ব্যবসায়ে যুক্ত হলে এই মুহূর্তে খুব একটা ভালো যাবে না। প্রেম প্রণয়ে বাধা। কারও সাথে ... বিশদ
হ্যাঁ, ‘পাবজি’ (পিইউবিজি) মোবাইল গেমের জনপ্রিয়তা এতটাই আকাশছোঁয়া। আর ‘ভার্চুয়াল রিয়েলিটি’র সেই উন্মাদনার বশে কেউ অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়েছেন। বাবা মোবাইল কিনে না দেওয়ায় কোনও স্কুলপড়ুয়া আত্মহত্যা করেছে। কোথাও আবার গেম খেলতে গিয়ে আলাপ এবং সেখান থেকে প্রেম এবং শেষে পরিণয়ের ঘটনাও ঘটেছে। পাবজির জোশে মত্ত বিশ্বের আট থেকে আশি। তামাম মোবাইল গেমকে পিছনে ফেলে উল্কার গতিতে পাবজির উত্থানের রহস্যটা কী?
গেমটির পুরো নাম ‘প্লেয়ার আননোনস ব্যাটেল গ্রাউন্ড’। ভক্তদের আদুরে নাম পাবজি। গেমের নির্মাতা ব্রেন্ডন গ্রিন এবং চ্যাং হান কিম। ২০১৭ সালে তাঁরা পাবজিকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আনলেও, এর আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে গতবছর মার্চে। কম্পিউটার এবং মোবাইলের পাশাপাশি এক্স বক্সের মতো বিভিন্ন গেমিং কনসোলেও এই খেলা উপভোগ করা যায়। খেলার নিয়ম খুব সোজা। একটা বড় বিমানে করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ১০০ জন খেলোয়াড়কে একটি দ্বীপে নামিয়ে দেওয়া হয়। গোলা-গুলি, অস্ত্র-শস্ত্রে ভরা ওই দ্বীপের মাটিতে পা রাখার মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে যায় এই ‘মারণ’ খেলা। সবার উদ্দেশ্য একটাই, বাকি ৯৯ জনের অনলাইন অবতারকে হত্যা করে নিজে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা। গেমের পরিভাষায় যাকে বলে ‘উইনার উইনার চিকেন ডিনার’।
অন্যান্য মোবাইল গেমের মতোই এখানেও লক্ষ্যটা একই, যে কোনও মূল্যে জেতা। কিন্তু, জয় পাওয়ার পদ্ধতিটা প্রতিবারই আলাদা হয়ে যায়। কারণ, কীভাবে অন্যদের নিকেশ করে জিতবেন, সেটা পুরোপুরি সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়ের উপস্থিত বুদ্ধির উপরেই নির্ভর করবে। পরিস্থিতি বিচার করে কখনও হয়তো শত্রুর কাছে গিয়ে তাকে হত্যা করতে হতে পারে। আবার কখনও দূরে পাহাড়ের উপর থেকে নিখুঁত নিশানায় তাকে খতম করা যেতে পারে। কী করবেন, সেই স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে হবে সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়কেই।
আপাত সরল নিয়মের এই খেলার প্রতি পরতেই কিন্তু অভিনবত্ব রয়েছে। যেমন, প্রতিটা খেলাই হয় রিয়েল টাইমে, সত্যিকারের খেলোয়াড়দের নিয়ে। কেউ কারও পরিচিত নয়। আবার চেনাশোনাদের নিয়ে দল তৈরি করেও খেলা যায় এই গেম। এর পাশাপাশি গেমের মধ্যে একাধিক যানবাহন (গাড়ি, মোটরবাইক, স্নো মোবিল, স্পিডবোট) ইচ্ছেমতো চালানোর স্বাধীনতা রয়েছে খেলোয়াড়দের। আর আছে ভয়েস চ্যাটের সুবিধা। যার ফলে পাবজি আর নিছক গেমের গণ্ডিতে আটকে থাকেনি, সামাজিক মেলামেশার বৃহত্তর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। প্রেম থেকে বন্ধুবান্ধবের আড্ডা, সবই চলছে গেমের মধ্যে। এর সঙ্গে উন্নত গ্রাফিক্স আর অসাধারণ সাউন্ডট্র্যাকের আকর্ষণ তো আছেই।
ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারে আসার পর মাত্র এক বছরেই সাফল্যের শিখরে পৌঁছে গিয়েছে পাবজি। শুধু ভারতেই এই গেমের ভক্ত সংখ্যা ৩ কোটির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু, মজার কথা হল, ব্লুহোল এবং টেনসেন্ট, পাবজির এই দুই নির্মাতা কখনই এই গেমের প্রচারের জন্য আলাদা করে টাকা খরচ করেননি। কিন্তু, আজ সেই পাবজি’র মোট আয়ের পরিমাণ প্রায় ৩৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতীয় মূল্যে প্রায় ২৪৮২ কোটি টাকা। এই গেমটির অভিনবত্বই তাকে ঘরে-ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে এসেছে বিড়ম্বনাও। নিন্দুকরা বলছেন, ছোটদের কচি মনে ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলছে এই গেম। অবশ্য ভুল কিছু বলছেন না তাঁরা। সত্যিই এই গেমের পরতে পরতে হিংসা ছাড়া আর কিছুই নেই। মাথা ঠান্ডা রেখে প্রতিপক্ষকে খুন করার নিত্যনতুন কৌশলই খেলোয়াড়দের জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। আর যে যে ধরনের অস্ত্র-শস্ত্র এই গেমে ব্যবহৃত হয়, তা অবিকল বাস্তবের আগ্নেয়াস্ত্রের মতোই। অর্থাৎ, প্রতিটি অস্ত্রের যেমন আলাদা আলাদা ক্ষমতা, যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিস থাকে, এই গেমের অস্ত্রগুলির ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই রাখা হয়েছে। নির্মাতারা সচেতনভাবে এটা করেছেন, যাতে বাস্তবের সঙ্গে এই গেমের খুব একটা পার্থক্য না থাকে। এই আগ্নেয়াস্ত্রের তালিকায় অ্যাসল্ট রাইফেল, শট গান, স্নাইপার রাইফেল মায় ছোট মাউজার-পিস্তল সবই রয়েছে। এর সঙ্গে হ্যান্ড গ্রেনেড, স্টান্ট গ্রেনেডের মতো বোমাও ব্যবহার করতে পারেন খেলোয়াড়রা।
অভিযোগ উঠেছে, এই গেমের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় অল্পবয়সীদের আক্রমণাত্মক করে তুলছে। তাদের মনে হিংসার বীজ বুনে দিচ্ছে। গুজরাত সরকার ইতিমধ্যেই এই গেমকে নিষিদ্ধ করার কথা বলেছে। জাতীয় শিশু অধিকার রক্ষা কমিশন ও কাশ্মীরের একটি ছাত্র সংগঠনের তরফেও এই গেমের প্রবল বিরোধিতা করা হয়েছে। সবারই বক্তব্য এক, গেমের ঠেলায় পড়ুয়াদের লেখা-পড়া লাটে উঠেছে। তাই অবিলম্বে এই গেমকে নিষিদ্ধ করতে হবে। বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হওয়ার পর সম্প্রতি গুগল প্লে স্টোর এবং অ্যাপলের স্টোর এই গেমকে শুধুমাত্র ১৭ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য চিহ্নিত করে দিয়েছে।
তবে, বিরুদ্ধ মতও রয়েছে। গেমপ্রেমীরা বলছেন, নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে এই গেমের প্রতি কৌতূহল আরও বাড়বে। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তার চেয়ে বরং বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এই আসক্তি কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। ভালো হোক অথবা খারাপ, অতিরিক্ত কোনও কিছুই যে ঠিক নয়, সেটা বোঝাতে হবে। গেমের সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণকে এক আসনে বসিয়ে দেওয়াটা মোটেই ঠিক নয়। তাছাড়া গেমিংয়ের জগতে টাকা রোজগারের যে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, সেটাকেও অস্বীকার করা যায় না। দেশে এমন প্রচুর পেশাদার যুবক-যুবতী রয়েছেন, যাঁরা গেম খেলেই অর্থ উপার্জন করেন। ইউটিউবে পাবজি গেমের লাইভ স্ট্রিমিং থেকেও প্রচুর টাকা উপার্জন করা যায়। তাই পাবজিকে নিষিদ্ধ করে তাঁদের রুটি-রুজি বন্ধ করার কোনও যৌক্তিকতা নেই বলেই মনে করছেন অনেকে।