কর্মপ্রার্থীদের নতুন কর্ম সংস্থানের সুযোগ আছে। সরকারি বা আধাসরকারি ক্ষেত্রে কর্ম পাওয়ার সুযোগ আছে। ব্যর্থ ... বিশদ
কেয়াদিকে দেখতাম কী প্রচণ্ড প্রাণশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন সব ধরনের কাজে। সমস্ত বিষয়কেই নিতেন সিরিয়াসলি, কোনওদিন কোনও কাজে আলগাভাব দেখিনি। সেই সময় একদিন দলের জেনারেল মিটিং চলছে, তর্ক-বিতর্ক সেখানে। অজিতদা (অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়) সহ দলের বাকিরা এক কথা বলছেন কেয়াদি অন্য কথা। নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্যে সেই মিটিং অ্যাডজরনড্ হল। পরেরদিন দেখি কেয়াদি মিটিংয়ে আসছেন রিকশয় করে। রিকশ ভর্তি বই। তাঁর যুক্তি যে অকাট্য তার রেফারেন্স হিসাবে এই বইগুলি নিয়ে এসেছেন এবং সেই মিটিংয়ে প্রমাণ করলেন তাঁর যুক্তি অকাট্য। সবাই মানলেন বা মানতে বাধ্য হলেন।
‘নটী বিনোদিনী’ তখন করছেন মঞ্জুদি (ভট্টাচার্য) যদিও পরে মঞ্জুদি নান্দীকার ছেড়ে যাওয়ার পর কেয়াদিই এই চরিত্রটি করতেন। যেদিনের কথা বলছি, কেয়াদি তখন এ নাটকে অভিনয় করতেন না। তখন মঞ্জুদিই করতেন। কিন্তু কেয়াদি সর্বক্ষণ সাহায্য করছেন মঞ্জুদিকে। সুন্দর করে চুল বেঁধে দিয়ে বা পোশাক ঠিকমতো পরিয়ে বা স্টেজে ঢোকার আগে রিক্যুইজিশন এগিয়ে দিয়ে। কেয়াদির থেকেই শেখা, থিয়েটারের কোনও কাজই ছোট নয়। সেই কাজটিও আনন্দের সঙ্গেই করতে হয়, দরদ দিয়ে।
পরবর্তীকালে কেয়াদিকে দেখেছি ডবল শো (তিনটে ও সাড়ে ছ’টা) করে একটুও ক্লান্ত না হয়ে পরের দিনের অ্যাডভার্টাইজের ম্যাটার করছেন রঙ্গনার সিঁড়িতে বসে কিশোর সুধাংশুকে সঙ্গে নিয়ে। প্রধান অভিনেত্রী ছাড়াও দলের বিজ্ঞাপনের কাজটিও তিনি দেখতেন, কারণ দল এই দায়িত্বটি তাঁকেই দিয়েছিল।
থিয়েটার নিয়ে কেয়াদি কতটা সিরিয়াস ছিলেন কয়েকটা ঘটনার কথা বলে তার উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করব।
তখন নান্দীকারে ‘ভালোমানুষ’ নাটকের মহলা শুরু হয়েছে। নান্দীকারের ওই ছোট্ট ঘরে বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী শম্ভু ভট্টাচার্য আট ঘোড়ার নাচের মহলা দিতেন। কেয়াদিকে ভালোমানুষ নাটকে দুটি চরিত্রে অভিনয় করতে হতো। শান্তা ও শান্তাপ্রসাদ। একজন মহিলা ও অপরজন পুরুষ। পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করতে হলে তার হাঁটা, চলা, কথাবলার ধরন একদম আলাদা করতে হবে। কেয়াদি তখন শাড়ির সঙ্গে বুটজুতো পরতে শুরু করলেন। ওইভাবেই তিনি কলেজে পড়াতেও যেতেন। যাতে স্টেজে হাঁটাচলা করার সময়ে জড়তা না থাকে। আর সেই সময়ে উনি খৈনি খাওয়াও শুরু করলেন। স্টেজে তামাক খেতে হবে যে! নান্দীকারের রাধুদা (রাধারমন তপাদার) খৈনি খেতেন। তাঁর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে খৈনি নিতেন কেয়াদি। এমনই ছিলেন কেয়াদি। থিয়েটার নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস। নান্দীকারের জন্য সব করতে পারতেন।
কেয়াদির মায়ের (লাবণ্য চক্রবর্তী) প্রথম পেসমেকারটি বসবে যেদিন সেদিনই রঙ্গনায় ‘ভালোমানুষ’-এর ডবল শো। এই নাটকে তিনি দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেন। এক পুরুষ এবং এক নারীর চরিত্রে। শান্তা ও শান্তাপ্রসাদ। কেয়াদি হন্তদন্ত হয়ে এলেন রঙ্গনায়। মায়ের অপারেশনের পর। বিধ্বস্ত কেয়াদি হলে ঢুকলেন আর প্রথম বেল বাজল নাটকের। মুহূর্তের মধ্যে কেয়াদি পাল্টে গেলেন। মেকআপ ও ড্রেস পরে কেয়াদি শান্তা ও শান্তাপ্রসাদ হয়ে গেলেন। একেই বোধহয় বলে নিষ্ঠা। এই নিষ্ঠা অভাবিত। অথচ সেই কাজটিই করলেন কত সহজে কত মসৃণভাবে। কয়েক মিনিট বাদে পর্দা উঠল। কেয়াদি হয়ে গেলেন শান্তা।
কেয়াদি ভালোবাসতে জানতেন। ভালোবেসে সবাইকে টেনে নিতেন অন্তরের অন্তঃস্থলে। আমাদের মতো জুনিয়রদের আগলে রাখতেন বড়দির মতো। আমাদের কেউ বকলে তিনি লড়ে যেতেন আমাদের হয়ে। আমরা তখন নির্বাক, মুখে কোনও কথা নেই। আমাদের হয়ে দাদাদের ভৎর্সনা করতে এতটুকু দেরি করতেন না।
শুধু আমাদের জন্যই না পথশিশুদের জন্য তাঁর আবেগ ছিল দেখার মতো। কত শিশুকে যে পড়ার ব্যবস্থা করেছেন, তাদের যতটা সম্ভব আদর দিয়েছেন, সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও।
ভালো মানুষ না হলে বোধহয় ঠিকঠাক ভালো থিয়েটার করা যায় না, এরকমই ভাবতেন কেয়াদি। কেয়াদি শিখিয়েছিলেন, ভালো মানুষ হবে। আজও এই বয়সে এসেও সেই কথা মনে হয়, হয়তো কোথাও একটা চেষ্টাও থেকে যায় ভালো মানুষ হবার।
আমার চোখে কেয়াদি ছিলেন এক সম্পূর্ণা মানবী। ৫ আগস্ট তাঁর জন্মদিন। তাঁকে শতকোটি প্রণাম। তিনি ভালো থাকুন, যে লোকেই থাকুন না কেন।