে করার মতো আকাশে চোখ তুলে নিমেষে তাঁরা বাতলে দেন ঠিকানা। বদলাতে থাকা শহরটা আজ রাক্ষসের পেটের মতো। ক্রমশ রবারের মাফিক বড় হচ্ছে। কতদূর সীমানা শহরের? কতদূর পর্যন্ত ছোটে উত্সবের আলো? মাঝে মধ্যে হাঁপিয়ে ওঠা শহরটাই বলে ওঠে, ‘তার পর যাও যেথায় খুশি, জ্বালিয়ো নাকো মোরে!’