আচার্য স্বামী বিবেকানন্দ-প্রবর্তিত নর-নারায়ণ-সেবা কর্মযোগ-সাধনার এক অভিনব প্রণালী। নরকে নারায়ণজ্ঞানে সেবার অর্থ-নরের স্থূল সূক্ষ্ম বা কারণ দেহকে নারায়ণজ্ঞানে সেবা নয়, নরের মধ্যে যে আত্মরূপী নারায়ণ আছেন, তাঁহারই সেবা। ইহা বেদান্তবেদ্য আত্মার উপাসনারই একটি সহজ পদ্ধতি। হিন্দুর সাকার নিরাকার এবং সহুণ নির্গুণ সাধনা, জ্ঞানযোগ রাজযোগ কর্মযোগ ও ভক্তিযোগ মূলতঃ আত্মার উপাসনারই এক একটি পথ। “আত্মা ভূতে ভূতে বিভক্তের ন্যায় প্রতীয়মান হইলেও তিনি অবিভক্ত।” এক নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মা সকল মানুষের মধ্যে সমভাবে বিরাজিত। আত্মার দিক দিয়া সকল নরনারী এক ও অভিন্ন। সকলে একই আত্মার বহুরূপ। মানুষে মানুষে যে ভেদ-বৈষম্য দেখা যায়, ইহা আধারভেদে আত্মার শক্তি-প্রকাশের তারতম্য-জনিত। কাজেই আমার মধ্যে যে আত্মা আছেন তিনিই সকল নরনারীর মধ্যে বিদ্যমান, এই জ্ঞানে তাঁহাদের সেবা করার নামই নর-নারায়ণ-সেবা। ইহা ঈশ্বর লাভের একটি পথ। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলিয়াছেন, “সর্বভূতে হরির সেবা—জীব জন্তুর মধ্যেও হরির সেবা যদি কেউ করে, আর যদি সে মান চায় না, যশ চায় না, মরবার পর স্বর্গ চায় না, যাদের সেবা করছে, তাদের কাছ থেকে উলটে কোনও উপকার চায় না, এরূপ ভাবে যদি সেবা করে, তা হলে তার যথার্থ নিষ্কাম কর্ম, অনাসক্ত কর্ম করা হয়। এইরূপ নিষ্কাম কর্ম করলে তার নিজের কল্যাণ হয়। এরই নাম কর্মযোগ। এই কর্মযোগও ঈশ্বর লাভের একটি পথ।” তিনি অন্যত্র বলিয়াছেন, “তিনি মানুষ হয়েও লীলা করছেন। আমি দেখি, সাক্ষাৎ নারায়ণ। কাঠ ঘষতে ঘষতে যেমন আগুন বেরোয়, ভক্তির জোর থাকলে মানুষেতেই ঈশ্বর দর্শন হয়।”
“এমন আছে যে শালগ্রাম হতেও বড় মানুষ। নর-নারায়ণ।” “প্রতিমায় তাঁর আবির্ভাব হয় আর মানুষে হবে না?”
হিন্দুগণ প্রতিমায় ঘটে পটে আত্মাকে আরোপ করিয়া তাঁহারই পূজা করে। ইহা যদি সম্ভব হয়, তাহা হইলে জীবশ্রেষ্ঠ মানুষে তাহা সম্ভব হইবে না কেন? গীতা বলেন, “একটি দেহ বা প্রতিমাতে আত্মা আছেন মনে করা তামসিক জ্ঞান।” “যে জ্ঞানদ্বারা সর্বভূতে এক অবিভক্ত আত্মবস্তু দৃষ্ট হয়, সেই অদ্বৈত আত্মদর্শনরূপ সম্যক্ জ্ঞানই সাত্ত্বিক জ্ঞান।” হিন্দুর অবতারবাদ এবং গুরুবাদও মানুষের দেহে আত্মরূপী ব্রহ্মের অধিষ্ঠান স্বীকার করিয়া সোপাধিক জীবাত্মাকে নিরুপাধিক পরমাত্মরূপে দর্শন করিতে শিক্ষা দেয়। ‘ভাগবত’ বলেন, “ঈশ্বর সকলের অভ্যন্তরে আছেন, এই জ্ঞানে বহু মান প্রদান করিয়া সকলকে প্রণাম করিবে।” এই মহান উপদেশের প্রতিধ্বনি করিয়া গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ বলেন, “জীবে সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ অধিষ্ঠান।” তৈত্তিরীয় উপনিষদে আছে, “মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব, আচার্যদেবো ভব, অতিথিদেবো ভব।”
স্বামী সুন্দরানন্দের ‘যোগচতুষ্টয়’ থেকে