নয়াদিল্লি: না আছে ঢাল, না তলোয়ার। প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ছাড়াই সেমি-হাইস্পিড ট্রেন নামিয়ে এখন বেজায় ফাঁপরে ‘নিধিরাম’ রেল। তাই যাত্রী সুরক্ষার দোহাই দিয়ে এবার বেশ কিছু রুটে প্রিমিয়াম ট্রেনগুলির গতি কমিয়ে আনার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সূত্রের খবর, এই তালিকায় রয়েছে নির্দিষ্ট রুটে চলা বেশ কয়েকটি বন্দে ভারত, গতিমান এক্সপ্রেসের মতো ট্রেন। মূলত এইসব রুটে ‘ট্রেন প্রোটেকশন অ্যান্ড ওয়ার্নিং সিস্টেম’ (টিপিডব্লুএস) অকেজো হয়ে পড়ার কারণেই ওই ট্রেনগুলির সর্বোচ্চ গতি প্রতি ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার থেকে কমিয়ে ১৩০ কিলোমিটারে নামিয়ে আনার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী মোদির স্বপ্নের বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের গতি কমিয়ে এইসব রুটে রাজধানী এক্সপ্রেসের সমতুল করে ফেলা হতে পারে। ফলে রাজধানীর থেকে অনেক বেশি ভাড়া গুনেও প্রায় সমান গতিতে কেন বন্দে ভারতের যাত্রীদের যেতে হবে, সেই প্রশ্ন উঠছে। ঘটনাচক্রে, উত্তরবঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে ভয়াবহ দুর্ঘটনার দিন দশেকের মধ্যে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে একঝাঁক প্রিমিয়াম ট্রেনের গতি কমিয়ে আনার এই উদ্যোগ রেলের পরিকাঠামোর বেহাল দশার দিকেই ইঙ্গিত করছে।
রেল বোর্ডকে সম্প্রতি উত্তর-মধ্য রেলওয়ে চিঠি লিখে দিল্লি-ঝাঁসি-দিল্লি গতিমান এক্সপ্রেস, দিল্লি-খাজুরাহো-দিল্লি বন্দে ভারত, দিল্লি-রানি কমলাপতি-দিল্লি বন্দে ভারত ও দিল্লি-রানি কমলাপতি-দিল্লি শতাব্দী এক্সপ্রেসের গতি কমিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছিল। সূত্রের খবর, সেই প্রস্তাবে অনুমোদনও চলে এসেছে। গতি কমার ফলে এই রুটে ট্রেনগুলির গন্তব্যে পৌঁছতে বাড়তি ২৫ থেকে ৩০ মিনিট সময় লাগবে। আর সেই কারণে আরও অন্তত ১০টি ট্রেনের বর্তমান নির্ঘণ্টে বদল করতে হবে। গতি কমানোর নেপথ্যে যে পরিকাঠামো ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রের ব্যর্থতা রয়েছে, সেই ইঙ্গিতও মিলছে। রেলের এক প্রবীণ আধিকারিকের মতে, দিল্লি-আগ্রা-ঝাঁসি রুটে ‘ট্রেন প্রোটেকশন অ্যান্ড ওয়ার্নিং সিস্টেম’ (টিপিডব্লুএস)-এর ব্যর্থতাই গতি কমানোর কারণ।
জানা গিয়েছে, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ পরই নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সুনির্দিষ্ট রুটে প্রিমিয়ার ট্রেনগুলির গতি কমানোর নির্দেশ জারি করা হয়। কিন্তু যাত্রী সুরক্ষাকে ঢাল করলেও গলদ যে অন্য জায়গায়, রেল তা ধামাচাপা দিতে পারছে না। ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজারের একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, টিপিডব্লুএস-এর মেরামতি কোনওভাবেই আর সম্ভব নয়। সেই কারণেই প্রিমিয়াম ট্রেনগুলিতে সর্বোচ্চ গতি অনেকটা কমিয়ে ১৩০ কিমোমিটারে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এবিষয়ে গত বছর নভেম্বরে প্রথম প্রস্তাবটি দিয়েছিল উত্তর রেলওয়ে। সম্প্রতি একই প্রস্তাব দেয় উত্তর-মধ্য রেলও। যাত্রী নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে দু’টি জোনের তরফে একই অনুরোধ আসায় তাতে অনুমোদন না দিয়ে রেল বোর্ডের আর অন্য কোনও উপায় ছিল না বলেই সূত্রের খবর।
তাহলে কি দেশের অন্য রুটগুলিতেও বন্দে ভারতের গতি কমিয়ে আনা হবে? রেলের অন্য এক আধিকারিক বলেন, ‘সেমি-হাইস্পিড ট্রেনগুলি উপযুক্ত ট্র্যাকের অভাবে এমনিতেই দেশের কোথাও ১৩০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ছোটে না। একমাত্র ব্যতিক্রম দিল্লি-কানপুর সেক্টরের কিছু অংশ। এই অংশে ট্র্যাক উপযুক্ত হওয়ায় ১৬০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব।’ বন্দে ভারতের ‘জন্মস্থান’ ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরির প্রাক্তন প্রিন্সিপাল চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সুভ্রাংশু বলেন, ‘যাত্রী সুরক্ষার দোহাই দিয়ে ট্রেনের গতি কমিয়ে কোনও লাভ নেই।’ কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনার উদাহরণ টেনে তাঁর বক্তব্য, যে মালগাড়িটি ধাক্কা দিয়েছিল, সেটির গতি ছিল মাত্র ৪৫ কিলোমিটার। ফলে ১৬০ কিলোমিটার থেকে গতি কমিয়ে ১৩০ কিলোমিটার করে কী লাভ হবে তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। মূল কারণ না খুঁজে গতি কমানোর সিদ্ধান্ত দুর্ভাগ্যজনক।