শাস্ত্র অধ্যয়নে গতি বৃদ্ধি ও পরীক্ষায় শুভ ফল লাভের সম্ভাবনা। নতুন কর্মপ্রাপ্তি হতে পারে। দাম্পত্যে ... বিশদ
কামক্রোধোদ্ভবং বেগং যুক্তঃ স সুখী নরঃ।।
—‘যিনি ইহজীবনেই, শরীরত্যাগের আগে, কাম ও ক্রোধ থেকে উদ্ভূত বেগ প্রতিরোধ করতে পারেন, সেই পুরুষ অথবা নারীই যোগী, তিনিই সুখী।’
এটি অসাধারণ শ্লোক। শকনোতি, ‘যিনি সক্ষম’; ইহৈব, ‘ইহজন্মে’, এই শরীরেই, কোন সুদূর স্বর্গে নয়; সোঢ়ুং, ‘সহ্য করতে।’ কী সহ্য করবেন? বেগম্, ‘প্রচণ্ড স্রোতের বেগ’। কী ধরনের স্রোত? কামক্রোধোদ্ভবং ‘কাম ও ক্রোধ হতে উদ্ভূত’, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়-তৃষ্ণা এবং ক্রোধ। এইগুলির এমন প্রবল শক্তি যা আপনাকে ধরাশায়ী করতে পারে, আপনার সমগ্র জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে। এই হচ্ছে এই স্রোতের প্রকৃতি। অতএব, ‘যাঁরা, ইহজীবনেই, শরীর-ত্যাগের আগে, কাম ও ক্রোধের প্রচণ্ড বেগ সহ্য করতে পারেন বা ধারণ করতে পারেন’, শকনোতি ইহৈব যঃ সোঢ়ুং প্রাক্ শরীরবিমোক্ষণাৎ। মৃত্যুর পর আর কিছুই করা সম্ভব নয়। কেবল মৃত্যুর পূর্বেই এটি করা যায়। প্রাক্ অর্থাৎ ‘পূর্ব’। শরীরবিমোক্ষণ অর্থাৎ ‘শরীরত্যাগ’। গীতা চাইছেন, আমরা সকলেই যেন আমাদের নিজের নিজের সুপ্ত সম্ভাবনাগুলিকে বিকশিত করে মুক্ত হয়ে যাই, আমরা যেন আমাদের ভিতরকার বিক্ষেপকারী নানা তরঙ্গের বেগকে প্রতিহত করতে শিখি। তাতে কী লাভ হবে? স যুক্তঃ, ‘সেই নারী অথবা পুরুষ হচ্ছেন যোগী’; স সুখী নরঃ, ‘তিনি সুখী মানব।’ যদি সুখী হতে চান, তবে এইসব বেগ প্রতিরোধ করার শক্তিটি আপনাকে অর্জন করতে হবে। কাম ও ক্রোধের এই তরঙ্গগুলি আমাদের চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করে, আমাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন শক্তিগুলির ক্রীতদাস বানিয়ে ছাড়ে। তখন আর আমাদের মুক্তি কোথায়? সুখই বা কোথায়? ‘অন্তর শান্ত না হলে সুখ কোথায়?’, গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলেছিলেন, অশান্তস্য কুতঃ সুখম্? ‘অশান্ত ব্যক্তির সুখ কোথায়?’ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অরণ্যের বনস্পতির মতো নিত্য দোদুল্যমান যে মন, যে মনরূপ বনস্পতি ইতিউতি উৎপাটিত হচ্ছে, সেই অশান্ত মনে সুখ কোথায়? এই ধরনের মনুষ্যজীবন কী দুর্ভাগ্যজনক! কিন্তু এমনও বৃক্ষ আছে, যার শিকড় অত্যন্ত শত ও গভীর; বায়ু বেগে বইলেও সে ঠিক দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু যে বৃক্ষের শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করেনি, তা অচিরেই ধরাশায়ী হয়। অতএব, অন্তরে নিহিত সত্যের ওপর দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। যাঁদের জীবন এইভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাঁরা স্থির ও শক্তিমান, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তাঁরা সম্পূর্ণরূপে শান্ত ও অচঞ্চল।
স্বামী রঙ্গনাথানন্দের ‘ভগবদ্গীতা ও বিশ্বজনীনবার্তা’ (২য় খণ্ড) থেকে