কর্মে বাধা থাকলেও অগ্রগতি হবে। ব্যবসায় লাভ হবে সর্বাধিক। অর্থাগম যোগটি শুভ। কর্মক্ষেত্রে এবং রাজনীতিতে ... বিশদ
‘দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী মহিষাসুরমর্দিনী জয় মা দুর্গে’
কয়েকদিন আগেই দেবী পক্ষের সূচনা হয়ে গিয়েছে। নারীশক্তির সঞ্চার ঘটেছে। আর সেই শক্তির প্রতীক দেবী দুর্গা। তাঁর মহিষাসুরমর্দিনী রূপের কথা সর্বজনবিদিত। তিনি অসুরবিনাশিনী। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন তিনি। পুরাকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত নারীশক্তির প্রতীক তাই দেবী দুর্গা। তিনি বিভিন্ন রূপে প্রকট হয়ে অসুরের সঙ্গে লড়াই করেছেন। কখনও ছলনার সাহায্য নিয়েছেন, কখনও বা আড়াল থেকে শক্তির প্রদর্শন করেছেন। এবং শেষ পর্যন্ত অসুর বিনাশ করতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁর এই বিভিন্ন রূপই আজকের নারীর মধ্যে প্রকট। তাই তিনিই নারীশক্তির আধার। পুরাণে বর্ণিত দেবী দুর্গার শক্তি রূপের কথাই আজও মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করে। এবং সমাজে সমগ্রভাবে নারীর উন্নতি সাধনের ক্ষেত্রেও তাঁর শক্তিদায়িনী রূপই বিশেষভাবে প্রকট হয়ে ওঠে।
অসুরবিনাশিনী আজকের নারী
না। আজকের দুর্গারা কেউ সিংহবাহিনী নন, কিন্তু অসুরবিনাশিনী তাঁরা সর্বক্ষেত্রে। তাঁরা মল্লিকা সেনগুপ্তর কবিতা ‘আমার দুর্গার’ ছত্রে ছত্রে নিজেদের খুঁজে পান। সেই দুর্গা সোরেন যার অক্ষর জ্ঞান নেই তাই তাকে বিভিন্ন কাজ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। সেই দুর্গা সোরেন যাকে অঙ্ক শেখানোর ছলে মাস্টার তার গায়ে হাত দেন অবলীলায়। সেই দুর্গা সোরেন যাকে এমন নানা অঙ্কের মাস্টারের হেনস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় প্রতিনিয়ত। সেই দুর্গা সোরেন যে গ্রামের অন্ধকার কানা গলিতে জীবনযাপন করতে করতেও কল্পনা চাওলা হয়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সে কি জানে আকাশ ছোঁয়ার পরেও তাঁকে সমাজের বহু কটাক্ষ সামলাতে হবে, আকাশ ছুঁলেও সমাজের চোখরাঙানি তার পিছু ছাড়বে না? তবু আজকের দুর্গারা নিজেদের প্রমাণ করে চলেছে অক্লান্তভাবে। সমাজে নিজেদের জায়গা করে নিতে তারা মরিয়া। নানা সময় বিভিন্ন রূপে আজকের দুর্গারা নিজেদের দক্ষতার, কর্মক্ষমতার প্রমাণ দিয়েই চলেছে নিরন্তর। তাই তো দেবী দুর্গা আজও নারীশক্তির প্রতীক রূপে মর্তে অবতীর্ণ হন।
নানা রূপধারিণী
দেবী বিভিন্ন সময় নানা রূপে অসুরের মুখোমুখি হয়েছেন। অসুরের সঙ্গে লড়াই করার জন্য তিনি কখনও কালী, কখনও চামুণ্ডা, কখনও কাত্যায়নী রূপ ধারণ করেছেন। আর আজও মেয়েরা সমাজে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার লড়াইয়ে বিভিন্ন রূপে অবতীর্ণ হয়। এবং এই প্রতিটি রূপেই তাঁরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। একটি নারী সমাজে বিভিন্ন ধরনের কাজে নিজেকে নিযুক্ত করে। একই সঙ্গে তাঁরা কন্যা, জায়া এবং জননী। আবার এখনকার সমাজে তাঁরা ঘরে বাইরে একইরকম পারদর্শিতার সঙ্গে কাজ করে চলেছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আজকের মেয়েদের চরিত্রের সঙ্গে দেবী দুর্গার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মেয়েদের এই বিভিন্ন রূপে নিজেদের তুলে ধরার যে ক্ষমতা তা কিন্তু আমাদের সমাজে সে অর্থে আদৃত হয়ে ওঠেনি। বরং তাঁদের ব্যবহারের সামান্যতম ত্রুটি ঘটলে সেদিকে আঙুল তুলে দেখানো হয়। পুরুষতন্ত্রের এই এক ভীষণ দোষ।
এই প্রসঙ্গে ৩৫ বছর বয়সি অর্চনা নন্দী জানালেন, বিয়ের পর অসুস্থ শাশুড়ির দেখভালের জন্য চাকরি ছেড়ে দিতে তিনি দ্বিধা করেননি। শাশুড়ি মারা গেলে আবারও চাকরিতে যোগ দিতে চাইলে স্বামীর কাছেই বাধাপ্রাপ্ত হন। তিনি বাইরে বেরলে ঘরের অযত্ন হবে এমনই ছিল অজুহাত। একরকম জেদের বসেই আবারও স্বনির্ভর হয়ে ওঠেন অর্চনা। এখনও কিন্তু সাংসারিক দায়িত্বে পান থেকে চুন খসলে কথা শুনতে হয় তাঁকে। মেয়েদের দিকে খুব সহজেই আঙুল তোলে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, বললেন অর্চনা।
শক্তিদায়িনী রূপে নারী
মেয়েদের শক্তিদায়িনী রূপ বিষয়ে পুরোহিত অনন্ত শাস্ত্রী মহাশয় বললেন, ‘দেবী দুর্গার মতোই এযুগের মেয়েরাও যেন একেকজন শক্তির আধার। তাঁদের মধ্যে দিয়েই দেবীর শুভশক্তি তিনি সংসারে সঞ্চারিত করেছেন। দেবী দুর্গা শুধুই যে অসুর দমন করেছেন, বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন তা তো নয়, তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজের মানসিক শক্তিরও প্রকাশ করেন। নারী শক্তির অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক তাদের এই মানসিক শক্তি। একাধারে ঘরের যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য এক অসম্ভব মানসিক জোরের প্রয়োজন হয়, বললেন অনন্ত শাস্ত্রী।
তাঁর কথায়, মেয়েরা একটা বয়স পর্যন্ত বাপের বাড়িতে বড় হওয়ার পর সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে, অচেনা লোকেদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। এটাও তাদের ওই প্রচণ্ড মানসিক শক্তিরই প্রকাশ।
অথচ আমাদের সমাজ নারীর এই মানসিক শক্তির কদর করতে শেখেনি এখনও। তাই তো গৃহবধূকে আজও অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে দিনযাপন করতে হয়।
শক্তির বিশেষ প্রদর্শন
বিভিন্ন দেবতার শ্রেষ্ঠ গুণ নিয়ে তৈরি হয়েছেন দেবী দুর্গা। তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের শ্রেষ্ঠ শক্তির প্রদর্শন করেন। সবাইকে নিয়ে চলার ক্ষমতা তাই দেবী দুর্গার মধ্যে অপরিসীম। দেবী শক্তির সেই গুণ আজকের মেয়েদের শক্তির রূপ হিসেবে বিশেষভাবে প্রকট। আজকের নারী অন্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গুণটি বুঝে তা নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে। এবং সেই আত্মস্থ করার ক্ষমতাই তার শক্তির অন্যতম অঙ্গ। আজকের মেয়েদের মধ্যে শেখার বাসনা প্রবল। আর সেই শেখার ইচ্ছাই তাদের শক্তির রূপ হিসেবে প্রদর্শিত হয়। তাই নারী যদি এমন সমাজে থাকার সুযোগ পায় যেখানে তার গুণের সঠিক কদর করা সম্ভব তাহলে তার শক্তির প্রদর্শন এক অন্য পর্যায়ে পৌঁছতে পারবে। এবং তাতেই সমগ্র সমাজের উন্নতিসাধন হবে বলে মনে করেন পুরোহিত মশাই।
একই অঙ্গে এত রূপ
শক্তির নানা রূপ নারীর মধ্যে বিরাজমান। একাধারে নারী স্নেহ বর্ষণ করেন, মমতা ও লালিত্য দিয়ে পালন করেন, আবার নিজের মর্যাদা পাওয়ার জন্য লড়াই করেন। নিজের অস্তিত্ব বুঝিয়ে দিতে পিছপা হন না। বরং সমাজে নিজের অস্তিত্ব প্রদর্শন করার জন্য পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে একাই লড়াই করেন। নারীর এহেন রূপ যেন দেবী দুর্গার নব রূপের সমান। দেবী বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে নারীর মাধ্যমে নিজের শক্তির সঞ্চার ঘটান। তাঁর দশ হাতে দশটি মুদ্রা প্রদর্শিত হয়। তার মধ্যে আশীর্বাদের মুদ্রাও আমরা দেখতে পাই। মা দুর্গা আমাদের অভয় দেন, এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগান। তাঁর পথেই আমরা মেয়েরাও প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলি নিজেদের লক্ষ্যের দিকে।
নারীর এই যে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের পথ এগিয়ে চলা, যুগে যুগে এর প্রচুর বিবর্তন ঘটেছে। একটা সময় ছিল যখন নারী শুধুই ঘরে থাকতেন। বাড়ির যাবতীয় দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়াও কিন্তু সেই দায়িত্ব সামলাতে এতটুকু ভয় পাননি তাঁরা। সন্তান পালনের গুরুদায়িত্ব তুলে নিয়েছেন স্বেচ্ছায়। কিন্তু সমাজ তাঁকে সঠিক মর্যাদা দিতে পারেনি। সেই মর্যাদা তাঁকে লড়াইয়ের মাধ্যমে জয় করতে হয়েছে। এখন মেয়েরা ঘরে বাইরে সমান পারদর্শী। এবং এই পারদর্শিতা তাঁদের প্রমাণ করতে হয় প্রতি মুহূর্তে। মেয়েরা নিজেদের প্রমাণ করতে ভয় পান না। তাঁদের শক্তির প্রদর্শন করতে পিছিয়ে যান না। তবু সমাজের বাঁকা চাউনি যেন নারীকে তাড়া করে ফেরে।
অভয়দায়িনী রূপ
হিন্দু শাস্ত্র মতে দেবী দুর্গা শক্তির প্রতীক। সংস্কৃত ভাষা অনুযায়ী ‘শক্ত’ শব্দটির উৎপত্তি ‘শাক’ ধাতু থেকে। যার অর্থ ‘পারদর্শিতা’। এই যে পারদর্শিতা তা সবচেয়ে বেশি প্রকট নারী চরিত্রে। একই সঙ্গে বিভিন্ন রূপে মেয়েরা নিজেদের মেলে ধরতে সক্ষম। তাঁরা কন্যা, জায়া এবং জননী তো বটেই, তাছাড়াও তাঁদের চরিত্রে জেদ, রাগ, ভালোবাসা, স্নেহ সমানভাবে বর্তমান। এহেন নারীর তবু সামাজিক স্বীকৃতির জন্য লড়াই করে যেতে হয়। পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঘরে বাইরে সমস্ত দায়িত্ব সামলানোর পরেও নিজের দক্ষতা ও ক্ষমতা প্রমাণ করতে হয়। শক্তির প্রতীক রূপে আমরা মায়ের আরাধনা করি। অথচ তাঁর শক্তির প্রদর্শন হয় যে নারীর মাধ্যমে তাঁরই এত লাঞ্ছনা, এত অবমাননা! নিজের ক্ষমতার আর কত প্রমাণ দেবে মেয়েরা?