জলপথ পরিবহণ কর্মে বিশেষ শুভ। হস্তশিল্পী, হিসাব-শাস্ত্রবিদ প্রমুখের কর্মে উন্নতি ও সুনাম। মানসিক অস্থিরতা থাকবে। ... বিশদ
চলেছি ঊনকোটি। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ। যার অধিকাংশই পাকদণ্ডী। তেলিয়ামুড়া আর আঠারোমুড়ায় পাহাড়ি পাক মনে রাখার মতো। একদিকে শাল, সেগুনের মতো চিরহরিৎ গাছের ব্যাপ্তি। উল্টোদিকে পাহাড়ি খাদ। পথ মধ্যে দেখা হয়ে গেল খোয়াই নদীর সঙ্গে। মাঝে কুমারঘাটে লাঞ্চ ব্রেকের পর পুনরায় যাত্রা। বাংলাদেশ সীমান্তস্থিত কৈলাশহর ঢুকতেই চোখ জুড়ানো চা বাগানের বিস্তৃতি নজর কাড়ে। ক্রমশ নির্জন হতে থাকে পাহাড়ি পথ। হঠাৎ কোনও নোটিস ছাড়াই অনুচ্চ এক পাহাড়ি টেবলল্যান্ডে গাড়িটা এসে দাঁড়ায়। সামনেই বোর্ড শৈবতীর্থ ঊনকোটি। পাহাড় প্রান্ত থেকে একটা পাথুরে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে অনেক নীচে, ঘন জঙ্গলের বুকে। ছোট্ট একটা ঝরনা নেমে এসেছে পাহাড়ের চূড়া থেকে। সেই জল পাথরের মাঝখানে সৃষ্টি করেছে কুণ্ড। সব মিলিয়ে পাহাড়, ঝরনা আর সবুজ বনানী ঘেরা ঊনকোটির পরিবেশ লা-জবাব। উত্তর ত্রিপুরার এই রঘুনন্দন পাহাড়েই কোটি থেকে এক কম দেবতার বাস। তাই ঊনকোটি। হিন্দুদের এক পবিত্রতম তীর্থক্ষেত্র। নানা কিংবদন্তি জড়িয়ে রয়েছে এই অঞ্চলকে ঘিরে। প্রথম লোককথায়, শিবভক্ত কালু কামার এক রাতে এক কোটি মূর্তি তৈরির সংকল্প নিয়ে ঊনকোটিতে আটকে যায়। আসলে স্বয়ং মহাদেবের অঙ্গুলিহেলনেই এইসব ঘটে। অন্য গল্পে দেখি, মহাদেবের তত্ত্বাবধানে দেবতাদের বারাণসী যাত্রা ঠিকঠাক চললেও পথমধ্যে ঘটে বিপত্তি। রঘুনন্দন পাহাড়ে রাতবাসের পর ঊষাকালে পুনর্যাত্রায় অপারগ ঊনকোটি দেবতাই মহেশ্বরের অভিশাপে পাষাণে পরিণত হয়। উভয় ক্ষেত্রেই নবকাশীধামের সার্টিফিকেট মেলে না রঘুনন্দন পাহাড়ের। এখানে চোখ মেললেই দেখা যায় ঘন সবুজ এলাকা জুড়ে পাথরে পাথরে খোদাই করা দেবতাদের মূর্তি। যা পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে, ধাপে ধাপে বিরাজমান। জঙ্গলের পরিবেশে পায়ে হাঁটা পথে চড়াই উতরাইয়ে দেখে নিতে হবে এই মূর্তিগুলো। সিঁড়ির একটা করে ধাপ পেরলেই উল্টে যায় ইতিহাসের পাতা। সপ্তম থেকে নবম শতকের এই সমস্ত কারুকাজ পুরাণের গল্প বলে। মনে করা হয়, পাল সাম্রাজ্যের সময় তৈরি হয়েছিল এই ঊনকোটি। মজার কথা, এই অবয়বগুলোয় চিরাচরিত হিন্দু মূর্তির মতো সবক্ষেত্রে ঠিকঠাক ব্যাকরণ মেনে তৈরি নয়। এই পাহাড়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের সহাবস্থানও বিস্ময়কর। ঊনকোটিতে খোদাই করা দেবদেবীর মূর্তিগুলিতে লোকায়ত জীবনযাত্রার সহজ সরল রূপমাধুরীর প্রকাশ লক্ষণীয়। এখানে মূর্তিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য জটাধারী শিব ও ৩০ ফুট উঁচু ঊনকোটিশ্বর কালভৈরব। এছাড়া আছে গণেশ, দুর্গা, বিষ্ণু, রাম, রাবণ, হনুমান, নন্দী ও বহু বুদ্ধ মূর্তি।
পাহাড় কেটে তৈরি দেবাদিদেবের বিশাল স্থাপত্যের সামনে দাঁড়ালে চোখ আটকে যায়। মুগ্ধতায় যেখানে একমাত্র অনুভূতি এনে দেয়। ঊনকোটির প্রধান আকর্ষণ গণেশ কুণ্ড। যে কুণ্ডের সামনের দেওয়ালে খোদাই করা আছে তিনটি গণেশ মূর্তি। এদের ডানপাশে রয়েছে চতুর্ভুজ মূর্তি। এক পাহাড়ি চাতালের আচ্ছাদিত স্থানে দেখি সিঁদুরচর্চিত ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের মিলিত প্রস্তরমূর্তি। তার সামনে এক সাধুবাবা ধ্যানমগ্ন। আরও কিছুটা উপরে উঠে পাহাড়ের মাথায় দেখি, টিনের শেডের ঘর বানিয়ে পুরাতত্ত্ব বিভাগ বেশকিছু মূর্তি সংরক্ষণ করেছে। তবে ঘরের বাইরেও বহু মূর্তি এলোমেলো ছড়ানো। সবকিছু দেখেশুনে মনে হল, ঊনকোটি অনেকটা ওপেন এয়ার আর্ট গ্যালারির মতো। তবে প্রশ্ন হল, সত্যি কি ঊনকোটিটা দেবদেবীর মূর্তি আছে এখানে! কে গুনতে গেছে? রকমসকম দেখে মনে হয় এ যেন পাহাড়ি কুমোরটুলি। কিছু ঠাকুর গড়া হয়েছে, কিছু আবার অর্ধাংশ গড়া। তবে হাজার বছরের প্রাকৃতিক ঝাপটা সয়ে আজ ঊনকোটির স্থাপত্য প্রায় ধ্বংসের মুখে। অধিকাংশ মূর্তি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এলোমেলো পাথর আর মাটির নীচে ডুবে থাকা দেবদেবীর মূর্তি জানান দেয়, স্তূপের গর্ভে অনেক কিছুই লুকিয়ে আছে, খুঁজে বের করার অপেক্ষায়। অরণ্যঘেরা পাহাড়ের কোলে কোটি না হোক, কয়েকশো মূর্তি দেখেই মুগ্ধ হলাম। এবার মন কেড়ে নেওয়া ঊনকোটি ছেড়ে ফিরতে হবে।
কীভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে আগরতলা পৌঁছে, গাড়ি ভাড়া করে চলে যেতে পারেন ঊনকোটি। আগরতলা থেকে ট্রেন পথে কুমারঘাট বা ধর্মনগর পৌঁছে গাড়ি ভাড়া করেও ঊনকোটি যেতে পারেন। এখানে রাতবাস করতে পারেন ১০ কিলোমিটার দূরে কৈলাশহরে অথবা চলে আসতে হবে, ১৭ কিলোমিটার দূরে ধর্মনগড়ে। ত্রিপুরা পর্যটনের ঊনকোটি ট্যুরিস্ট লজ রয়েছে কৈলাশহরে।