ব্যবসায়ে যুক্ত হলে এই মুহূর্তে খুব একটা ভালো যাবে না। প্রেম প্রণয়ে বাধা। কারও সাথে ... বিশদ
লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। মারণ ভাইরাস নভেল করোনার সঙ্গে মানব জাতির লড়াই। বিধ্বংসী শক্তি নিয়ে পৃথিবীর বুকে অবতীর্ণ করোনা। এই মারণ ভাইরাস গোটা বিশ্বকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গভীর সঙ্কটের মুখে ফেলে দিয়েছে মানব সভ্যতাকে। চীন এই ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হলেও দেশের সীমানা মানেনি। ঝড়ের চেয়েও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। যে চীনে করোনা হামলার সূত্রপাত, সেখানে এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে ৮১ হাজারেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গিয়েছেন ৩ হাজার ২৮৭জন।
মৃত্যুর ভয়াবহতায় চীনকেও ছাপিয়ে গিয়েছে ইতালি। সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা সাত হাজারের আশপাশে। কারণ ইতালি করোনার ছোবলের বিষাক্ততাকে অনুমান করতে পারেনি। আমেরিকাতেও আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে। বিশ্বকে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ শাসন করে আসা আমেরিকা ভেবেছিল, হেলায় হারাবে করোনাকে। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিল। ভেবেছিল, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মতোই করোনা আমেরিকার রক্তচক্ষুকে ভয় পাবে। নজজানু হয়ে বশ্যতা স্বীকার করবে। কিন্তু, ঘটেছে ঠিক তার উল্টোটাই। আমেরিকার অহঙ্কারে আঘাত হেনেছে করোনা। এই মুহূর্তে সেখানে প্রতিদিন গড়ে হাজার দশেক করে মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাপিয়ে গিয়েছে চীনকেও। বাদ যায়নি ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন, স্পেন সহ বিশ্বের কোনও উন্নত দেশই। যেখানেই করোনা থাবা বসাচ্ছে, সেখানেই মহামারীর ছাপ স্পষ্ট।
বিদেশে থাকা মানুষজনের হাত ধরে ভারতেও ঢুকে পড়েছে মারণ ভাইরাস। প্রথমদিকে অনেকেই ভেবেছিলেন, ঠান্ডার দেশে করোনা যতই হম্বিতম্বি করুক না কেন, গরমের দেশে পা রাখলেই বন্ধ হয়ে যাবে তার হাঁকডাক। তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলেই কাবু হবে করোনা। কিন্তু, বিশেষজ্ঞদের অনুমান ভুল প্রমাণ করে দিয়ে সে তার থাবা আরও তীক্ষ্ণ ও প্রসারিত করে চলেছে। ক্রমশই সে হয়ে উঠছে বিধ্বংসী। ভয়ঙ্কর। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেমন বাড়ে অভিজ্ঞতা, তেমনই করোনাও যেন অভিজ্ঞ হচ্ছে। সে দ্রুত বদলে ফেলছে নিজেকে। এখন সে যেন অনেক বেশি পরিণত। একের পর এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে যেন ক্রমশই দুঃসহাসী হয়ে উঠছে। এই মুহূর্তে সে অপরাজেয়। তাকে বধ করার কোনও অস্ত্রই ব্রহ্মাণ্ডবাসীর হাতে নেই। তাই করোনা আতঙ্কে তটস্থ বিশ্ববাসী। সে থমকে দিয়েছে অগ্রগতির, সভ্যতার, এগিয়ে চলার সমস্ত চাকা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে মানব সভ্যতাকে উৎখাতের নেশায় সে যেন মত্ত। আসুরিক ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে সে যেন বিশ্ব শাসনে নেমেছে।
যা কিছু অশুভ, যা কিছু ধ্বংসাত্মক, তার শক্তি সব সময়ই হয় অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, মারাত্মক। পুরাণ আমাদের দেখিয়েছে, আসুরিক শক্তি বারে বারে কোণঠাসা করেছে দেবশক্তিকে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে সেই দেবশক্তির। ব্রহ্মার বরে পুষ্ট মহিষাসুর দেবকুলকে স্বর্গলোক থেকে উৎখাতের খেলায় মেতেছিল। অসুরকুলের দাপটে দেবতাদের আশ্রয় নিতে হয়েছিল ব্রহ্মলোকে। তারপর ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর সহ সমস্ত দেবতার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মা দুর্গা বধ করেছিলেন মহিষাসুরকে। জয়ী হয়েছিল শুভশক্তি।
মর্ত্যলোকে এখন অনেকটা সেই রকম পরিস্থিতিরই সৃষ্টি হয়েছে। নভেল করোনা ভাইরাসের দাপটে অতিষ্ঠ বিশ্ববাসী। তার মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে চলছে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা। চীন, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ভারত সহ গোটা বিশ্বের সমস্ত চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানী এই মারণ ভাইরাসের মোকাবিলায় নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় করোনার ছোবলে গোটা বিশ্ব বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তাকে হার মানতেই হবে। এটাই আমাদের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসে ভর করেই চালিয়ে যেতে হবে লড়াই। হতোদ্যম হওয়ার অবকাশ নেই। তবে, যতদিন না করোনাকে ঘায়েল করার অস্ত্র আবিষ্কার হচ্ছে, ততদিন নিজেদের সুরক্ষিত রাখতেই হবে। ক্ষুধিত পাষাণের মেহের আলির মতো একটাই মন্ত্র আমাদের জপে যেতে হবে, তফাৎ যাও, তফাৎ যাও।
সেই তফাৎ যাওয়াই আজ বিজ্ঞানের পরিভাষায়, কোয়ারেন্টাইন। নিজেকে গৃহবন্দি করে রাখার লড়াই। এ লড়াই বাঁচার লড়াই। এ লড়াই জিততে হবে। কঠোর অনুশাসনের বাঁধনে বাঁধতে হবে নিজেদের। এখন প্রমাণ করার সময়, আমরা শিক্ষিত। পুঁথিগত শিক্ষা নয়, এখন অর্জিত শিক্ষার পরীক্ষা। জীবনের পথ চলতে গিয়ে ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে আমরা একটু একটু করে যে শিক্ষা অর্জন করেছি, সেই সমস্ত শিক্ষা, অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। বন্যার সময় সাপ আর মানুষ একই গাছের ডালে আশ্রয় নেয়। ভুলে যায় পারস্পরিক শত্রুতা। করোনা ভাইরাস সমগ্র মানব জাতিকে আজ এমনই বিপদের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই আজ কোনও সমালোচনা নয়, আজ কোনও হিংসা নয়, আজ কোনও রাজনীতি নয়। আজ শুধুই লড়াই। করোনার বিরুদ্ধে লড়াই।
সেই লড়াইয়ে জিতে গেলে আমাদের সকলকে মেনে চলতে হবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ। মানতেই হবে তাঁদের নির্দেশিত লকডাউন। রাজ্য ও দেশ রক্ষার জন্য সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তই তাঁরা নিয়েছেন। নিতান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে কিছুতেই নয়। অন্য দেশের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে আমরা এখনও অনেকটা ভালো জায়গায় আছি, একথা ঠিক। তবে, আত্মতুষ্টির কোনও জায়গা নেই। বাঁধনের রশি আলগা হলেই খেতে হবে করোনার ছোবল। সাপের ছোবলে মৃত্যু হয় একজনের। করোনার ছোবল খেলে তার বিষ ছড়িয়ে পড়বে গোটা পরিবারে। এই মুহূর্তে পরিবারকে, সন্তানকে ভালোবাসার পরীক্ষা দিতে হবে। আর সেই পরীক্ষার নামই হলো কোয়ারেন্টাইন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, করোনার বিস্তার ঘটছে গুণোত্তর প্রগতিতে। অর্থাৎ তিনজন থেকে আক্রান্ত হবেন ন’জন। সেই ন’জন থেকে ২৭ জন, তারপর ৮১ জন, তারপর ২৪৩ জন, সেখান থেকে ৭২৯ জন। বৃদ্ধির হার ভয়ঙ্কর। তাই ভারতে আক্রান্তর সংখ্যা এখন যা আছে হাজারের নীচে, সতর্ক না হলে সেটা লাখ ছাড়াতে সপ্তাহও লাগবে না। আর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেই ভেঙে পড়বে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। সুতরাং সাবধান। কথায় আছে, সাবধানের মার নেই।
একটা সময় বাংলা ছিল পথিকৃৎ। গোটা দেশ তাকিয়ে থাকত বাংলার দিকে। বাংলার সাহস, বাংলার মেধা শুধু দেশ নয়, তামাম বিশ্বে সমাদৃত। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দকে গোটা বিশ্ব নতমস্তকে স্মরণ করে। ইহলোক ত্যাগের বহু বছর পরেও তাঁরা আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন। তাঁদের সৃষ্টি, তাঁদের শিক্ষা এবং ভাবনাই দান করেছে অমরত্ব। রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন উদার হতে। নজরুল গেয়েছেন সাম্যবাদের গান। রামকৃষ্ণদেব শিখিয়েছেন উদারতা। স্বামী বিবেকানন্দ শিখিয়েছেন, সংযমী হতে। আজ তাঁদের প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আমাদের প্রমাণ দিতে হবে, আমরা এই সমস্ত মনীষীর সার্থক উত্তরসূরি।
আর মাত্র কয়েকটা দিন। আর কয়েকটি দিনের এই চোয়ালচাপা লড়াই চালিয়ে যেতে পারলেই জয় নিশ্চিত। আমরা ফের গলার শিরা ফুলিয়ে বলতে পারব, আমরাও পারি। করোনা সঙ্কট আমাদের বাঙালি হিসেবে, ভারতবাসী হিসেবে একটা ইতিহাস সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছে। সেই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। এ লড়াই আমাদের বাঁচার লড়াই, এ লড়াই জিততে হবে। জিততেই হবে।