ব্যবসায়ে যুক্ত হলে এই মুহূর্তে খুব একটা ভালো যাবে না। প্রেম প্রণয়ে বাধা। কারও সাথে ... বিশদ
বেশ কয়েক বছর আগে চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের এই গানটি সারবত্তার জেরে শ্রোতা মহলে সাড়া ফেলেছিল। তখন ইন্টারনেট এখনকার মতো সহজলভ্য হয়নি বা হাতের মুঠোয় আসেনি। আমাদের রাজ্যে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস পেতে গেলে তখন ভরসা বলতে সাইবার ক্যাফে, দাদা-দিদিদের অফিস বা ইউনিভার্সিটির ল্যাব। দেশের প্রযুক্তি, বাণিজ্য নগরী বা হাইটেক সিটি বাদ দিলে বাকি দেশের অবস্থা মোটামুটি একই রকম। যে কারণে নেট নির্ভর প্রযুক্তি ও তার ব্যবহারও এতটা গতি পায়নি। কিন্তু, ‘ডব্লু ডব্লু আইডিয়া’ আর ‘দুনিয়া ডট কম’-কে বিজ্ঞানী-গবেষকরা এক সুতোয় বেঁধে যে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন, তা ভালোই টের পাওয়া গিয়েছিল। তা না হলে হনুলুলুর সঙ্গে হলদিয়ার যোগসূত্র কীভাবেই বা স্থাপিত হবে! কীভাবেই বা হবে আজকের এই ‘গ্লোবাল ভিলেজ’।
আসলে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্যসমূহকে এক জায়গা থেকে অ্যাক্সেস বা ব্যবহার করার কাজটি করে ফেলেছিলেন ৩৩ বছরের ব্রিটিশ বিজ্ঞানী তথা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার স্যার টিম বার্নার্স-লি। আজ থেকে তিন দশক আগে। ১৯৮৯ সালে। ১২ মার্চ সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব’ (WWW বা ডব্লু থ্রি) ৩০ বছর পূর্ণ করল। ন’য়ের দশকের শেষে বিশ্বব্যাপী তথ্যের ভাঁড়ার সৃষ্টির পর থেকে আমাজন, টেমস বা গঙ্গা দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে। ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছে সফটওয়্যার, তথ্যপ্রযুক্তি বা ইন্টারনেট নির্ভর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। কিন্তু, ১৯৮৯ সালে আজকের এই ডব্লুডব্লুডব্লু তৈরির কাজটা মোটেই সহজ ছিল না।
এককথায় কাজের জগতে ‘হতাশা’ থেকেই তৈরি হয়েছিল ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব’। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক হওয়ার পর ‘সার্ন’-এর সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পদে যোগ দেন বার্নার্স-লি। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত ‘ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ’। যা সার্ন নামেই পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীরা গবেষণার জন্য এখানে আসেন। কিন্তু সে সময় বার্নার্স-লি লক্ষ করেন, তথ্য আদান-প্রদানের ব্যাপক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে গবেষক বিজ্ঞানীদের। কারণ, সে সময় বিভিন্ন তথ্য বিভিন্ন কম্পিউটারে রাখা থাকত। আর তা পেতে গেলে আলাদা আলাদা কম্পিউটার লগ অন করতে হচ্ছে গবেষকদের। যার জেরে কাজের সময় নষ্ট হচ্ছে। আসছে বিরক্তি, হতাশা। বার্নার্স-লির কথায়, ‘এর থেকে বেশি সহজ ছিল কফি পানের সময় প্রয়োজনীয় তথ্য জিজ্ঞাসা করে নেওয়া।’
আর এই হতাশা থেকেই ১৯৮৯ সালের ৪ মার্চ বস মাইক সেন্ডেলের কাছে একটি প্রস্তাব জমা দেন বার্নার্স-লি। সেটি ছিল আজকের ডব্লুডব্লুডব্লু তৈরি করতে ‘ইনফরমেশন ম্যনেজমেন্ট : আ প্রপোজাল’। প্রস্তাবটি পড়ে সেদিন কিছু আঁচ করতে পারেননি সেন্ডেল। শুধু লিখেছিলেন, ‘ভেগ বাট এক্সাইটিং’। অর্থাৎ, ‘ অস্পষ্ট হলেও রোমাঞ্চকর’। আর সেই নোটের সবার শেষে লেখা ছিল, ‘অ্যান্ড নাও?’ অতএব এরপর কী? এরপরেই সহকর্মীদের নিয়ে ‘হাইপারটেক্সট মার্কআপ ল্যাঙ্গুয়েজ’ (এইচটিএমএল) লিখতে শুরু করলেন বার্নার্স-লি। তৈরি করা হল ‘হাইপারটেক্সট ট্রান্সফার প্রোটোকল’ (এইচটিটিপি)। আর ‘ইউনিফর্ম রিসোর্স লোকেটর’ (ইউআরএল)-কে ভর করে ১২ মার্চ আত্মপ্রকাশ করল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। ডব্লুডব্লুডব্লু নাম চূড়ান্ত হওয়ার আগে যে নামগুলি ভাবা হয়েছিল— ‘মাইন অব ইনফরমেশন’, ‘দ্য ইনফরমেশন মাইন’, ‘ইনফরমেশন মেশ’।
এরপর ১৯৯১ সালে তৈরি হল প্রথম ওয়েবসাইট, যা আজও অনলাইন রয়েছে। info.cern.ch. ওয়েবসাইট অ্যাক্সেস বা সার্চ করতে গেলে তো ব্রাউজার প্রয়োজন। বার্নার্স-লি ও তাঁর টিম ১৯৯২ সালে তৈরি করল প্রথম ওয়েব ব্রাউজার বা পেজ এডিটর ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ডট অ্যাপ’। যা আজকের মতো ঝাঁ চকচকে ছিল না। এটা ছিল ‘লাইন-মোড’ ব্রাউজার। আর ওই বছরই সেই ওয়েব সাইটে প্রথম যে ছবিটি আপলোড হয়েছিল তা হল, সার্নের মহিলা কর্মীদের নিয়ে গঠিত গানের ব্যান্ড ‘লেস হরিবলস সার্নেটস’ (এলএইচসি)-এর চার মহিলার পোজ দেওয়া ফোটো বা পোস্টার। ডব্লুডব্লুডব্লু-র ৩০ বছর পূর্তিকে স্যালুট জানিয়ে সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগল একটি ‘ডুডল’ও তৈরি করেছিল।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আর ইন্টারনেট কিন্তু এক নয়। বেশিরভাগ ব্যক্তিই এই দু’টিকে এক বলে গুলিয়ে ফেলেন। স্বয়ং স্রষ্টা বার্নার্স-লি নিজেই এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ইন্টারনেট হল, অসংখ্য কম্পিউটার একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করে তৈরি একটি সুবিশাল নেটওয়ার্ক। যার অস্তিত্ব ডব্লুডব্লুডব্লু জন্মের বহু আগে থেকে রয়েছে। অন্যদিকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব হল, এইচটিএমএল, ইউআরএল এবং এইচটিটিপি দিয়ে তৈরি একটি অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন। স্যর বার্নার্স-লির দেওয়া প্রস্তাব কার্যকর করতে সার্ন-এর তেমন সময় না লাগলেও আমজনতার হাতে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব পৌঁছতে কিন্তু কিছুটা সময় লেগেছিল। তা পৌঁছেছিল আরও চার বছর পর। ১৯৯৩ সালে। যার মানে, ‘WWW’-র ঘরে ঘরে পৌঁছনোর বয়স হয়েছে সবে ২৬ বছর। এত অল্প সময়ের মধ্যেই ইন্টারনেট জয় করেছে গোটা বিশ্বকে।
তবে, আজকের এই ওয়েব দুনিয়া কখনই চাননি বার্নার্স-লি। বর্তমানে যে পদ্ধতি বা বাণিজ্যিকভাবে তার ব্যবহার এবং মুষ্টিমেয় কয়েকটি সংস্থা বা ব্যক্তি তার ফায়দা তুলছে, সেই লক্ষ্য নিয়ে কখনই ওয়েব তৈরি করেননি তিনি। বার্নার্স-লির কথায়, ‘প্রতি মুহূর্তে যে ওয়েবের জন্য কামনা প্রার্থনা করেছি, এই ওয়েব তা নয়।’ ২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে ওয়েব স্রষ্টা বলেছেন, ‘বৈষম্য ও বিভাজনের ইঞ্জিনে পরিণত হয়েছে এই ওয়েব। ক্ষমতাশালীরা তাদের নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে তাকে ব্যবহার করছে। আমি সর্বদা মনে করি, ওয়েব হল সবার জন্য। যে পরিবর্তন আমরা নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি, তা আরও ভালো ও সুসংবদ্ধ পৃথিবী তৈরি করেছে।’ আর সেকারণেই হয়তো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জন্মদিনে জন্মস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়া সময় থমকে গিয়েছিলেন বার্নার্স-লি। ট্যুইটে লিখেছিলেন, ‘‘গতকাল সার্নের আমার পুরনো অফিসের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, যেখানে আমি ডব্লুডব্লুডব্লু নিয়ে কাজ করেছি। তথ্য সংরক্ষণের উপর ‘ফর দ্য ওয়েব’ প্রজেক্টে সেখানে কাজ করছে জ্যাকব।’’